- "শামীম, এই শামীম!! কালকে ভার্সিটি আসবি তো?"
- "আসব, তুইও সকাল সকাল চলে আসিস।"
- "নিজেকে শোনাও কথাটা, আমি প্রতিদিনই তাড়াতাড়ি আসি। কালকে অবশ্যই সাতটার মধ্যে ক্যাম্পাসে চলে আসিস।"
------------------------
সকাল আটটা। কলাভবনের সামনে ছাত্রছাত্রীরা একে একে জড়ো হচ্ছে। শামীম তার রুমমেট রহমানকে নিয়ে কলাভবনের পশ্চিম গেট দিয়ে প্রবেশ করছে।
- "দেখেছিস কত পুলিশ? একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে!"
- "হুম তাইতো দেখছি। তাড়াতাড়ি চল, দেরী হয়ে গেলে হক ভাই আস্ত রাখবেনা।"
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আব্দুল মতিন অসম্ভব বিরক্ত। একটু আগে শামসুল হক ভাই বলেছেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার তিনি পক্ষপাতি নন। এর কোন মানে হয়? এতগুলো ছাত্রছাত্রী টগবগ করে ফুটছে কিছু একটা করার জন্য। আর এখন তারা ১৪৪ ধারা না ভেঙ্গেই বাসায় ফিরে যাবে? কিছু বলার আগেই গাজীউল হক প্রথমে এর প্রতিবাদ করলেন। প্রতিবাদ করলেন মতিন নিজেও। আকাশ ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠল ছাত্রছাত্রীরা। গলা খাঁকারী দিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদ জানালেন তিনি কিছু বলতে চান। বহু কষ্টে সবার হইচই থামার পর স্বভাবসুলভ নীচু গলায় তিনি যা বলে গেলেন তা সবারই পছন্দ হল। মিছিল হবে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে। তবে একই সাথে শৃঙ্খলা থাকবে। মিছিল হবে ১০ জনের। পুলিশ যেন বলতে না পারে তারা রাস্তায় অনর্থ করেছে। হঠাৎ করেই চারদিক থেকে তুমুল হইচই শুরু হল? ব্যাপার কি?
------------------------
মিতু অনেক কষ্টে শামীমকে খুঁজে পেয়েছে।
- "এই শামীম কি হয়েছে রে?"
- "লালবাগে নাকি গন্ডগোল হয়েছে। স্কুলের বাচ্চাদেরকে পর্যন্ত লাঠি চার্জ করেছে পুলিশ ভাবতে পারিস?"
- "এরা কি পাগল হয়ে গেল নাকি?"
শামীম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হইচইয়ের আওয়াজে ওর গলার স্বর চাপা পড়ে গেল। প্রোক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী কলাভবনের গেট খুলে দেবার আদেশ দিলেন। হাবীবুর রহমানের নেতৃত্বে দশ জনের প্রথম দলটি বের হয়ে গেল। তারপর দ্বিতীয় দল, তারপর তৃতীয় দল। আনোয়ারুল হক খান বের হবার সময় চেঁচিয়ে বললেন, “সুলতান! তোমার উপর দ্বায়িত্ব রইল, ভুলে যেওনা। তুমি লক্ষ্য রাখবে কারা গ্রেফতার হচ্ছে। আজাহার কে নিয়ে তুমি তাদের লিস্ট বানাবে।”
------------------------
মিতুকে কি আজকে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশী সুন্দর লাগছে? শামীম সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। চতুর্থ দলে ওর আসার একেবারেই ইচ্ছা ছিলনা। মতিন ভাই জোর করাতে সে এসেছে। এই দলে মিতু আছে। মিতুকে সে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলতে চায়। মেয়েদের সহজাত ক্ষমতাবলে মিতুও সেটা টের পায়। টের পেলেও মিতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। বরং সে বেছে বেছে এমন কাজগুলোই বেশী করে করে যাতে শামীম বিরক্ত হয়। এই দলে শামীমকে ঢোকানোর পেছনে তার একটা সূক্ষ্ম ভূমিকা আছে। শামীম সেটা জানে না। আমতলা দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় হঠাৎ মিতু বলে উঠে, “দ্যাখ শামীম কত মুকুল হয়েছে এবার? আমি কোনদিন এই গাছে এত বেশী মুকুল দেখিনি!” শামীম কিছু বলেনা। কিছুক্ষন অপলক মিতুকে দেখে। তারপর সাবধানে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
------------------------
মিছিল চলছে। পুলিশের ধাওয়া পালটা ধাওয়াও চলছে। বেলা দুইটার দিকে হঠাৎ পুলিশ কেন যে এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল বোঝা গেল না। ফার্স্ট ইয়ার হিস্ট্রির আতিকুল কে চীৎকার করতে করতে শামীম দৌড়াতে দেখল। কিছু একটা বলছে সে। কি বলছে? গাজিউল হক ভাই গুলি খেয়েছেন? শামীমও দৌড়োচ্ছে। গুড়ূম গুড়ুম আওয়াজ হচ্ছে। এটা কি টিয়ার শেল? নাকি গুলি? এখন ক’টা বাজে? তিনটা? সময় দেখতে গিয়ে শামীম দেখে তার শখের হাতঘড়িটা নেই। তিন বছর ধরে টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছিল ঘড়িটা। জগন্নাথ হলের কাছাকাছি আসতেই শামীমের মনে হল আকাশটা হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ল। পড়ে যাবার আগে হঠাৎ সে লক্ষ্য করল মিতু তার পাশে নেই। একটু আগেও ছিল। গেল কোথায়?
------------------------
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। বেলা তিনটা বেজে দশ মিনিট। জগন্নাথ হলের কাছে অবস্থান নেয়া পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশের কিছু সাধারণ মানুষ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিল। জীবন কি, তা বুঝে ওঠার আগেই অহিউল্লাহ নামে আট নয় বছরের একটি শিশুও মারা গেল। চলে যাবার সময় হয়ত তার শেষ শব্দটি ছিল, "মা"। আহত সালাম মারা গেলেন একমাস পর ১৯৫২ সালের ১৭ই এপ্রিল। এই বোকা মানুষগুলোর একটাই দোষ ছিল। তা হল, নিজেদের মুখের ভাষা কি হবে তা নিয়ে মত প্রকাশ করা।
কথিত আছে সেদিন কিছু লাশ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকে করে সরিয়ে ফেলা হয়। শাড়ি পরা ঊনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ের লাশ সরানোর সময় একজন পুলিশ কৌতূহলী হয়ে লক্ষ্য করল মেয়েটার ডান হাতের মুঠোয় কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে। মুঠো খুলে দেখা গেল সেখানে কিছু আমের মুকুল।
------------------------
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, "ভয় নাই, ওরে ভয় নাই"--
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান "ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।"
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২১/০২/২০১৪