আগেরটুকু এইখানে...
Click This Link
‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র জয়গুনঃ
আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী।এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়গুন।এই উপন্যাসের পটভূমি পঞ্চাশের মনন্তরে হোচট খাওয়া বাংলাদেশের চিত্র।সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ তার মধ্যে রক্তচক্ষু বের করা কতিপয় মানুষ নামের চারপায়া জানোয়ার, দিনের পর দিন বছর শতাব্দী যাবৎ ধর্মীয় ভন্ডামীতে আবদ্ধ করে রেখেছে সবাইকে।সুবিধাভোগী-শাসক সমাজপতিরা যে কেবল আর্থিক উৎপীড়ন করে শুধু তাই নয়, গ্রামের সাধারণ অর্থাৎ অজ্ঞ-অশিক্ষিত মানুষদের কুসংস্কার-অজ্ঞতা-গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থের জাল আরো ব্যাপক আকার বিস্তার করে।সমাজের ঐসব ভন্ড লোকদের কারনে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হয়েও উঠে দাঁড়ায় জয়গুন।ফিরে আসে অকল্যানের বাড়ী ‘সুর্য দীঘল বাড়ীতে’।সবারই বিশ্বাস বাড়িটি ভূতের বাড়ি।জয়গুনকে ভয় দেখিয়ে বাড়ী থেকে তাড়ানোর জন্য সমাজের মানুষ উঠে পরে লাগে।সংকটে পড়ে যায় জয়গুন,আর তাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করে ফকির জোবেদালি।কিন্তু ধান্ধাবাজ জোবেদালি এর বিনিময়ে জয়গুনের শরীরে হাত দিতে চায়,জয়গুনের হাতের পান খিলি চায়।এভাবে তার চাওয়াগুলো দিনের পর দিন হিংস্র হতে থাকে।জয়গুন তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করায় সে বিভিন্ন ভাবে চক্রান্তের জাল বুনে জয়গুনকে ফাসাতে চায়।এই সব কিছুর মধ্যেই জয়গুন নীরবে সংগ্রাম করে চলে।
অপরদিকে জয়গুনের স্বামী বকশ যে বিনা কারনে একদিন জয়গুনকে তালাক দিয়েছিলো সেই আবার জয়গুনকে ফিরে পেতে চায়।কিন্তু জয়গুন তাতে সায় দেয়নি, নতুনভাবে আর সে সমাজের বাঁধনে নিজেকে বাঁধতে চায়নি।জয়গুনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকে। রাত্রি নামতে না নামতেই ঘরের বেড়া ও চালের ওপর ঢিল পড়তে শুরু হয়, সবাই বলে ভূতের কাজ, সবশেষে দেখা যায় ছায়ামূর্তিগুলো ঢিল ছুড়ছে, বকশ চিনে ফেলে সেই ভূতটাকে এবং তারপর সূর্য দীঘল বাড়ীর তালগাছের তলায় বকশের মৃতদেহ টানটান হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সকলেই একমত হয়, সূর্য দীঘল বাড়ীর ভূতে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।, মুহূর্তে ভেঙে খান খান হয়ে যায় জয়গুনের সকল হিম্মত, ছেলেমেয়ের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে জয়গুন।সমাজের সকল বৈরীতা,অমানবীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ শিকার জয়গুন আবারো বেছে নেয় জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ। উপন্যাসের শেষের দিকে স্বামী বকশের (যাকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিলো)প্রতি জয়গুনের ভালোবাসা উছলে উঠতে দেখা যায়, বেদনায় জয়গুনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দরদর ধারায় পানি ঝরে গাল বেয়ে। স্বামীর প্রতি এই ভালোবাসায় বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ মানতেই হয়।
‘শ্রীকান্ত’র রাজলক্ষীঃ
বাংলা সাহিত্যের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি এই রাজলক্ষী চরিত্র।রাজলক্ষী সাহসী,দৃঢ় প্রত্যয়ী, দয়াময়ী,আবেগী সুন্দরী রমনী।সাকাজিক বিভিন্ন জটিলতার কারনে তাকে বাঈজীর কাজ বেছে নিতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনে প্রানে সে শুধু শ্রীকান্তেরই ছিলো।শ্রীকান্তের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা আর অভিভাবকত্ব বার বার শ্রীকান্তকে তার কাছে টেনে নিয়ে এসেছে।রাজলক্ষী সব সময় চাইতো শ্রীকান্ত তাকে বিয়ে করে এই অনৈতিক জীবন থেকে তাকে মুক্ত করুক।কিন্তু পরবর্তিতে শ্রীকান্তের জীবনে কমললতার আগমন রাজলক্ষীকে অনেকটা দূরে ঠেলে দেয়।রাজলক্ষী শ্রীকান্তকে হাসিল করতে চেয়েছিলো,একান্ত নিজের করে পেতে চেয়েছিলো,আর কমললতার দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীকান্তের অন্তরে একমাত্র সেই আছে এবং তার কাছ থেকে শ্রীকান্তকে কেউই দূরে নিতে পারবেনা।
কমললতাকে ভালোবাসা সত্বেও রাজলক্ষীর নির্ভয় নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিতেই ভালোবাসত শ্রীকান্ত।আর তাইতো রাজলক্ষীর অভিভাবকত্বের আওতায় থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রীকান্তের মনে কমললতার গোপন স্বপ্ন ছবি হয়েই রয়ে গেলো।
গর্ভধারিনীর জয়িতাঃ
জয়িতা বড়লোক বাবা মার স্বেচ্ছাচারী আধুনিক মেয়ে।জয়িতার সাথে তথাকথিত নারী বা নারীত্বের সংজ্ঞা মিলেনা।সে ছেলেদের পোশাক পড়ে, ধূমপান করে, ছেলেদের সাথেই মিশে।তাই এটা সেটা নিয়ে জয়িতার সাথে তার বাবা মার ঝামেলা লেগেই থাকে।কিন্তু এত কিছু সত্বেও জয়িতা অনেক পুরূষেরই স্বপ্নের নায়িকা।জয়িতা স্বপ্ন দেখে সমাজকে বদলে দেবার।তিন বন্ধুকে নিয়ে নেমে পড়ে যুদ্ধে,এভাবেই সে একসময় জড়িয়ে পড়ে রাজনীতির সাথে।সমাজপতিদের কৌশলের মারপ্যাঁচ,রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে পড়ে জয়িতা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়।তারপর ও থেমে থাকেনা তার যুদ্ধ।গ্রামে গিয়েও নানান জটিলতায় পরতে হয় জয়িতাকে।জীবনের সহজ সরল অংকগুলো জটিল মারপ্যাঁচে হারাতে চায় জয়িতাকে।
‘লালসালু’র জমিলাঃ
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ রচিত ‘লালসালু’ একটি বিখ্যাত কালজয়ী উপন্যাস।বেশ কয়াকটি শক্তিশালী নারী চরিত্রের প্রাধান্য পেয়েছে এই উপন্যাসে,তাদের মধ্যে জমিলা অন্যতম।জমিলা অত্যন্ত সাহসী এক নারী।মজিদ নামের প্রতিকী দ্বারা ভ্রান্ত না হয়ে, মজিদের সাথে না লেগে থেকে সে পরিবর্তন চেয়েছে।মজিদের সাধের মাজার যার মাধ্যমে সে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তার সাম্রাজ্য বিছিয়েছে,সেখানে নগ্ন পায়ে আঘাত করেছে,শত প্রতিকূলতা সত্বেও সে ঠিকই মিথ্যাকে চপেটাঘাত করেছে।জমিলা মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী।মহব্বতনগর গ্রামের অধিবাসীদের মাজারকেন্দ্রিক ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আকাঙ্ক্ষা সব নিয়ন্ত্রণ করে মজিদ।এভাবেই সমাজে নিরংকুশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে সে,ক্ষমতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে জেগে উঠে ভোগ আর কামুকতার এক অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা।তাই সে বিয়ে করে জমিলাকে। মজিদ ক্ষুধার্ত নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি। প্রতারণার আশ্রয় তার বেঁচে থাকার প্রধান কৌশল।,কিন্তু জমিলা প্রথম থেকেই স্বামী মজিদ ও তার কর্মকান্ডকে মেনে নিতে পারেনা।সেই প্রথম মজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।জমিলার থুথু নিক্ষেপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মজিদ তাকে মাজার ঘরের অন্ধকারে খুঁটিতে বেঁধে রাখে। সেই রাতেই মারা যায় জমিলা,মৃত্যুর পরও তার লাশের পা মাজারকে আঘাত করে থাকে,আর এর মাধ্যমেই প্রতিকীভাবে জমিলার প্রতিবাদী স্বভাব ফুটে উঠে।ধর্মকে পুঁজি করে যারা সমাজকে শোষন করে জমিলার মৃত্যু তাদের কপালে কলংকের চিহ্ন এঁকে দেয়।
‘হাজার বছর ধরে’র টুনিঃ
তীক্ষ্ণ মননের অধিকারী, সমাজসচেতন লেখক জহির রায়হানের কিংবদন্তিতূল্য জনপ্রিয় উপন্যাস হাজার বছর ধরে।আর এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র টুনি,অবশ্য অনেকে আম্বিয়াকেও কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।তবে আম্বিয়ার চেয়ে টুনির জীবনের উত্থান পতনকেই লেখক বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন।টুনি গ্রামের সহজ, সরল, চঞ্চল এক মেয়ে।নিরেট গরিব ঘরের মেয়ে বলেই, কিশোরী বয়সে, সুন্দর চেহারার অধিকারিনী হয়ে, ভরাট যৌবনবতী হয়ে বৃদ্ধ মকবুলের সংসারে, এক দঙ্গল সতীনের মধ্যে তাকে আসতে হল ঘর-সংসার করতে।চৌদ্দ বছরের টুনির সাথে বুড়ো মকবুল শিকদারের বিয়ের কারনে টুনির সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়।পরবর্তিতে সে তার স্বপ্নঘুড়ির সার্থক নাটাইটি খুজে পায় দেবর সমতূল্য মন্তুর কাছে।মন্তুকে ভালোবেসে ফেলে টুনি,তাকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে,যদিও তা সমাজবিরোধী।টুনি একাধারে সহজ সরল আবার প্রতিবাদীও বটে।মকবুলের অন্যান্য স্ত্রীরা তার অত্যাচার মাথা পেতে মেনে নিলেও টুনি সর্বদাই রুখে দাড়িয়েছে।মন্তুর সাথে আম্বিয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ায় টুনির মনে হিংসা ভর করে তাই সে তার স্বামী মকবুলকে আম্বিয়াকে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী করে তুলে।এরই জের ধরে মকবুল তার দুই স্ত্রীকে তালাক দেয়,পরবর্তিতে ভাইয়ের সাথে ঝগড়ার একপর্যায়ে মকবুলের মৃত্যুর পর মন্তু যখন টুনিকে বিয়ে করতে চায় টুনি গম্ভীরভাবে তা প্রত্যাখান করে।হঠাত করেই যেন টুনি বড় হয়ে যায়,স্বামীর প্রতি অন্যায়ের অন্তর্দহন তাকে পুড়িয়ে মারে।টুনির পরিণতি হয়েছে হৃদয়চিরে যাওয়ার মতো কষ্টকর। শেষ পর্যন্ত শূন্য বুকে বাপের বাড়ি ফিরে টুনি,তবুও শৃংখল ভাঙ্গেনি।
অ.টঃ বেশ বড় হয়ে গেলো।আরেকটি পর্বে শেষ করি।