২য় পর্বের লিংক
৩য় পর্বের লিংক
১৯৫২ সালের ঘটনাবলী
উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার উস্কে উঠল যখন জিন্নাহ্র উত্তরসূরী গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের একটি ভাষনে উর্দুনীতিকে সমর্থন করলেন। ৩১শে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরী হলের একটি সভায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়, যার সভাপতি করা হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। এই সভায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত আরবি স্ক্রিপ্টে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারী হরতাল এবং মিছিলের সমন্বয়ে একটি স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের ডাক দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ৪ঠা ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হয় এবং আরবি স্ক্রিপ্টে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবী জানায়, বাংল ভাষার স্বীকৃতিরও দাবী জানায়। আন্দোলনের প্রস্তুতি যখন এগিয়ে চলছিল, সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে, ফলে চারজনের অধিক মানুষের একত্রিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারী
সকাল নয়টার দিকে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা অস্ত্রধারী পুলিশবেষ্টিত ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন। সকাল সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দিকে জড়ো হয় এবং পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করে। ছাত্রদেরকে সতর্ক করার জন্য পুলিশ গেটের দিকে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। ছাত্রদের একটি অংশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড়ে যায় এবং অন্যরা পুলিশের ব্যারিকেড দেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। উপাচার্য পুলিশকে গুলিবর্ষণ বন্ধ করার আহবান জানান এবং ছাত্রদেরকে ঐ এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন ত্যাগ করার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারে উত্তেজিত হয়ে ছাত্ররা পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সামনে মিলিত হয় এবং আইনপ্রণেতাদের পথ রোধ করে তাদেরকে পরিষদে অবস্থান নিতে বলে। যখন জোটবদ্ধ ছাত্রদের একটি অংশ আইন পরিষদের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করে, পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং আবদুস সালাম, রফিক উদ্দীন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার সহ আরো ছাত্র নিহত হন। এই হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা শহরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট, অফিস-আদালত, যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং হরতাল শুরু হয়। আইন পরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দীন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ ছয়জন আইনপ্রণেতা মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন তিনি যেন আহত ছাত্রদেরকে দেখতে হাসপাতালে যান এবং আইন পরিষদের সভা যেন এই শোকের প্রতীক হিসেবে স্থগিত করা হয়। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শরফুদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমেদ খন্দকার এবং মসিহ্উদ্দীন আহমেদসহ সরকারের কিছু সদস্য এই পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু নুরুল আমিন সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
২২শে ফেব্রুয়ারী
বিশৃঙ্খলা সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে , বিরাট বিরাট মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং পুলিশের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানায়। ঢাকার কার্জন হলের সামনে ৩০ হাজারেরও বেশী মানুষ জড়ো হয়। ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে পুলিশী একশনের কারণে আরো চারজনের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,কলেজ,ব্যাংক এবং রেডিও স্টেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে বয়কটে উদ্বুদ্ধ করে এবং তারাও মিছিলে অংশগ্রহণ করে। প্রতিবাদকারীরা সরকারী মালিকানাধীন দুটি পত্রিকা অফিস জুবলি প্রেস এবং মর্নিং নিউজ জ্বালিয়ে দেয়। একটি বড় শোক র্যালির উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, যখন সেটি নবাবপুর রোড দিয়ে পার হচ্ছিল। এই গুলিবর্ষণ অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, শফিউর রহমান এবং নয় বছর বয়সী বালক অহিউল্লাহ্ তাদের মধ্যে অন্যতম।
ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ
২৩শে ফেব্রুয়ারী রাতব্যাপী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের কাজে হাত দেয়। ২৪শে ফেব্রুয়ারী ভোরে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ শেষ হওয়ার পর স্তম্ভের গায়ে “শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ” লেখা হাতে লেখা একটি চিরকুট লাগানো হয়। শফিউর রহমান এর বাবার মাধ্যমে উদ্বোধনকৃত এই স্মৃতিস্তম্ভটি পুলিশ ২৬শে ফেব্রুয়ারী ধ্বংস করে। ২৫শে ফেব্রুয়ারী নারায়নগঞ্জের শিল্প শ্রমিকরা হরতাল পালন করে। এরপর ২৯শে ফেব্রুয়ারী একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, পুলিশ সেখানে বেধড়ক মারপিট করে।
সরকার সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর উপর সেন্সরশীপ প্রয়োগ করে এবং আন্দোলন চলাকালে আহত-নিহতদের সংখ্যা প্রকাশ স্থগিত করে। অধিকাংশ সরকারী সংবাদ মাধ্যম এই বিশৃঙ্খলা এবং ছাত্র অসন্তোষের জন্য হিন্দু এবং কমিউনিস্টদের দায়ী করে। আবুল বরকত এবং রফিক উদ্দীনের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। ৮ই এপ্রিলের একটি সরকারী রিপোর্ট ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার যৌক্তিকতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। ১৪ই এপ্রিল পুনরায় শুরু হলে পূর্ব বাংলার সংসদ সদস্যদের দ্বারা উথ্থাপিত ভাষা ইস্যুর কার্যক্রম মুসলিম লিগ সদস্যদের কারণে বিঘ্নিত হয়। ১৬ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খোলে এবং ২৭শে এপ্রিল বার এসোসিয়েশন হলে একটি সেমিনার এর আয়োজন করে। এই সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা সরকারের প্রতি কারাবন্দীদের মুক্তি, বেসামরিক স্বাধীনতাকামীদের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবী জানান।
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৫৪