যে শহরে আমি নেই আমি থাকবোনা সে শহরে যুদ্ধ শেষের
ভাঙ্গা - পোড়ো একটা এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি !
আবিদ আজাদের এ কবিতাটি যখন তোমার তুমুল প্রিয় হয়ে ওঠেছে, সেই সময়ে, নিস্তব্ধ দুপুরের খাঁ খাঁ নির্জনতায়, কিম্বা তারও ক্ষণিক পরে সূর্যটা যখন পশ্চিমে হেলে পড়ে হলুদ আভা ছড়াতে ছড়াতে অকস্মাৎ লাল বৃত্তে রূপপরিগ্রহ করে, যখন টুপ করে অন্য আকাশে ডুব দেয়, ডুবন্ত সূর্য আর আকাশসীমা যখন দৃষ্টির অন্তরালে থাকে শহুরে দালানাবদ্ধতায়, আমাদের সুবিদ লেইনের বুক বরাবর ফালি করে যে রাস্তাটা তেমাথায় গিয়ে মেশে যেখানে অনন্যাদের বাড়ি, তার পাশের মসজিদ থেকে যখন চারপাশে ছড়িয়ে যায় সন্ধ্যার আযান, ঠিক একই সময়ে আমাদের শৈশবের গ্রাম সুন্দরপুরের কৃষক রমিজ মিয়ার বেঁচে থাকা একমাত্র কিশোর সন্তান সুরুজ মিয়া যখন তার গো-বাচুরের পাল সমেত গোবেচারা চোহারায় মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে নিমেষেই নবিন মাষ্টারের পেয়ারা বাগানে নিঃশব্দে নিজেকে গলিয়ে নেয়, যখন দু'খানা ঢাউস পেয়ারা সুরুজ মিয়ার লুঙ্গির কোঁচড়ে সযত্নে আসন লাভ করে আর সুরুজ মিয়ার মাতা কুলসুম বেগম যিনি চারটি সন্তানের জন্মদাত্রী , ইতোমধ্যে যিনি তিন সন্তানের অর্ধাহার আনাহার আর বিনা চিকিৎসার মৃত্যু দেখে দেখে চোয়ালের মাংস হারিয়েছেন, তিনি যখন সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতে গিয়ে আবিস্কার করেন, চিৎপটাং কেরোসিনের টিনে একখানা মৃত টিকটিকি, স্বভাবতই যখন রমিজ মিয়ার খনখনে কন্ঠ শুনা যায়,-'বান্ধি ! বাত্তি জ্বালায়তে এতক্ষণ লাগে; তখনও যখন কেরোসিনের শোক কাটাতে না পারা কুলসুম বেগমের তব্দা ভাব বর্তমান, তখন যখন সুন্দরপুর নিবাসী জনতারা ছেড়া ছেড়া বিচ্ছিন্ন দলে সন্ধ্যাকালের বাজারে যায়, তাদের হাতে থাকে 'এক ছটাক' ওজনের ভোজ্য তেলের শিষি, আধা লিটার ওজনের কেরোসিনের টিন, আঁশটে গন্ধযুক্ত তেল চিটচিটে চট বা কাপড়ের থলে, তখন যখন ডুং ডাং ঘন্টা ধ্বনীতে সন্ধ্যার বাজারে নামে এক মিনিট নীরবতা, একজন ঘোষক ঘোষণা করেন একটি বিশেষ ঘোষণা; বিশাল বপু মহিষের লম্বা শিং থেকে তৈরী এক প্রকার নিজস্ব প্রযুক্তির মাইক হয়ে সে ঘোষণা যখন ছড়িয়ে যায় জনতার কর্ণে,- "ভাইসব ! ভাইসব ! একটি বিশেষ ঘেষণা ! একটি বিশেষ ঘোষণা !! আগামীকল্য রোজ বৃহস্প্রতিবার বৈকাল পঞ্চঘটিকায় চর সুমাত্রার উত্তরে কৃষ্ণ ষাঁড়ের লড়াই অনুষ্ঠিত হইবে ! আপনারা আমন্ত্রিত ! আপনারা আমন্ত্রিত !"
ঠিক সেই সময়ে, যখন আমাদের সুবিদ লেইনের এক তলা বাড়ির বারান্ধায় নিঃসঙ্গ দোল কেদারাকে তুমি সঙ্গ দিতে থাকো, কিম্বা দোল কেদারা তোমাকে সঙ্গ দেয়, তোমার পাশে অযত্নে পড়ে থাকে অপঠিত খবরের কাগজ, দু'বাটি শিতল চা, অভ্যাসবশত যা তুমি তৈরী করো প্রতি সন্ধ্যায়, যাতে উড়ে বসে দু'জোড়া কালোমাছি, আমাদের মৌমিতা মা মণি যখন শিশুতোষ পাঠ্য পুস্তক বন্ধ রেখে টম এ্যন্ড জেরী টিভি কার্টুনে মনোযোগ দিতে বেশী পছন্দ করে, সেই সময়ে, বারান্ধার গ্রিলের শূণ্যতা ভেদ করে যখন তোমার দৃষ্টি সারি সারি বাড়িগুলোর একদম শেষে দেখে অনন্যাদের বাড়ি, যখন ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় নেমে আসে ছাই রঙ্গা বিষাদ, তখন তোমার মনে পড়ে এরকম আধো আলো আধো অন্ধকারের খেলাকে সঙ্গী করে এখানটাতেই আমরা পাশাপাশি বসতাম, আমরা হাত ধরতাম, পরস্পরের চুলে বিলি কাটতাম, কখনওবা আমাদের দু'জোড়া ঠোঁট তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠলে, অগত্যা ঠোঁটগুলোকে আমারা একজোড় করতাম..তখন, বারান্ধার এক কোণে খাঁচাবন্ধী ময়নাটি হি হি হি হাসতো নিখুঁত মেয়েলী স্বরে, তখন তোমার কাঁচের চুড়ি ভাঙ্গতো রিনঝিন, তোমার নুপুর বাজতো ঝুনঝুন, তখন ঘোর লাগা সেইসব সন্ধ্যায় কখনও সখনও তোমার ব্যক্তিগত প্রশ্নের ঝাঁপিটির মুখ আলগা হয়ে গেলে, সংঘবদ্ধ প্রশ্নরা ঝাঁপিয়ে পড়তো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতো, তুমি বলতে -
- মৌমির আব্বু !
- বলো, শুনছি !
- একটা সময় অনন্যাদের বাড়ি তুমি খুব যেতে, না ?
- আমি যেতাম ?
- হুঁ, তুমি ?
- একটু ভুল, শুদ্ধটা হবে আমরা যেতাম !
- তোমরা কারা ?
- বন্ধুরা !
- দলবদ্ধ অভিসার ?
- সেরকম না মোটেই !
- কি রকম তবে ?
- অনন্যাদের একটা গাছ ছিল, আমলকি গাছ, আমরা ওটাকে যাদুকরী গাছ বলতাম !
- যাদুকরী কেন ?
- ওই গাছের আমলকি খাবার পরও আমরা দীর্ঘক্ষণ মুখে স্বাদ জমিয়ে রাখতে পারতাম ! লবণে গুঁড়ো মরিচ ছিটিয়ে আমরা আমলকি খেতাম, গাছের নীচের নলকূপ থেকে আঁজলা ভরে পাতালপূরীর শীতল পানি পান করতাম এবং মুখে মিষ্টি স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম !
- আর ?
- আর কি !
- হৃদয়ে মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে ফিরতে না ?
- যেমন ?
- অনন্যাকে দেখার মিষ্টি সুখের অনুভূতি !
- তোমার যা কথা...!
এরকম আমতা আমতা করে পরক্ষণেই যখন দিনের মনোঃমুগ্ধকর প্রকৃতি এবং তার পূর্ণ বৈচিত্রতা বিষয়ে আলাপ পাড়ার প্রয়াস নিতাম, সে প্রয়াসকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়ে যখন তোমাতে ভর করতো গাম্ভীর্য রোগ, আর আমার আঙ্গুলেরা তোমার কপালের চুল সরিয়ে দেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, আমার তর্জনী মেপে নিতো তোমার সরু ঠোঁটের সঠিক পরিমাপ, সেই সময়ে এইসব প্রথাসিদ্ধ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রচলিত সবক পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে, কন্ঠস্বরে পর্যাপ্ত শ্লেষ মিশিয়ে তুমি বলতে,
- একটা তথ্য দিতে পারো ?
- কি তথ্য, জ্বনাবা ?
- তোমার প্রেমের সঠিক পরিসংখ্যান কতো ?
প্রশ্নটি বুঝে ওঠবার মুহূর্ত পর্যন্ত নীরবতা, এবং তারপরই সঙ্গে সঙ্গে যখন আমার শেষ অস্ত্রের যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতাম, তোমার অব্যর্থ অস্ত্র কান্নার মতো, আমার অব্যর্থ অস্ত্র হাসি, কোমল হাসি সযত্ন পটুতায় অকৃপণ প্রাণে পরিবেশন করতাম, আমার কোমল হাসি তোমার কোমলতায় হানা দিতো, তুমি দ্রবীভূত হলে, তোমার নরম ওষ্ঠাধর ততোধিক নরম আর গাঢ় হয়ে সঠিক জায়গায় বসে গেলে, আমি তখন মুখ খুলতে চেয়েও ব্যর্থ হতাম, আমি তখন বলতে চাইতাম,- 'শুনো; শিশু পার্কের বেঞ্চিতে আমরা বুড়োরা, বুড়োরা না, বরং বলি আমরা বড়রা দু'জন, তুমি আর আমি যখন নিয়মিত বাদামের খোসা ছড়াতাম, যখন টিউশনির টাকায় তোমার জন্য প্রতিদিন একটি করে গোলাপ কিনতাম, সেই সময়ে, যখন আমরা নগ্ন পা ভেজাতাম ভোরের দুর্বায়, আমাদের দু'টি মন পাখি হয়ে যেতো, যুগল পা'কে পাখনা মনে হতো, তারও অনেক আগে, তোমাকে যখন জানতাম না, তখন অনন্যাকে জানতাম, তখন অনন্যা পরীর চে' সুন্দর কিনা, এ- বিষয়ক তুমুল বিতর্ক জমতো আমাদের বেকার আড্ডায়, তখন, আমাদের বন্ধুদের কার হৃদয়ের কতো ইঞ্চি বিস্তৃত জায়গার কতোখানিতে অনন্যার জন্য বিশেষ বরাদ্ধ ছিল সেই হিসেব না কষেও বলা যায়, আলতা রাঙ্গা লাল পায়, লাল শাড়ি আর লাল জামায় আবৃত্ত অনন্যা যখন অবিরাম ক্রন্দনে চোখ লাল করে কোন সুদূরে চলে গেল, আমাদের বিদগ্ধ হৃদয় সেদিন আমাদেরকে 'নিঃস্ব' হয়ে যাবার খবর দিয়ে গেল !
এইসব অম্ল-মধুর স্মৃতির রোমন্থনে এখন যখন দূরের এক ঝাপটা হাওয়া এসে তোমার দেহ-মনে উদাস রঙ্গের প্রলেপ দিয়ে যায়, যখন দোল কেদারার দোল থেমে যায়, ভীষণ শ্রান্ত মানুষের মতো খুব ধীরে তুমি গ্রিলের ধারে উঠে এলে, লোহার গ্রিল তোমার কপোল ছুঁয়ে দেয়, তখন যখন বারান্ধার কাছাকাছি হাসনাহেনা গাছেরা পরম যত্নে হাসনাহেনাদের ফুটাতে থাকে, সেই সৌরভ বয়ে এনে বাতাস তোমাতে মাখায়, চোখ মুদে তুমি নিঃশ্বাসে ভরে নাও বিশুদ্ধ সৌরভ, তখন তোমার মনে হয়, ঘাঁড়ের 'পরে চিরচেনা পরিচিত নিঃশ্বাস, তখন তুমি চমকে ওঠলে, হুট করে নাগরিক বিদ্যুৎ পতন ঘটায়, অন্ধকার বারান্ধা গাঢ় অন্ধকার হয়, ভেতরের ঘর থেকে আসে মেয়ের কান্না স্বর- 'মামণি; ভয় করে !'
যে শহরে আমি নেই আমি থাকবোনা সে শহরে জনহীন কোন
পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে
একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি...
তোমার ঘুমের ঘোরে মধ্যরাতের ডাক পিয়নে ডাক দিয়ে গেলে, তুমি নিয়ম করে প্রতি রাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখো, যখন সুন্দরপুরের মজা পুকুর পারের প্রাচীন অশ্বথ গাছে জেগে ওঠে পেঁচার উৎসব, যখন চোয়ালের মাংস হারা কুলসুম বেগমের গায়ে পড়ে রমিজ মিয়ার হাত, সারাদিনের 'বান্ধি' সম্বোধনে ডাকার লজ্জার কথা ভুলে যাবার মতো নির্লজ্জ হতে যখন রমিজ মিয়ার বাঁধা থাকেনা কোন, তখন গাঁয়ের সিধেল চোর, প্রকাশ 'মুকিত চোরা' সর্বাঙ্গে তৈল মেখে চৌর্য কর্মের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করলে, তার বউ হাত চেপে ধরে বলে,-
'আইজ যায়েন না !'
'চোপ ! একদম কথা না !' জবাব পায় মুকিতের বউ ।
তখন তুমি স্বপ্নে দেখো একটি কূপ, গভীর কূপ, নিকষ কালো জল-টলমল, কূপের জল শব্দ তোলে ছলাৎছল, তখন তুমি অনেকখানি ঝুঁকে পড়ে জল ছুঁতে গেলে, টুপ করে গভীর কূপে হারিয়ে যায় তোমার গা থেকে খসে পড়া প্রিয় অলঙ্কার, তোমার প্রিয়- নাকফুল !
তখন, ছটফট করতে করতে তোমার ঘুম ভাঙ্গলে, বাম পাশ ফিরে শুতে গেলে তোমার খেয়াল হয়,- তোমার বামপাশটা খালি হয়ে গেছে বহুদিন ! তোমার বাম হাতে মাথা রেখে শিশুর সারল্যে ঘুমুতো যে লোক, সফেদ কফিন তাকে নিয়ে গেছে গোরস্থান ! তখন তোমার বুকের ভিতর হু হু শূণ্যতা জাগলে, তুমি ডান পাশ ফিরে শোও, আমাদের আম্মুটাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে নেবার মতো নিবিড় করে বুকে জড়িয়ে নাও, ওর ঘুমন্ত চোখে, মুখে নরম নরম আদর খাও, তখন যখন, মেয়েটার মুখ চেয়ে চেয়ে দেখো তুমি, দেখতেই থাকো, তোমার কোন অভিযোগ থাকেনা, বরং ভালোই লাগে যে, মেয়ের মুখটা দেখতে অবিকল তার বাবার মতো !
খেতে বসে রোজ মেয়েটা বায়না করে;-
- মামণি ! বাপি আসবেনা ?
- আসবেতো !
- আমি বাপির হাতে খাবো !
- এখন আমার হাতে খেয়ে নাও, বাপি এলে পরে তার হাতে খেও !
- মামণি ! বাপি কবে আসবে ?
- তুমি আরেকটু বড়ো হও, তখন !
- আমি কবে বড়ো হবো, মামণি !
- তুমি ঠিকঠাক মতন খেলে, বেশী বেশী খেলে দ্রুত বড়ো হবে !-
- আচ্ছা, আমি বেশী বেশী খাবো ! বাপি আসবেতো ?
- আসবে !
বলতে বলতে তোমার চোখ জ্বালা করে ওঠলে, যখন তুমি মেয়ের কাছ থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরাও, তখন তোমার কানে কানে ফিসফিস করে আমি বলতে চাই,-
মৌমিতার আম্মু !; খুব জোছনা হলে, তোমরা মা-মেয়ে যখন ছাদে যাও, আকাশ দ্যাখো, তারা গুনো, আমাকেও সঙ্গে নিও; আমিও সঙ্গে আছি জেনো ! অঝর ধারায় বৃষ্টি নামলে মৌমির একটা হাত তুমি ধরো, অন্যটা আমি, আমরা তিনজন বৃষ্টিতে ভিজবো, আমরা তিনজন সুখে কাঁদবো, কেমন ?'
* * * * * * * *
উৎসর্গ : ছেলেটি কি হবার স্বপ্ন দেখতেন মা; মা বেঁচে থাকলে জানা যেতো ! জানা যায়নি, সেই সৌভাগ্য হয়নি, মা যখন চলে গেলেন কিশোর ছেলের তখন স্বপ্ন বুঝবার বয়স হয়নি । লেখা দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেবার একটা স্বপ্ন ছেলেটির গোপন কুঠুরিতে আশ্রিত আছে, যদিও সামর্থ নাই তার ! আজ ১৭ আগষ্ট, মায়ের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ! 'মা! মাগো ! তোমায় বড়ো মনে পড়ো গো, মা !