১,
প্রকান্ড এই তিনতলা বাড়ীটার তিনতলায় একদম পশ্চিম কোনার কামরাটা আমার।এতদিন আমার আর মায়ের জন্য এই একটি কামরা’ই বরাদ্দ ছিলো।কিছুদিন হল মা দোতলায় দাদীজানের পাশের কামরায় স্থানান্তরিত হয়েছে।ইদানীং দাদীজানের বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে,মাঝে মাঝে রাতের বেলায় মালিশ করে দিতে হয় আর তাছাড়া স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আমিও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।দাদীজানের মতে এতদিনে আমার একান্ত নিজের একটি কামরা পাওয়ার যোগ্যতা হয়েছে।বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমি ও মা এ বাড়ীতে অনেকটা আশ্রিতার মতই বসবাস করছি।বাবা-মায়ের বিয়ের সাত মাসের মাথায় বাবা মারা যায়,তখন আমি মায়ের গর্ভে।আমার কথা ভেবেই দাদীজানের শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা সত্ত্বেও মা এ বাড়ী ছাড়তে পারলেন না।সেই থেকে একরকম আশ্রিতার মতই আছি আমরা।দাদীজান নাটাই নিয়ে বসে আছেন,যেমন ইচ্ছা ঘুরাচ্ছেন।
আমি,মা,দাদীজান আর দুজন চাকর ছাড়াও এ বাড়িতে আরো একজন থাকেন,ছোট চাচা।আমার এই বিশ বছরের জীবনে আমি ছোট চাচাকে খুব কমই দেখেছি।নিজের কামরা থেকে একদমই বের হননা,কারো সাথে খুব একটা কথাও বলেননা।সংসারে মন নেই বলে বিয়েও করেননি এখনো।সারাদিন একা একা ঘরে বসে থাকেন আর কি সব লেখালেখি করেন।ছোট চাচার আরো একতা গুন আছে,উনি বেশ সুন্দর গান গাইতে জানেন।আমি আর মা যখন একসাথে থাকতাম,রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছোট চাচার গান শুনতাম।মা আমার চুলে বিলি কেটে দিত।হঠাত হঠাত মায়ের চোখ থেকে তপ্ত অশ্রুজল আমার মুখের উপর এসে পড়তো,মায়ের বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত।নির্জন রাত্রির দ্বিপ্রহরের নিঃসীম নিস্তব্ধতায় মায়ের চোখের এই অশ্রু আমাকে অস্থির করে তুলতো।আমি ভেবে ভেবে আকুল হতাম কেন মা ছোট চাচার গান শুনে এত কাঁদে? কিসের ঝড় মায়ের বুকে উথাল পাতাল ঢেউ তুলে?এই প্রশ্ন আমি নিজেকে বহুবার করেছি,কিন্তু এর কোন উত্তর আমি পাইনি,মায়ের সেই কান্নার মানে আমি কোনদিনই বুঝতে পারিনি।
আমার কলেজ গন্ডি পার হবার পর থেকেই দাদীজান আমার বিয়ের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন।আমার এই মতিগতিহীন জীবনকে বিয়ে নামক এক শৃংখলে বেঁধে দিতে পারলেই যেন তিনি বাঁচেন!একদিন আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা।হঠাত করেই তার আগেরদিন দাদীজান ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়েন।আর মা’তো কখনো বাড়ীর বাইরে যাননা,এখন এতসব আয়োজন,বাজার-সদাই,অতিথি আপ্যায়ন কে দেখবে??দাদীজান ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
মা বললো-রাশেদ কে(ছোট চাচা) বললে হয়না?
দাদীজান জবাব দিলেন-ও আবার এসব করা শুরু করলো কবে থেকে?এতবছর এ বাড়িতে আছো,দেখেছো কখনো??
মা একমূহুর্ত অপেক্ষা করলেন,তারপর বাজারের লিস্টিটা হাতে নিয়ে ছোট চাচার বন্ধ দুয়ারের দিকে এগিয়ে গেলেন।কিছুক্ষন পর প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলার পর ছোটচাচা মা’কে দেখে চুপ হয়ে গেলেন।মা লিস্টিটা চাচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-বাজার চিনেন তো??
আশ্চর্যের ব্যাপার ছোট চাচা সাথে সাথেই কাপড় পালটে বাজারে ছুটলেন।শুধু তাই নয় সেদিনকার সমস্ত আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন সবকিছু তিনি নিজে নিজেই করলেন,এবং খুশী মনেই করলেন।আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম।বেশী অবাক হল দাদীজান।
২,
ক্লাশ শেষে বাড়ী ফিরছি।এতক্ষন বেশ বৃষ্টি ছিলো।এখন কিছুটা কমেছে।বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।আবহাওয়াটা বেশ ভালো লাগছিলো,বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ কেমন যেন একটা মাদকতা সৃষ্টি করছিলো মনে।বাসে উঠতে যাব এমন সময় আমার হাতে কিসের যেন টান অনুভব করলাম।কাদার মধ্যে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম।পিছন ফিরে দেখি মামুন দাড়িয়ে।আমি অবাক হয়ে গেলাম।অনেকদিন দেখা হয়না মামুনের সাথে।যদিও ও আমার বয়সে একটু বড় হবে,ছেলেবেলাটা আমাদের একসাথেই কেটেছে।ভীষন দুষ্ট ছিলো মামুন,একটু বেপরোয়া,হয়তো নিষ্ঠুরও!আমাদের বাড়ীর পেছনের হিজল গাছটায় দুটো পাখির বাসা ছিলো।একদিন মামুন সেই পাখি দুটো নামিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে হা হা করে এমন কুতসিত ভাবে হাসছিলো যে আমার মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে!সেই থেকে ওকে একটু এড়িয়ে চলতাম।আজ এতদিনপর ওকে দেখে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আগের মামুন আর এখনের মামুনের মধ্যে অনেক পার্থক্য।একদম স্যুট টাই পড়া ভদ্রছেলে।
মামুন জানালো ওর চাকরি হয়েছে।আগামী সপ্তাহে অন্য জায়গায় বদলী হয়ে যাচ্ছে।
ওর কথায় কেমন একটা ভারিক্কি ভাব!কেমন যেন মায়া লাগলো আমার।মামুন ভালো হোক আর মন্দই হোক ও আমার ছোটবেলার সাথী,ওর একটা স্থান আছে আমার জীবনে। কিন্তু জানিনা সে’ই কেন একদিন আমার জীবন থেকে নিঃশব্দে দূরে সরে দাড়িয়েছিলো।হঠাত করেই মামুন বললো,তুমি যাবে আমার সাথে তৃষা?
আমি হকচকিয়ে গেলাম-কোথায়?
কিছুক্ষন চুপ থেকে মামুন বললো, আপাতত একটা সিনেমা দেখে আসি চল।ভালো সিনেমা চলছে।তারপর নাহয় চা কফি খাওয়া যাবে।অনেকদিন হয়তো আর দেখা হবেনা তোমার সাথে।
মামুনের কন্ঠে কেমন যেন একটা আকুলতা।আমি না করতে পারলাম না।
সিনেমা দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো।দাদীজানের শরীরটা বেশী ভালোনা।খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে।নীচতলার সিড়ির পাশেই ছোটচাচার কামরা।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় ছোট চাচার রুমে নারীকন্ঠের আওয়াজ শুন্তে পেয়ে থমকে দাড়ালাম।উঁকি দিয়ে দেখি মা।আমার মাথাটা ঝিম ধরে গেলো।এতরাতে ছোটচাচার ঘরে মা কি করছে!
সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুধু শুনলাম,মা বলছে, এ আর সম্ভব নয় রাশেদ,অনেক দেরী হয়ে গেছে। এ অন্যায়।
চাচা বললেন-আর তুমি?তুমি যে ভাইজানের ছয়মাসের সংসারের স্মৃতিতে মাতাল হয়ে এই জেলখানায় নিজেকে বন্দী করে রেখেছো এ অন্যায় নয়??পতিভক্তির জালে নিজেকে আবদ্ধ করে বিশটি বছর নষ্ট করেছো এ অন্যায় নয়??
মা’র উত্তরটা আমি আর শুনতে পেলাম না।রুমে এসে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে রেলিং ধরে অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষন।দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার,বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছে! আমি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
৩,
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম আজ।আস্তে আস্তে মায়ের কামরায় গিয়ে উঁকি মারলাম।বিছানায় একপাশ
হয়ে শুয়ে আছে মা,আর শাড়ী্র আঁচলটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।আমি আলতো করে মায়ের কপালে হাত রাখলাম।মা কোন কথা বললোনা,তেমনি পাশ ফিরে রইলো।আমি মায়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম, আর অনুভব করলাম আবেগের বাষ্পোচ্ছাসে মায়ের শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে,যেনো গোটা শরীরটাই খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়বে।আমি কিছুক্ষন বসে থেকে উঠে চলে এলাম।মা কাঁদুক,প্রান ভরে কাঁদুক।
রুমে এসে মামুনকে ফোন দিলাম,কতক্ষন আবোল তাবোল কি বললাম জানিনা।ফোন রেখে দরজা বন্ধ করে আবারো ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম ভাঙলো সে বিকেলে।আশ্চর্য কেউ আমাকে খেতেও ডাকলোনা! সারাদিন ঘর থেকে বের হলাম না,সন্ধ্যায় বারান্দায় একাকী বসে রইলাম কিছুক্ষন। হঠাত করেই দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলো,বৃষ্টি হবে বোধহয়।আমি দরজা বন্ধ করার জন্য সিড়ির দিকে ছুটে এলাম,রেলিং আর পাশে আসতেই দেখলাম ছোটচাচা বাইরে দাঁড়িয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজছে,দোতলায় মায়ের দরজাটা সামান্য ফাঁক করা।মা আর ছোটচাচার মধ্যে মাত্র কয়েকশ গজের দুরত্ব,যা এই দীর্ঘ ২১ বছরেও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।নীচে বৃষ্টিতে ভিজছে ছোটচাচা আর উপরে আবছা আলোয় মায়ের বিষন্ন মুখ। বৃষ্টিস্নাত রাতে এই অপার্থিব সুন্দর দৃশ্যের নীরব সাক্ষী হলাম আমি।
৫,
সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলো ভীষন শোরগোলে।তাড়াহুড়া করে নীচে নেমে দেখি সবাই ছোটচাচার দরজার সামনে ভীড় করে আছে।ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলাম ছোট চাচার মৃত নিথর দেহটা মেঝেতে পড়ে আছে।ছোট চাচা মারা গেছে এ যেন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।আশেপাশে মাকে কোথাও দেখতে পেলাম না।আশ্চর্য দাদীজানও আশেপাশে নেই।কিছুক্ষন পর দাদীজান কোথা থেকে ছুটে আস্লেন।একদম শান্ত,যেন কিছুই হয়নি।
সাবাইকে বললেন- এই তোমরা এত হাঙ্গামা করছো কেন?এবার চুপ কর।মানুষ কি চিরকাল বেঁচে থাকে?
আমি যারপরনাই অবাক হলাম,যে দাদীজান তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা নিয়ে পুরো বাড়ী মাথায় তুলে ফেলে,যে আমার মা’কে সমস্ত অঘটনের মূল বলে মনে করে সে আজ নিশ্চুপ! একঁফোটা জল নেই তার চোখে!
আমি ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে মায়ের কামরার দিকে গেলাম।বারান্দার এক কোনায় পা ছড়িয়ে বসে আছে মা।তার খোলাচুল বাতাসে উড়ছে,ভোরের সোনালী সূর্যের আলো মায়ের চোখের জলের সাথে মিশে চিকচিক করছে।এ এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য!মাকে ঠিক যেন দেবীর মত লাগছিলো।
আমি ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম।একসময় গেট পার হয়ে বাইরে চলে এলাম। কারো চিৎকার চেঁচামেচি আর আমার কানে আসছেনা।শুধু দূর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা এক পাখির ডাক ই শুনতে পাচ্ছি।
ষ্টেশনের ওয়েটিং রুমে বিষন্ন মুখে মামুন বসে আছে।চারিদিকে মানুষের হট্টগোল।কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ী ছেড়ে দিবে।আমি কাছে এসে আলতো করে মামুনের হাতে হাত রাখলাম।ও চমকে তাকালো আমার দিকে।
-আরে তুমি এখানে?
-হ্যাঁ আমি,আমাকে সাথে নেবে না?
মামুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলোপ আমার দিকে।বিস্ময় যেন ঠিকরে পড়ছে ওর দুচোখ দিয়ে!
-সত্যিই তুমি যাবে আমার সাথে?
আমি কিচুক্ষন চুপ করে রইলাম।সেই পাখির ডাকটা মনে হয় এখনো শুনতে পাচ্ছি।তারপর অল্প হেসে বললাম
-যাও, আমার জন্য আরো একটা টিকিট করে আনো।