নক্সী কাঁথায় জসীম উদ্দীন
‘সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী কাঁথার মাঠ
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ ।’
শুধু বাংলার পল্লী গাঁয়ের মানুষ নয় সাজু ও রূপাইয়ের মাধ্যমে চিরন্তন বাঙালী প্রেমের অমর প্রেম কথার সার্থক এক রূপায়ণ জসীম উদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ । ১৯২৯ সালে প্রথম সংস্করণের পর থেকেই তা জয় করে আসছে কোটি বাঙালীর হৃদয় । শুধু বাংলাদেশে নয় ‘The Field of the Em broidered Quilt’ নামে প্রশংশিত হয়েছে বিদেশেও ।
পল্লীর কবি তিনি যথার্থই ; শ্রী অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘ আমি এইটিকে আদরের চোখে দেখেছি ,কেননা এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী-জীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মত দেখা দিয়েছে’ । গ্রাম্য বালিকা সাজুর অপূর্ব রূপ কোন রূপকথার রাজকন্যার থেকে কম নয় আর রূপাইয়ের কৃষ্ণ বরণ হরণ করে কেরে নিয়েছে সৌন্দর্য পিপাসু পাঠক হৃদয় ।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,
গা খানি তার সাঙন মাসের যেমন তমাল তরু ।
এই অসাধারণ, চমৎকার উপমার সার্থক উদ্ভাসন কেবল জসীম উদ্দীনের দ্বারাই সম্ভব । এই কাব্য পড়তে পড়তে চাষিদের কালো ছেলের মায়ায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় যে কেউ । বাঙালী ঐতিহ্যের অদ্ভুত সুন্দর রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ এ । বারো মেঘের বন্দনায় গাওয়া গান আর বিয়ের জন্য দরকষাকষি আবহমান বাংলার নিখুঁত উপকরণ হিসেবেই প্রকাশিত । সাজু আর রূপাইয়ের বিরহ যেন সমগ্র বাংলার প্রেমিক প্রেমিকার আকুল ক্রন্দনে ধ্বনিত হয় । হৃদয় তোলপাড় করা ব্যাকুল সুরে কথা বলে ওঠে বাঁশিও-
বাজায় রূপাই বাঁশিটি বাজায় মনের মতন করে,
যে ব্যাথা বুকেতে ধরিতে পারেনি সে ব্যাথা বাঁশিতে ঝরে ।
রূপাই সাজুর আলাপচারিতা, চোখাচোখি, খুনসুটি, ব্যকুলতা সবকিছুই মনের গহীনে প্রবেশ করে আন্দোলন জাগাতে সচেষ্ট হয় খুব সহজে । কাব্যের ছন্দে কাহিনির বুনন যতেই এগুতে থাকে পাঠক হৃদয় মুগ্ধ দর্শকে পরিণত হতে থাকে সমান তালে । মনের গভীরে স্পর্শ করতে পারার এই সার্থকতাটুকু অর্জন করেছেন জসীম উদ্দীন । তাঁর কাব্যে হাসি, কান্না, বিরহ, বেদনার সুর বেজে উঠেছে পল্লীর পথে, মাঠে, ঘাটে-
সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথে পথে
মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে ।
এত সুখ, এত সার্থকতা থেকে বিরহের গহীন সাগরে ভেসে যাওয়া দুটি নিষ্পাপ প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার কাব্যের শেষে পাঠকের দুচোখ অশ্রু সজল করে তোলে নিমেষেই । বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ সৃষ্টি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্য মহিমায়, বানী ভঙিতে, শব্দের মাধুর্যে আজো বাংলার কোটি প্রাণ অধিকার করে আছে । আর কাঁথার ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে আছেন ছড়িয়ে আছেন প্রিয় কবি জসীম উদ্দীন ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:২৭