বছর তিনেক আগের এ রকম একটা দুপুর, শত শত মানুষ রাস্তায়। সবুজ অটোরিক্সাটা ছুটে চলেছে, মানুষের ভিড় ঠেলে রানা প্লাজার কাছে পৌঁছালাম, আশ পাশে উৎসুক মানুষ। পাশেই দেখলাম বিরিয়ানির প্যাকেটের গন্ধ, কিছু লোক ভেতরে যাচ্ছে আসছে, পাশের ভবনে গেলাম, দেখলাম আমাদের সাহসী ফায়ার বিগ্রেডরের লোকজন, কাজ করছে, নিজের পরিবারের সদস্য উদ্ধারের মত করে। ভেতরে কিছু স্বেচ্ছাসেবি, মানব-শরীরের পঁচে যাওয়া মাংসের গন্ধ।
একটু বাইরে আসলাম, লাশ গুনছে অনেকে, ঘটনার তিন দিন পর (২৭ এপ্রিল ২০১৩ ) দেখতে গিয়েছিলাম রানা প্লাজা ট্রাজেডি। লেখাটাও উদ্দেশ্য ছিল। বাইরে এসে রোড ডিভাইডারের ওপর দাঁড়ালাম,লাইজু নামে একজন নারী এগিয়ে এসে বললেন, তার বোন সীমার সাথে কথা হয়েছে, টয়লেটে আটকা। কিছু করা যায় কিনা? চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।
বোন সীমাকে জীবিত দেখতে তার মন কাঁদছে। বললেন, সীমা তিনতলায় কাজ করতেন। এক ছেলের মা সীমা ২৪ এপ্রিল সকালে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে এলেন কাজে। তারপর নিখোঁজ। চার্জ নেই মোবাইলে। তবুও বোনের মন মানে না। রিচার্জ করে কিছু টাকাও পাঠালেন বোনের ফোনে। কিছুক্ষণ পরপর বোনের মোবাইলে চেষ্টা করছিলেন। যদি কথা বলা যায়। যদি জানা যায় বোনটি কেমন আছে! শেষ পর্যন্ত তার আর কিছু জানা গেলো না।
একই রকম অবস্থা ছিল মাসুদ রানার। বগুড়ার সোনাতলা থেকে এসেছিলেন তিনি। বোন শাহিনূর ও ভাইয়ের মেয়ে নাজমার কোনো খবর জোগাড় করতে পারেননি। ছুটেছেন অধরচন্দ্র স্কুল, এনাম মেডিক্যাল, সিএমএইচ থেকে রানা প্লাজা।
তিন ছেলে ও একমাত্র কন্যার বাবা আবুল কাসেম ভূঁইয়া নিখোঁজ হয়েছিলেন । তার লাশের খোঁজে বড় ভাই মোহাম্মদ ইবরাহীম অধরচন্দ্র স্কুলে অপেক্ষা করেছেন। ছেলে শাফায়েত রানা প্লাজার সামনে ছিলেন। স্ত্রী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, যদি প্রিয় স্বামীর দেখা মিলে। না সে সব আশা মিথ্যে। দেখা মেলেনি স্বজনের ।
অগুনতি ব্যর্থতার ভেতর কিছুক্ষণ পর পর লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে, সে লাশের গাড়ি যাচ্ছে অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। যে সব মানুষের জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছিল তাদের নেয়া হচ্ছিলো এনাম মেডিকেল ও সিএমএইচএ!
আমার জীবনের এ রকম করুণদৃশ্য এর আগে দেখিছিলাম সিডর আক্রান্ত শরণখোলায়। সেখানে মানুষের লাশ ঝুলে ছিল গাছে, ধান ক্ষেতে ফুলে ওঠা মানুষের লাশ। সে এক হৃদয় বিদারক, নির্মম ও নৃশংস দৃশ্য!
এটি দ্বিতীয় কঠিন এবং রূঢ় একটা কষ্টময় স্মৃতি হয়ে গেঁথে গেলো।
অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে এক নারী চিৎকার করে শুয়ে পড়ছিলেন, আমি তার কাছে যেতে যেতে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন, স্বামী সন্ধানী নারী নিখোঁজের তালিকার স্বামীর নাম লেখাতে এসেছিলেন।
ছোটবেলায় আমরা দেখতাম দুর্যোগের পর রিলিফ আনতে কিম্বা ইউনিয়ন পরিষদের দুস্থ সহায়তা পেতে লম্বা লাইন। জীবনে আমি প্রথম এবং একবারই লক্ষ্য করলাম, লাশ খুঁজতে লম্বা লাইন। এক নির্মম অভিজ্ঞতা আর করুণ আর্তির কোনো বর্ণণা করার মত ভাষা আমার জানা নেই।
সাভারের অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠজুড়েই হাহাকার। লাশের সংখ্যা নিয়েও ছিল ধুম্র জাল। নিখোঁজ মানুষের পরিনসংখ্যানও সঠিকভাবে মিলেনি।
ইতিহাসের এ ভয়াবহতম ঘটনায় দু'হাজারের বেশি মানুষ মরে বেঁচে গেছেন। আর যারা আহত হয়ে বেঁচে গেছেন, তাদের জীবন চলছে দুর্বিসহ অবস্থায়।
এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েনি। রসিকতা হয়েছে। নিপীড়ত মানুষের পক্ষে আমরা কাউকে দাঁড়াতে দেখিনি। সবার শরীরে এখন চিকনাই জমেছে। চোয়ালে জমেছে লাস্যতা। কেউ রোদে পুড়ে আন্দোলন করে অধিকার আদায়ের লড়াই করতে চান না। আর 'দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই করা' লোকেরা তো এখন সরকারের চাকা ঘোরাচ্ছে! সুতরাং মরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য দিন উল্লেখ করেই শোকই একমাত্র প্রাপ্য! তাও এর দু এক বছর তাও থাকবে বলে মনে হয় না।