১।
আজ সকাল থেকেই বকুলের মনটা বেশ ভালো।অনেকদিন পর আজ সুগন্ধী সাবান মেখে গোসল করেছে।চোখে কাজল দিয়েছে।চুলগুলোকে বিনুনী করে ফিতে বেঁধেছে।মিতালী নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছয় মাসের সংসার বকুলের।এই নারি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি শহর থেকে অনেকটা দূরে, নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত।পেছন দিকটায় বিশাল এক ফুলের বাগান।লাল নীল ফুল আর পাখিদের কূহু কাকলী গুঞ্জনে মন ভরে যায়।
বকুল দুটি জবাফুল ছিড়ে বিনুনীতে গুজে নিল।অনেকদিনপর গলা ছেরে গান গাইতে ইচ্ছে করছে ওর।আগে খুব গান করতো বকুল,গানের গলাও বেশ ভালো।ওর গানের একান্ত শ্রোতা ছিলো মামুন, মামুনের উতসাহেই গান শেখা।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা অনেক মধুর ছিলো ওর।মামুন আর বকুল দুজনে হাত ধরাধরি করে কত হেটেছে!বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই নদীর ধারে এক প্রকান্ড বটগাছ ছিলো, সেখানে বসে দুজনে বাদাম চিবিয়েছে,বকুল গান গেয়ে শুনিয়েছে আর মামুন মুগ্ধ হ য়েশুনে্ছে।দুজনে মিলে কত স্বপ্নের জাল বুনেছে!ওদের প্রেম দেখে সহপাঠিরা হিংসা করতো আর তা দেখে বকুলের বেশ মজা লাগতো।
মামুন প্রগতিশীল মনের ছেলে ছিলো,সমাজের উটকো নিয়ম নীতি ওর ভালো লাগতো না।বয়স কম ছিলো, রক্তও টগবগে।সমাজের সব জরা, জীর্নতাকে ভেঙ্গে নতুনের আলো নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখতো ও।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অসহায় ও অবহেলিতো নারীদের নিয়ে একটি সংগঠন ও করেছিলো ও। তাই নিয়ে পড়ে থাকতো সারাদিন। তাছাড়া দেশের অবস্থাও ভালো ছিলোনা, ছাত্ররা বিভিন্ন মিটিং মিছিলে ব্যাস্ত থাকতো। আর এ সবকিছুর ই অগ্রনায়ক ছিল মামুন।বকুল আর মামুনের সম্পর্কের কথা অনেক আগে থেকেই জানতো বকুলের বাবা।বিয়ের জন্য বরাবরই তিনি পীড়াপিড়ী করতেন দুজনকে।কিন্তু বকুল ই রাজী হতনা।
নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে, দেশ ও দশের জন্য কিছু না করেই কিসের আবার বিয়ে?
এভাবে দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল।২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল।পাক হানাদার বাহিনীরা এদেশের মানুষের উপর অতর্কিত আক্রমন চালালো।প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।মামুনের রক্তে আগুন জ্বলে উঠলো। এলাকার ছেলেদের সংগঠিত করে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো সে।এদিকে বকুলের বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।দেশের যা অবস্থা!!কখন কি হয়? মেয়েটার একটা গতি করে যেতে না পারলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন না।তিনি বকুলকে ডাকলেন, মামুনকেও খবর দিলেন।এখুনি বিয়ে পড়াবেন।বকুলের হাত মামুনের হাতে দিয়ে তবেই মরবেন তিনি।একান্ত অমত থাকা সত্ত্বেও বাবার মুখের দিকে চেয়ে বকুল আর মামুন বিয়েতে রাজী হল।
লাল টুকটুকে শাড়ী, হাতভর্তি চূড়ি আর মেহেদি পরে বউ সাজলো বকুল।
সেই রাতেই হানাদার বাহিনীর একদল আস্তানা গাড়লো ওদের এলাকায়।বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে,মুক্তিবাহিনীর কোন ছেলে পেলেই ধরে মেরে ফেলছে।চারিদিকে মানুষের হাহাকার, চিতকার আর গুলীর আওয়াজ ।প্রচন্ড অস্থিরতায় এদিক সেদিক পায়চারি করছে মামুন।
অবশেষে রাত ১০.৩০ মিনিটে ওদের বিয়ে সম্পন্ন হল।বিয়ে শেষ হতেই মামুন ছুটে চলল দেশকে বাচানোর আকাংখায়।নববধূর সাথে দুটো কথাও বলা হলনা।বকুলের লাজ রাঙ্গা অধরের কাঁপা কাঁপা স্পন্দন আর টানা টানা মায়াবী চোখ দুটোর গভীরতায় হারিয়ে যাওয়া হলনা।মামুনের চলে যাওয়াতে বকুলের ভীষন কস্ত হচ্ছিলো।আবার গর্বও হচ্ছিলো।দেশ মাতৃকার জন্য মামুনের এই প্রেম ই তো বকুলকে মুগ্ধ করেছিলো।ছোট বোন শীউলীর সাথে এসে শুয়ে পরলো বকুল।মামুনের ছবিটা বুকে নিয়ে গুনগুন করে গান গাইছিলো।এমন সময় দরজায় বুটের আঘাত।বকুল ভীষন ভয় পেয়ে ছোট বোনকে আকড়ে ধরে বাবাকে ডাকতে লাগলো।বকুলের বাবা মতিন সাহেব ও ভয় পেয়ে গেলেন।কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না।তিনি দরজা বন্ধ করে বকুলকে লুকিয়ে থাকতে বললেন।
একের পর এক বুটের আঘাত পড়ছে দরজায়।ওরা মামুনকে খুঁজতে এসেছে।রাজাকার বাহিনীর কাছেখবর পেয়ে গেছে মামুনের।একসময় দরজা ভেঙ্গে ফেললো ওরা।সারা ঘর তন্ন তন্ন করে মামুনকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলো, কিন্তু এমন্সময় রাজাকারদের একজন হানাদার বাহিনীর লোকটির কানে কানে কি যেন বললো।ততক্ষনাত কয়েকজন এসে বকুলকে জোর করে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে গেলো।অনেকদূর পর্যন্ত বাবার চিতকার শুনতে পেয়েছে বকুল।তারপর...
উফ!! নাহ আর মনে করতে চায়না বকুল।বিভৎস যন্ত্রনাদায়ক,ভয়ংকর সেই নয় মাসের কথা ভুলে যেতে চায় বকুল।ওর সাথে কি করেনি ওরা!ছিড়ে খুব্লে খেয়েছে বকুলকে।ওদের বিষাক্ত ছোবলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়েছে বকুল।ওর আর্তচিতকারে আকাশ বাতাস পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠেছে।মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পরেছিলো বকুল,তারপর কি ভাবে কি করে এই নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসেছে তাও মনে নেই।
২।
গত পরশুদিন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে চিঠি এসেছে মতিন সাহেবের কাছে।তার মেয়ে বকুল বেঁচে আছে।খবরটা শুনে কেন জানি তিনি খুশী হতে পারলেন না।বরং কিছুটা বিরক্ত হলেন।যাব যাব করেও গরিমসী করে দু দিন পার করে দিলেন।
কিন্তু বকুলের মার যেন তর সইছেনা।শত হলেও মায়ের মন।কতদিন মেয়েকে দেখেন না, মেয়েকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মত ছটফট করছে মনটা।বকুলের মায়ের পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত বকুলকে আনতে যেতে রাজী হলেন মতিন সাহেব।
৩।
বকুলের ভীষন ভালো লাগছে আজ।অনির্বচনীয় একটা আনন্দে মনটা ক্ষনে ক্ষনে নেচে উঠছে।আজ বাবা আসবে।কতদিন পর বাবাকে দেখবে!সকাল বেলাই নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে।একটুও দেরী করা যাবেনা।বাবার সাথে ফিরে যাবে সেই চিরপরিচিত আঙ্গিনায়।মামুনের সাথে কত কথা বলার আছে! মামুন নিশ্চয়ই তাকে অনেক খুঁজেছে!কতদিন মায়ের হাতের রান্না খায়না বকুল।মা নিশ্চয়ই আজ বকুলের পছন্দের খাবার রান্না করেছে,শিং মাছের ঝোল, কুমড়ো ফুলের বড়া, আরো কত কি!!ছোট বোনটাকেও দেখেনা অনেকদিন।শীউলী কেমন আছে কি জানি??অস্থিরতায় ঘরময় পায়চারী করতে লাগলো বকুল।এমনসময় নারীকেন্দ্রের সুপারভাইজার লতিফা আপার ডাক পড়লো...
-বকুল, ও বকুল তোর বাবা এসেছে
বাবা ডাক শুনতেই বকুলের হৃদপিন্ড যেন থেমে গেলো।দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো সে।দুনিয়া ভেঙ্গে কান্না আসছে বকুলের।হড়বড় করে কত কথা বলছে বাবার সাথে,মামুনের কথা, শীউলীর কথা, মার কথা আরো কত কি!হঠাত করেই বকুল লক্ষ্য করলো বাবা কোন কথা বলছেন না,শুধু ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেই থেমে গেলেন।নিরীহ ছাত্রের মত বকুলের কথা শুনছেন,চোখ দুটিও শুকনো।বাবার এই নিস্তব্ধতা আর উদাসীনতায় বকুল হতভম্ব হয়ে গেলো!বাবা কি তাহলে তাকে ভুলে গিয়েছিলো?
বাবার স্পর্শে সেই মমতা কেন তাহলে বকুল অনুভব করতে পারছেনা?হঠাত করেই বকুলের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠলো।
লতিফা আপাসহ অন্যান্যদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলো বকুল। পা দুটো যেন নড়ছে না,মেঝের সাথে আটকে যাচ্ছে।অজানা এক আশংকায় বকুলের বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো।লতিফা আপা অনেক বুঝালেন বকুলকে, শ্বান্তনা দিলেন, অতীতকে ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উতসাহ দিলেন।কাঁদতে কাঁদতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো বকুল।কিন্তু মনের ভিতর রয়ে গেলো অজানা এক দ্বন্দ্ব।
বাবা সারাদিন বকুলকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে রাতে বারী ফিরলেন।
৪।
আজ অনেকদিনপর পরিবারের সবার সাথে বসে তৃপ্তি নিয়ে খেল বকুল।শীউলীকে দিয়ে আগেই মামুনখবর পঠিয়েছিলো।মামুন আসলো অনেক রাতে। কেমন জানি চুপচাপ আর বিমর্ষ লাগছিলো মামুনকে।
মামুনের সাথে বারান্দায় এসে বসলো বকুল।দুজনেই চুপচাপ।মামুন কিছুই জিজ্ঞেস করছে না।কি আর করা! বকুল নিজে থেকেই বলতে লাগলো, সবকিছু। কিভাবে পাষন্ড নরপিশাচেরা ওর উপর নির্যাতন চালিয়েছে! কিভাবে ওর কুমারিত্বের পবিত্রতাকে কলংকিত করেছে ওরা।কিভাবে প্রতিনিয়ত বকুলকে লুটে খেয়েছে ওই কুকুরেরা!
-একজন নয় মামুন,বহুজন,বহুবার।জানো আমিতো মরেই যেতাম!প্রতিদিন প্রভুর কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করতাম।কিন্তু তোমার জন্য মরতে পারিনি মামুন।আমি জানি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
বলেই মামুনের উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো বকুল।মামুন কিছুই বললো না।সংগঠনের কাজ আছে বলে ব্যাস্ততার ভাণ দেখিয়ে চলে গেলো।কিন্তু মামুনের চোখে বকুলের জন্য ঘৃণা বকুলের চোখ এড়াতে পারলোনা।পরে শীউলীর কাছে শুনতে পারলো মামুনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে।ওর ই মামাতো বোন, ওর সাথে কলেজে পড়ায়।কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো বকুলের।এই মামুন কি সেই? এত বদলে গেছে।সুখে দুখে পাশে থাকার ওয়াদা এই মামুন ই করেছিলো??
মুখে বালিশ চাপা দিয়ে অনেক্ষন কাদঁলো বকুল।শেষ রাতে ঘুমুতে যাবার সময় বাবা মা’র রুমে কথাবার্তার আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো।বকুল উঁকি দিলো বাবা মা’র রুমে।বাবার উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনা যাচ্ছে...
-আমিতো ওকে ফিরিয়ে আনতে চাইনি।তোমার কান্নাকাটির জন্যই তো বাধ্য হলাম।এতদিন বকুলকে মৃত ভেবে এসেছি আম্রা।সমাজের লোকজন ও তাই জানে।কাল যখন সবাই বকুলের কথা জানবে, কি করে মুখ দেখাবো??তাছাড়া শীউলীর ও তো বিয়ে দিতে হবে।বকুলের কথা জানলে কে বিয়ে করবে ওকে??
নাহ, আর শুনতে চায়না বকুল।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে!পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে।কান্না ও আসছেনা।কেমন যেন এক শুন্যতা!বুকের ভিতর এত হাহাকার আর কখনো জমেনি বকুলের।নয় মাস বন্দী শিবিরে থাকার সময় ও নিজেকে এতটা অসহায় মনে হয়নি, আজ যতটা মনে হচ্ছে।কি করবে বকুল?
নাহ ,শীউলীর জীবনটা নষ্ট হতে দেয়া যায়না।কিছু একটা করতেই হবে।বকুল ভীষন কাঁদলো। শেষবারের মত পুরোবাড়ীটাকে একবার দেখে নিলো।জানালা দিয়ে উকি মেয়ে বাবা মা কে ও একপলক দেখে নিলো।অজানা থেকে এসেছিলো বকুল,আবার অজানার দিকেই পা বাড়ালো।হয়তো একটু বেশীই স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো সে!!!