ফজলু সাহেব হাতে এখনো রডটা ধরে আছেন। রডের মাথায় রক্ত লেগে আছে। দু-এক ফোঁটা রক্ত তখনো বেয়ে বেয়ে পড়ছে। সামনের দিকে একটু বাঁকাও হয়ে গেছে। তিনটা মাথা ফাটালো মাত্র আর তাতেই রড বাঁকা! কত জোরে বাড়ি দিয়েছেন নিজেও বুঝতে পারছেন না। হয়তো নিজের সব শক্তিই ছিলো কিংবা অশরীরী কিছু তার উপর ভর করেছে। নিজের সামনে নিজের একমাত্র মেয়েকে কেউ ধর্ষণ করলে সম্ভবত যে কারোর উপর অসুরের শক্তি ভর করবে।
ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন জানেন না ফজলু। যখন সম্ভিত ফিরলো, দেখলেন বিকৃত মাথার তিনটা লাশ। মাথা থেকে ছিটকে বের হওয়া রক্ত আর মগজ ফ্লোরে মিলে সব লাল হয়ে গেছে। একটু দূরেই পড়ে আছে তার মেয়ে জবা। মেয়ের কাছে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন তিনি। মেয়েটার শরীর নিথর হয়ে পরে আছে। মারা গেছে? কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না! তাহলে কী মেয়েটা….। নরপশুলো মেয়েটাকে মেরেই ফেললো!
কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না ফজলু সাহেব। ঘর থেকে বাইরে গেলেন। দরজা খুলতেই দরজার গা বেয়ে একটা লাশ তার পায়ের কাছে পড়লো। মেয়েটার গায়ে এখানে সেখানে কামড়ের দাগ। কামড়ের ক্ষতের কারণে চেহারা বিকৃত হলেও ফজলু সাহেব চিনলেন এটা তারই ছোট ভাইয়ের মেয়ে রুপা। মাত্র ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিলো মেয়েটা। আজকেই তাকে নিয়ে ফুফুর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো। রুপা বলেছিলো ফুফুর বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেই নাক মুখ গুঁজে পড়ালেখা শুরু করবে এসএসসি পরীক্ষার জন্য। ও কী ওর প্রিয় লাল জামাটা পরে রেডিই হয়ে ছিলো! নাকি ওর রক্তে জামাটা লাল হয়ে গেছে?
ফজলু সাহেব লাশটাকে মাড়িয়ে আরেকটু সামনে গেলেন। দুপাশে পাম গাছ লাগানো বাড়িতে প্রবেশের রাস্তা, সখ করে রাস্তার মধ্যেও মোজাইক পাথর লাগিয়েছেন। এই রাস্তার মধ্যেই পড়ে আছে আরো কয়েকটা লাশ। এদের কাউকে তিনি চেনেন কাউকে অল্প চেনেন। সামনেই পড়ে থাকা রফিক ওনার বাড়ি পাহারার কাজ করতো। তার পেছনে হাত বাঁধা, শুয়ারগুলো অনেক মেরেছে তাকে। কোন নড়াচড়া নাই, শুরু চোখের পাতাগুলো একটু নড়ছে। হয়তো দশ সেকেন্ডের মধ্যেই মরে যাবে। একটু দূরেই গায়ের প্রায় সকল কাপড় ছেড়া আরেকটা মেয়ের লাশ। চেনা যাচ্ছে না খুব একটা। দু-গালের মাংসই কামড়ে খাবলে নিয়েছে মেয়েটার। গলার দিকেও কামড়ের একটা বিশাল ক্ষত। মেয়েটা কি রফিকের ছোট মেয়ে। মেয়েটাতো একদম বাচ্চা ছিলো! কত, ১৪ বছর হবে বয়স! এই মেয়েটাকেও? এরা কি মানুষ ছিলো!
একটু সামনে এগোতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেলেন ফজলু! কোটি টাকার মোজাইক পাথরের রাস্তায় রক্ত লাগলে যে মানুষ পিছলে পড়ে যায় এটা ফজলুর জানা ছিলো না। তিনি উঠলেন, সাবধানে পা ফেলে এগোতে লাগলেন! কী করবেন উনি! পালাবেন? তার কি পালানো উচিত! পালাবেন কেনো? তিনজন পশুকেতো তিনি মেরেই ফেলেছেন! তারতো আর কোন ঝুকি নেই। বুঝতে পারছেন না ঠিক! তবে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। পেছনে রেখে মোজাইক পাথরের রাস্তা, রক্ত, ক্ষত বিক্ষত ধর্ষিত লাশ! এই দৃশ্যগুলো ফজলু সাহেব সহ্য করতে পারছেন না। তার পালানো উচিত। এখনই পালানো উচিত। বাড়ির গেটের বাইরে গিয়ে তিনি আর পা ফেলতে পারছেন না! সামনে শত শত লাশ। শত শত ধর্ষিতা মেয়ে। সবার চেহারাই ক্ষত বিক্ষত।
কিন্তু আশ্চর্য, এখানে অনেককেই তিনি চেনেন, এরা আরো আগেই মরে গিয়েছিলো। এই যে কুসুম! এই মেয়েটা গত বছরই মরেছে। যদিও ধর্ষন করেই মেরে ফেলা হয়েছে তাকে। তার পাশেই পড়ে থাকা বদি আলমের বউ! তাকেওতো তিন বছর আগে রবি, কাদের আর জসিমরা ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে!
রবি, জসিম আর কাদেরকে আবারো শুয়ার, জানোয়ার, নরপশু, নিমখহারাম বলে গালি দিলেন ফজলু সাহেব। এই কুত্তারবাচ্চা গুলোকে কত শত বার ধর্ষণের জন্য খাওয়া মামলার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন ফজলু। এই যে বদি আলমের বউ, কুসুম এমন অনেক মেয়েকেই শুয়ারগুলো ধর্ষণ করে মেরেছিলো। ফজলু সাহেবই তাদেরকে সেই সব মামলা থেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু শুয়রের বাচ্চাগুলো তার মেয়ে আর ভাতিজিকে কেনো এভাবে মেরে ফেললো! এই বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ফজলু সাহেব।
ভাবতে ভাবতেই ফজলু সাহেব হঠাত দেখলেন কুসুম আর বদি আলমের বউ সহ আরো শত শত মেয়ে তার দিকে তেঁড়ে আসছে। সবার হাতে রড। ফজলু সাহেব দৌড়াচ্ছেন। প্রানপণে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না, এরা সবাই তাকে তাড়া করছে কেনো? সে কী করেছে?
প্রাণপণে কতক্ষণ দৌড়ালেন মনে নেই ফজলুর। ক্লান্ত হয়ে পড়ে গিয়ে সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। জ্ঞান ফেরার পর প্রথমেই তার মাথায় আসলো কুসুম আর বদি আলমের বউ তাকে তাড়া করছে কী না! না, তাড়া করছে না। ফজলু আবার হাঁটা ধরলেন, কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন জানেন না। জনমানবহীন মোজাইক পাথরের একটা রাস্তায় তিনি হাটছেন। মাঝে মাঝে রক্তের জন্য পিছলে পড়ে যাচ্ছেন। উঠে আবার হাটছেন।
আর বলছেন-আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক! বিশৃঙ্খলাকারীকে ধরিয়ে দিন। আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০১