পৃথিবী শুধু জল আর মাটি নয় , তার বাহিরেও একটি সীমানা আছে । মাটির ওপরে আকাশের নিচে মানুষ আছে , আর সেই মানুষের মন নামক এক আবেগীয় অনুভূতিময় বস্তু আছে । যা কাগজে চিত্রায়িত হয় লেখকের কলমে , শিল্পীর রংতুলির ছোঁয়ায় । মনের সেই অনুভূতির ছোঁয়া নিয়ে “ সপ্তপদী” উপন্যাস এর বেড়ে ওঠা কাহিনী লেখক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনব এক প্রচেষ্টা ।
সপ্তপদ কিংবা সাত পা একসঙ্গে পা হাঁটিলে হিন্দু শাস্ত্রমতে অবিচ্ছেদ্য বন্ধু হয় । উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণেন্দু’র উদ্দেশ্যে মন ক্ষুন্ন হয়ে কথাটি ছুঁড়ে দেয় তার বাবা , যেখানে নিজের জাত হিন্দু বাক্ষ্মণ হয়েও তার পুত্র একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের প্রেমে মজে আছে সবকিছু ভুলে । নিজের সমাজ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে থাকে কৃষ্ণেন্দু, আভিজাত্যের হাওয়া এসে লাগে তার গাঁয়ে । যে নারীর প্রেমে সে নিজেকে সমর্পণ করে ধর্ম ভুলে, সেই খ্রিস্টান রিনা ব্রাউন ভালোবাসে ক্লেটন নামের এক ইংরেজকে । কৃষ্ণেন্দু’রই যে মেডিকেল কলেজের বন্ধু । ডাক্তারি পেশায় সুখ্যাতি আসছে তার , কিন্তু রিনা ব্রাউনের জন্যে কৃষ্ণেন্দু যে ভুলে গেছে অতীত পরিবার, তার নিজের জাতকে । রিনা ব্রাউনের সাথে ক্লেটনের বিয়ের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজ খ্রিস্টান জাতের বিশুদ্ধতার জন্যে থেমে যায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিনা ব্রাউনের সাথে ইংরেজ যুবক ক্লেটনের বিয়ে ।
ক্লেটনের বিয়ের পর কৃষ্ণেন্দু রিনা ব্রাউনের বাবা মিস্টার ব্রাউনের কাছে তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মিস্টার ব্রাউন তাকে খ্রিস্টান হওয়ার শর্ত দেয় । সেই শর্তে রাজি হয়ে রিনা ব্রাউনের জন্যে সে খ্রিস্টান হলেও রিনা ব্রাউন আর তাকে গ্রহণ করেনি , ফিরিয়ে দেয় কৃষ্ণেন্দুকে । যে নিজের ধর্ম এবং ঈশ্বরকে ছেড়ে আসতে পারে , সে একদিন অন্য নারীর জন্যে আমাকেও ত্যাগ করবে এ বাক্য কৃষ্ণেন্দু’র উদ্দ্যেশে ছুঁড়ে দেয় রিনা ব্রাউন । এরপর থেকে ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টায় ছ-ফুট লম্বা হয়ত এর থেকে ইঞ্চি দুয়েক বেশি হবে এরকম লম্বাটের কালো বাঙালি কৃষ্ণেন্দু খ্রিস্টান পাদ্রী হয়ে যায় মানুষের কাছে । পাদ্রীর গেরুয়া ছোপানো পোশাকে গ্রামের মানুষের কাছে পাগলা পাদ্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে , যে নিজের ডাক্তারি সেবা দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করে বেড়ায় এবং যে কোনরকম খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করেনা ।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোকে প্রতিদিন সাইকেলে চেপে সেবা দিয়ে বেড়ায় এবং উনিশশো চুয়াল্লিশ সাল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্ভিক্ষ মহামারী আকার ধারণ করে তখন দুর্বল চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে ব্রতী হয় মানব ধর্ম পালনে। যে নারীর জন্যে ধর্ম এবং নিজের সমাজকে ত্যাগ করে কৃষ্ণেন্দু হয়ে গিয়েছিল পাদ্রী রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী , সেই কৃষ্ণেন্দু’র আর কখনো পাওয়া হয়নি রিনা ব্রাউনকে । যখন রিনা ব্রাউনের সাথে দেখা হয় কৃষ্ণেন্দুর তখন কুষ্ঠরোগীদের সেবা দিতে দিতে নিজেই একজন কুষ্ঠরোগী । আর নিজের গন্তব্য হাসাপাতালের ছোট একটা বিছানা হয়ে উঠে । মানুষের স্থান ভালোবাসা কিংবা পাওয়া না পাওয়া একজন মানুষকে অনেক বদলে দেয় ।একজন নারীর প্রেমে পরে তাকে না পেয়ে সমগ্র জীবনটাই মানবধর্ম করে কাটিয়ে দেয় , শুধুমাত্র ঈশ্বরের দেখা পাবে কবে !!!