জীবনে আপনাকে সামনাসামনি দেখেছি মাত্র দুইবার। প্রথমবার ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বইমেলায় খুব কাছ থেকে পরের বার ২০০২/০৩ সালে একুশে বই মেলায় অন্য প্রকাশের স্টলে অনেক দূর থেকে। তবে আপনার সাথে পরিচয় সেই আশির দশকে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। নন্দিত নরকে থেকে শঙ্খনীল কারাগার কিংবা তোমাদের জন্য ভালবাসা গোগ্রাসে গিলেছি সবই। যে আপনার লেখা পড়ে কিশোর থেকে পরিণত বয়সে এসেছি সে আপনাকে নিয়ে লিখতে হবে .... না, এমনটা কখনো ভাবিনি।
১৯ জুলাই রাত ৯.০০ টা থেকেই খবর আসছিল আপনার শারিরীক অবস্থার অবনতি হয়েছে। অজানা আশন্কায় মন কেঁপে উঠেছিল। তবে আপনার শারিরীক অবস্থার খবর নিয়ে লুকোচাপাও হচ্ছিল বেশ। অবশেষে ১১.৩০ টার সময় জানতে পারলাম আপনি সকল লুকোচাপার উর্দ্ধে চলে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ মাথাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। জীবনে অনেক কাছের মানুষকে হারিয়েছি তবে খুব কমই চোখের পানি ফেলেছি। কিন্তু সেদিন দূরের আপনাকে হারিয়ে মনে হচ্ছিল খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলেছি। অশ্রু কিছুতেই বাধঁ মানছিল না। আমি জানি আমার মতো আপনার হাজারো ভক্ত এভাবেই চোখের পানি ফেলেছে। আমাদের চোখের পানি কোন টিভি ক্যামরার অপেক্ষা করেনি, প্রত্যাশা করেনি কোন ফটো সাংবাদিকের ক্যামরার শাটার টেপার। আপনি আর নেই শুনেই আপনার প্রতি আমাদের ভালবাসা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়েছে।
ব্যক্তি জীবনে আপনি কী করেছেন, কী কী ভুল করেছেন এটা ভেবে আমাদের ভালবাসার কখনো ছেদ পড়েনি। আপনার লাখো ভক্ত যারা আপনার কাছে লেখা ব্যাতিত কোন কিছুই প্রত্যাশা করেনি তাদের হৃদয় চূর্ণ হয়েছে আপনার না থাকার সংবাদে। তবে আমি হতবাক হয়ে দেখেছি আপনার খুব কাছের মানুষ বলে খ্যাত কিছু লোকের কর্মকান্ড। নেত্রকোনার এক অখ্যাত শিল্পী যাকে নিজ অঞ্চলের বাইরে তেমন কেউ চিনত না। তাকে আপনি দেশব্যাপি পরিচিতি দিয়েছেন। নেত্রকোনার ভাঙ্গা ঘরের পরিবর্তে যিনি এখন ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে থাকেন। সেই তাকেই দেখলাম আপনার মৃত্যুর দিনই একটি চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠানে গান গাইতে। আপনার মৃত্যু সংবাদে যেখানে আমাদের মতো হাজারো ভক্ত বাকরুদ্ধ সে অবস্থায় আপনার তৈরি এই শিল্পী কিভাবে টিভি অনুষ্ঠানে গান গায় বোধগম্য হয়নি। শুধু তাই নয় মৃত আপনাকে বিক্রি করে ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে এ শিল্পী গান গেয়েছে পরপর চার দিন। আপনার খুব কাছের এক অভিনেতাকে দেখলাম দেশ টিভির একটি অনুষ্ঠানে আপনাকে নিয়ে রসিকতা করে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অথচ তখনও আমরা হাজারো ভক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতীক্ষা করছি আপনার দাফন কোথায় হয় এটা জানার জন্য। নুহাশ পল্লী, মিরপুর, বনানী না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কোথায় আপনার শেষ গন্তব্য এটা নিয়ে আপনার পরিবারের সদস্যদের রশি টানাটানিতে আপনার বিদেহী আত্মা যেমন কষ্ট পাচ্ছিল তেমনিভাবে রক্তাক্ত হচ্ছিল আমাদের হৃদয়। যদিও জানি আপনি অনাদিকাল বেচেঁ থাকবেন লাখো পাঠক হৃদয়ে। যেমন শরৎচন্দ্র বেচেঁ আছেন দেবদাস হয়ে জীবনানন্দ বেচেঁ আছেন বনলতা সেনে তেমনি আপনি পাঠক হৃদয়ে বেচেঁ থাকবেন হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, রুপা ইত্যাদি চরিত্রে।
কোন বিশেষজ্ঞ আপনাকে নিয়ে কোন চ্যানেলে কি বললো, কোন শিল্পী আপনাকে নিয়ে কি স্মৃতিচারণ করলো এ দিয়ে আমরা কখনো আপনাকে মূল্যায়ন করবো না। আপনি আমাদের কাছে কি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি আপনার জানাযায় শরিক হওয়ার জন্য পাট কাটা ফেলে রেখে ঢাকা ছুটে যান সুদূর মাদারীপুরের এক কৃষক। আপনার মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বুকভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নাম না জানা এক স্কুল ছাত্রী। এদের মাঝেই আপনি চিরকাল বেচেঁ থাকবেন। আপনার জন্য আমাদের বুক ভরা ভালবাসা চিরকালই জাগরুক খাকবে হে বাদশাহ নামদার।