এক.
তিন তিনবার খুন করার চেষ্টা করেছি......এক জনকেই তিনবার! তিনবার এ্যটেম্পট নিয়েছি আমি..... কিন্তু তিনবারই শালা জানে বেঁচে গেছে!
যে কষ্টটা আমি কখনও ভুলতে পারিনা.... যে কষ্টটা আমার গোটা পরিবারকে এখনও কাঁদিয়ে বেড়ায়, যেটা নিয়ে আমি কখনও নিজের সাথে কমপ্রোমাইজ করতে পারিনা.... সেই কষ্টটাই আমাকে খুন করতে তাড়িত করে... প্রতিশোধ নিতে আমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে! বুবুর সেই চিৎকার আমি ভুলতে পারিনা। আমি, সেই সময়ের অসহায় এত্তটুকুন একটা ছেলে, চিৎকার করে কেঁদেছি...বাঁচাও বাঁচাও বলে পাড়া-পরশীদের ডেকেছি... কেউ আসেনি! একাত্তরের সেই রাতে..... দরজা ভেঙ্গে আমাদের বাড়ীতে ঢোকে আলবদরের দল..... অস্ত্রের মুখে আলবদর ফরহাদ আমার বড় বোনকে তুলে নিয়ে যায়! বুবুর কথা মনে করে আজও আমার বৃদ্ধা মা বাকরুদ্ধ হয়ে যান.... মুখ লুকিয়ে আঁচলে চোখ মোছেন! মায়ের চোখের পানি দেখতে দেখতেই আমি একসময় বড় হয়েছি.... বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য ক্ষ্যাপা যুবক হয়েছি!
দুই.
১৯৮২ সালের কথা। এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। সেদিন ছিল শেষ পরীক্ষা.... ম্যাথমেটিক্স! আমি গভর্মেন্ট কলেজের ছাত্র.... নিজের কলেজেই পরীক্ষা কেন্দ্র। ফরহাদ তখন ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক। গেস্ট টিচার হিসেবে আমার রুমে গার্ড পরেছে ফরহাদের। ফরহাদকে আমরা 'ফরু' বলে ডাকতাম। শালাকে দেখেই আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল... বুঝলাম আজ আমার পরীক্ষায় কনসেনট্রেট করা কঠিন হবে। তবুও বারবার নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম.... ভালোয় ভালোয় শেষ পরীক্ষাটা শেষ করবার জন্য মাইন্ড সেট করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ফরু তা হতে দিলনা!
পরীক্ষার হলে রাউন্ড দিতে দিতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো ফরু...আমার খাতা টেনে নিয়ে উল্টে-পাল্টে চেক করলো কোন নকল আছে কিনা! আমি আবার পরীক্ষায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না.... পরীক্ষার দেড় ঘন্টার মধ্যে সে একই কাজ করলো তিনবার। প্রতিবারই আমার খাতা টেনে নিয়ে পাতার ভাঁজে ভাঁজে কিছু খুঁজতে লাগলো...একবার, দুইবার, তিনবার! তৃতীয়বার আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলামনা.... দাঁড়িয়েই খপ করে চেপে ধরলাম ফরু'র কলার। টানতে টানতে নিয়ে এলাম দোতলার বারান্দায়। আমাকে সামাল দেবার জন্য বন্ধু দিলু নিজের খাতা উল্টিয়ে রেখে দৌড়ে এলো আমার পিছে পিছে। দিলুর পকেটে তখন সবসময় খুর থাকতো। দিলু কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর পকেট থেকে খুরটা বের করে ফরু'র পেটে দিলাম আঁড়াআড়ি এক লম্বা পোঁচ! ফরু পেট ধরে বসে পরার আগেই ওর পায়ের উপরাংশে (থাই-এ) দিলাম আরও দু'টা পোঁচ! আমার জানা ছিল... না মরলেও থাই-এ পোঁচ দিলে ভুগবে অনেকদিন... থাই-এ কখনও সেলাই হয়না, সেলাই দিলেও টেকেনা! শেষ পরীক্ষাটা আর শেষ করা হলোনা আমার.... দোতালার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে সটকে পরলাম কলেজ ক্যাম্পাস থেকে।
ফরু তিনমাস হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও জানে বেঁচে গেল। স্থানীয় রাজনীতির বিশেষ সমীকরণের কারনে আমার বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পায়নি জামাত। আমি এ্যপিয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে এ্যপ্লাই করে এয়ারফোর্সে জিডি পাইলট হিসেবে চান্স পেয়ে গেলাম... বিএমএ কোর্স করতে চলে এলাম চট্টগ্রাম। যদিও আমার আর জিডি পাইলট হওয়া হয়নি.... আমি সেবার এইচএসসি পাশই করতে পারিনি... ম্যাথে ফেল!
তিন.
দ্বিতীয় সুযোগটা পেয়েছিলাম আমার পাড়াতেই... দুই বছর পর। পাড়ার মোড়ে আড্ডা মারছি... টুটুল ভাই, বেলাল আর আমি। টুটুল ভাই তখন আমাদের সংগঠনের কলেজ শাখার প্রেসিডেন্ট, আমি সেক্রেটারী। শিবিরের সঙ্গে আমাদের তখন একটা উত্তেজনা চলছিল। শিবিরের ছেলেরা আমাদের সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজিম ভাইকে রাস্তায় একলা পেয়ে পিটিয়েছে। আমরা তখনও খবর পাইনি। তখন-তো আর মোবাইল-এর যুগ ছিলনা! কিন্তু শিবিরের ছেলেরা হিসেবে একটু ভুল করে ফেলেছে। ওরা ভেবেছে আমরা নিশ্চয়ই এরইমধ্যে শিবির পেটাতে বের হয়েছি। শিবিরের ছেলেরা মেইন রোড এ্যভয়েড করে পাড়ার ভিতর দিয়ে ভিতর দিয়ে কলেজ হোস্টেলের দিকে ফিরছে...হোস্টেলে ওদের অবস্থান ভাল। আমাদের পাড়ার মোড়ে এসেই ওরা থতমত খেয়ে গেছে! ওরা চারজন... শিবিরের প্রেসিডেন্ট আলমগীর, আরও দুইজন শিবির কর্মী আর তাদের সাথে জামাতের রুকন ফরহাদ।
টুটুল ভাই আলমগীর-কে ডাক দেয়..''এই শিবিরেরর বাচ্চা.... এদিকে আয়!'' ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আলমগীর...'' টুটুল ভাই, আপনি সিনিয়র লোক, এভাবে কথা বলা ঠিক হচ্ছেনা''। টুটুল ভাই কিছু একটা পাল্টা জবাব দিতে যাচ্ছিল.... কিন্তু আলমগীর আচমকা পকেট থেকে ইকোনা বলপেনটা বের করে খাপ খুলেই সাঁই করে সজোড়ে খাড়া মেরে দিল টুটুল ভাইয়ের ফেস বরাবর! তড়িৎ মুখটা বামদিকে সরিয়ে ডান হাত দিয়ে ঠেকাল টুটুল ভাই... চোখটা বাঁচলো বটে, কিন্তু হাতের তালুতে হাফ ইঞ্চি গেঁথে গেল বলপেনটা! ঘটনার আকস্মিকতায় আমরাও বিস্মিত! আর যাই করুক... আমাদের পাড়ায় এসে কিছু করার সাহস পাবার কথা নয় শিবিরের! রক্ত গরম হয়ে গেল আমাদের। বেলাল ছুটলো হকিস্টিক, কিরিচ, পাইপগান.. যা'হোক কিছু একটা নিয়ে আসতে। আমি আর টুটুল ভাই দোকানের দুইটা ঝাঁপের লাঠি (সরু বাঁশ) খুলে পেটাতে লাগলাম ওদের চারজনকে। আলমগীর আর অন্য দুইজন দৌড় দিলেও ফরুকে ধরে বসলাম আমি। মাটিতে ফেলে আচ্ছামত পেটাতে লাগলাম ফরুকে। আমার তখন হুঁস নাই! ''বাবাগো মাগো' বলে ফরু রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে...আর আমি বাঁশ দিয়ে শুধু ফরুর মাথা টার্গেট করে আঘাত করে যাচ্ছি... মাইরের উপর মাইর, উপর্যুপরি মাইর শুধু মাথায়....ফরুর নাক-মুখ আর মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। এক পর্যায়ে টুটুল ভাই আর চায়ের দোকানদার শফি চাচা আমাকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো... তখন আমাকে ঠেকিয়ে রাখা দায়! কিন্তু বেলাল হকিস্টিক নিয়ে আসার আগেই কোত্থেকে পুলিশের ভ্যান এসে হাজির। হকিস্টিক হাতে না পাওয়ায় যদিও কনফার্ম করতে পারিনি... তারপরও মাথায় এত আঘাত খেয়ে কোন মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়! কিন্তু মুখমন্ডল ও মাথায় বত্রিশটি সেলাই নিয়েও সে যাত্রায়ও জানে বেঁচে যায় ফরু!
চার.
তৃতীয় সুযোগটা আসে কলেজ মাঠে শিবিরের এক অনুষ্ঠানে। ছাত্র শিবিরের নবীনবরণ অনুষ্ঠান। আমরা ঠিক করলাম এ অনুষ্ঠান হতে দেবনা। অনুষ্ঠান সবে শুরু হয়েছে। শিবির আর জামাত নেতারা মঞ্চে উপবিষ্ঠ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সশস্ত্র ছয়জন যেন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়ে আচমকা মঞ্চে উঠে পরলাম। মুকুল ভাই ধামাধাম চার-পাঁচটা ককটেল চার্জ করলো মঞ্চের সামনের ফাঁকা জায়গাটায়। মঞ্চের সামনে ছিল নবীনবরণে আসা নতুন ছাত্ররা। ককটেলের আওয়াজে যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। শিবিরের প্রিপারেশন থাকলেও ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা ডিফেন্স করার আগেই মঞ্চে এবং মঞ্চের সামনে সর্বত্র হুটোপাটা শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে উপবিষ্ঠ ফরু নিজেকে সেফ করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি ফরুর বুক তাক করে পাইপগান থেকে গুলি চালালাম... নিশ্চিত হওয়ার জন্য একদম কাছ থেকে, মাত্র দুইহাত ব্যবধান থেকে ছুড়লাম গুলিটা!
পাইপগান সম্পর্কে যাদের ধারনা নেই... তাঁদের বোঝার সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো.... পাইপগান হচ্ছে দেশী কারিগরের হাতে তৈরী বিশেষ এক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, যেটা চালাতে হলে পাইপের মত অস্ত্রটা এক হাতে ধরে অন্যহাতে ধনুকের ছিলার মত ট্রিগারটা বেশ খানিকটা টেনে এনে ছেড়ে দিতে হয়। খুব সঙ্গত কারনেই একদম কাছের লক্ষ্যবস্তু ছাড়া পাইপগান দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার কপাল মন্দ.... ট্রিগারটা টেনে ছাড়ার মুহূর্তে মঞ্চের হুরোহুরির মধ্যে কেউ একজন আমার সাথে ধাক্কা খেল। বিকট শব্দে ফুটলো গুলিটা.... কিন্তু লাগলো গিয়ে ফরুর উরুতে। পায়ের এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে নিচের দিকে বেরিয়ে গেল গুলিটা। আরও একবার ফায়ারের জন্য দ্বিতীয় গুলিটা ভরতে যাচ্ছি আমি... এমন সময় টুটুল ভাই এক হ্যাঁচকা টানে আমাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে বললেন...''দৌড়া''। টুটুল ভাই জানেন... ফরু'কে সামনে পেলে আমার মাথায় রক্ত চেপে যায়, ওদিকে শিবিরের ক্যাডাররা ততক্ষণে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে! থার্ড এ্যটেম্পটেও বেঁচে গেল ফরহাদ!
পাঁচ.
আমার হাত থেকে তিন তিনবার বেঁচে যাওয়া সেই ফরহাদ এখন জামায়াতের জেলা আমীর। জীবনের প্রয়েজনে আমি এখন ঢাকায়। বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছি... বাবা হয়েছি। এখন চাইলেও আগের সেই আগুনঝড়া দিনগুলিতে ফিরে যেতে পারিনা। নস্টালজিয়া এই মন কখনও কখনও রাতের আকাশপানে উদাস চেয়ে রয়। নিকষ আঁধার শেষে এক উজ্জ্বল ভোর দেখার প্রত্যাশায় থাকে এই আশাবাদী মন.... একাত্তরের সেই কুলঙ্গারগুলার শাস্তি দেখে যেতে বড্ড সাধ হয়!
(ক্রেডিট লাইনঃ আমার বড় ভাই কাম বন্ধু.... সুহৃদ বাবু ভাইয়ের একান্ত কিছু কথা শেয়ার করলাম এখানে। উনি এক জেলা শহরের একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ। জমিয়ে গল্প বলেন তিনি। আমরা যখন আড্ডা দেই... বাবু ভাই-ই আড্ডার মধ্যমনি। আড্ডায় বলা উনার জীবনের কাহিনী নিয়ে এই পোস্ট। উনার অনুমতি নিয়েই .... উনার জবানীতেই।)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২০ দুপুর ২:১৫