মৌসুমের শেষে
নাসরিন সুলতানা
বৃদ্ধনিবাসে ভর্তির কাজটা সিলভিয়ার নয়। তিনি সবার কাজ দেখাশোনা করেন। একদিন রিসিপশনে থাকাকালীন এক ভদ্রমহিলা এসেছেন এক ভদ্রলোককে ভর্তি করতে। নিয়মানুযায়ী অফিস সহকারী ভদ্রলোকের এসএসসি সার্টিফিকেট চাইলেন।
ভদ্রমহিলা বললেন , সে তো এসএসসি পাস করেনি।
: বয়স প্রমানের জন্য জাতীয় পরিচয় পত্র বা পাসপোর্ট যে কোনো একটা হলেই চলবে।
: পরে দিয়ে যাব।
: আপনি তার কী হন ?
: পরিচিত।
: পরে যেদিন আসবেন সেদিন আপনার ছবি, নাগরিকত্বের সনদপত্র, ফোন নম্বর এবং বাসার ঠিকানা নিয়ে আসবেন। সব কিছুই আপনার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড কমিশনার দ্বারা সত্যায়িত হতে হবে। কিছু মনে করবেন না , ম্যাডাম। আমরা বয়স্ক মানুষের জন্য কাজ করি। বয়সটা হতে হবে ষাট। এমনও তো হতে পারে , আপনি তাকে রেখে গেলেন , অন্য কেউ এসে নিয়ে যেতে চাইল। তখন আমরা আপনাকে ফোন করব। ফোনে না পেলে বাসায় যাব।
: ঠিক আছে।
সিলভিয়া চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করেছেন। তারপর আর মন মানছিল না। টেলিভিশনে দেখার পর থেকেই এই বৃদ্ধনিবাসটা তাকে খুব করে টানছিল। এখানেই থাকেন তিনি। নিজের বাড়ি বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু বাবার বাড়ি। তাও অনেক দূরে। যাওয়া হয় না অনেক বছর। যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। এখানে এসেছেন পাঁচ বছর আগে। খুব ভালো একটা রুম খালি আছে। সিলভিয়া অফিস সহকারীকে টেবিলের কাচের নিচে রাখা আসনব্যবস্থা থেকে সেই রুমের নম্বরটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। অফিস সহকারী সিলভিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই তাকানোর মানে হচ্ছে , যে মানুষটা এসএসসিও পাস করেনি ঐ রুমটা তার জন্য নয়। কথা ছিল ঐ রুমে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বড় অফিসারকে দেবেন। এখানে তারা বাসার চেয়ে ভালো থাকতে আসেন। সিলভিয়া কিছু বললেন না। শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ভুল করে কিছু বলেননি। অফিস সহকারী লিখে দিলেন, ৩০৭। এমডি জিজ্ঞেস করলে বলবেন , ম্যাডাম দিতে বলেছেন। যদিও মুখের কথার কোনো ডকুমেন্ট নেই তবুও ম্যাডাম অস্বীকার করবেন না , এ বিশ্বাস তার আছে।
সেই ভদ্রমহিলা আর আসেননি।
বৃদ্ধনিবাসে নিয়মিত ডাক্তার আসেন। নিয়মিত মানে সপ্তাহে এক দিন। প্রতিদিন পাঁচজন করে মোট পঁয়ত্রিশ জন ডাক্তার আসেন। সব বিভাগের চিকিৎসা এখানে দেওয়া হয়। এখানে সবাইকে সিট নম্বর অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয়। এই নতুন ভদ্রলোককে বলা হয় ৩০৭। তাকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিতে চাওয়া হল। তিনি রাজি হলেন না। ডাক্তারকে তার রুমে আনা হল। বাধ্য হয়ে তিনি তার প্রকৃত বয়স (৫০) বললেন। চোখে কী হয়েছে তা তিনি বললেন না তবে এটুকু বলেছেন যে সমস্যাটা বেশি দিনের নয়। ডাক্তারের সাথে সিলভিয়া ছিলেন। সিলভিয়ার রুমে গিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন যে সিঙ্গাপুরে এর ভালো চিকিৎসা আছে। একটা অপারেশন লাগবে।
সিলভিয়া এমডি সাহেবকে বললেন যে তিনি ৩০৭-কে নিয়ে সিঙ্গাপুরে যেতে চান এবং চিকিৎসাটা দিতে চান। তিনি রাজি হলেন ।
এই বৃদ্ধনিবাসের পদমর্যাদা অনুযায়ী এমডি সাহেবের পরে সিলভিয়ার অবস্থান। তিনি ম্যানেজার। তার কোনো কথা এমডি সাহেব ফেলেন না।
সিলভিয়া ৩০৭-কে নিয়ে সিঙ্গাপুরে গেলেন। সিলভিয়ার আদর-যত্নে তিনি অভিভুত। খুব আপন মনে হয় সিলভিয়াকে কিন্তু সিলভিয়া কথা বলেন খুবই কম। একদিন তিনি বললেন , আমার চোখ যদি ভালো না হয় তাহলে আর বিমান ভাড়া দিয়ে দেশে নেওয়ার দরকার নেই। এখানে ফেলে রেখে যাবেন। যা হয় হবে।
সিলভিয়া কেঁদে বললেন , এসব কথা বলবেন না , প্লিজ। চোখ ভালো হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। ডাক্তার সাহেব বলেছেন।
: ডাক্তার সাহেব বলেছেন চোখ দেখে। আমি তো তাকে কিছু বলিনি। দেখা আর জানা এক নয়। তবুও আমি কেন এসেছি , জানেন ? সীমা যেন আমাকে কোনো দিন দেখতে না পায় তাই।
: সীমা কে ?
: আমার স্ত্রী। আপনাকে আমি সব কথাই বলব। বলতেই হবে আমাকে নইলে আমার চোখের চিকিৎসা ঠিকমতো হবে না। এত টাকা খরচ করে এতদূরে এসেছি। নিজের সাথে কেন প্রতারণা করব ?
: অবশ্যই বলবেন আপনি। আমি সব শুনব।
: আমার বাড়ি গ্রামে। বেলি নামের এক প্রতিবেশী বোনকে আমি ভালোবাসতাম। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমি ঢাকায় আসলাম বড় ভাইয়ের বাসায়। ও তখন ছোট , সিক্সে পড়ে। বিয়ের কিছুই বুঝত না তবে জানত যে ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। ওদের বা আমাদের পরিবারের সবাই এটা জানত। বিশেষ করে আমার বাবা খুব পছন্দ করতেন ওকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরে বেশ কিছু চিঠি লিখেছি ওকে। জবাব দিত না। দেখা হলে বলত , চিঠি লেখার দরকার কী ? চিঠিটা যখন আসে তখন আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। সবাই তো মনে করে আমিও তোমাকে লিখি। এক সময় রাগ করে চিঠি লেখা ছেড়ে দিলাম। বাড়িতেও তেমন একটা যাওয়া হত না। মা ছিলেন না। বাবা মাঝে মাঝে আসতেন।
কনা নামে আমার একটা ক্লাসমেট ছিল। সারাক্ষন আমার পাশে পাশে থাকত। আমার ভালো লাগত না। আমি একদিন কনাকে ধমকে দিলাম। তখন ও বলল যে ও বিবাহিতা। ওকে আমার কাছে পাঠায় সীমা। সীমাও আমাদের সাথে পড়ত। খুব ভালো ছাত্রী। এক সময় কনা সরে গেল। সীমা আসতে শুরু করল। ক্লাসে , ল্যাবে , হলে মোটকথা রাতের ঘুম ছাড়া সব সময়ই সে আমার কাছে থাকত। পড়া-শোনার ব্যাপারে আমাকে খুব সাহায্য করত যদিও আমি চাইতাম না। আমার বিপদে-আপদে আমার আগে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত। বেলির কানে এই খবর গেল। সে আমাকে চিঠি লিখল , আমি তোমাকে বিয়ে করব না।
এটাই তার একমাত্র চিঠি। প্রথম খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপরে ভাবলাম , যে আমাকে এত ভালোবাসে আমি তাকেই ভালোবাসব। যে আমাকে বুঝল না তাকে আর আমি চাই না। অনার্স পাস করেই সীমাকে বিয়ে করে ফেললাম। কাউকে জানালাম না। বাবা বাড়ি থেকে চিঠি লিখতেন , বেলি বড় হয়ে গিয়েছে। এখন বিয়ে হওয়া দরকার। আমি ওর বাবার সাথে কথা বলতে চাই। তখন আমি তাকে আমার বিয়ের কথা জানিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। সীমার একটা ছবিও পাঠালাম। ছবিটা বাবা ছুড়ে ফেলে দিলেন।
বাবার রাগ ভাঙানোর জন্য আমি সীমাকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম। কেউ খুশি হল না। সবার এক কথা , এত সুন্দর ছেলেটা , এই তার বউ ? কিচ্ছু দেখায় না। এর চেয়ে বেলি কত সুন্দর !
আমি বললাম , আমি চেহারা দেখে বিয়ে করিনি। আমি অনার্সে হয়েছি ফার্স্ট , ও হয়েছে সেকেন্ড। মাস্টার্সে আমি হয়েছি সেকেন্ড , ও হয়েছে ফার্স্ট। এই মেয়েকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় আছে ?
বেলিই যে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল সে কথা আমি কাউকে বলিনি। তারচেয়ে ওর প্রতি সবার ভালোবাসাটা থাকুক আমি সেটাই চেয়েছিলাম। বিয়ের আগেও যে একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, একটা আকর্ষণ থাকতে পারে তার নাম যে প্রেম সেটা আমি ওকে বোঝাতে পারিনি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। খুব খারাপ লাগে তখন যখন মনে পড়ে বেলি বিয়ে করেনি। নিজের মতো করে কোথায় যেন থাকে। কারো সাথে যোগাযোগ নেই। ভীষণ অভিমানী মেয়ে।
বিয়ের পরে সীমার চেহারা অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। বলল , আমার চাকরির একটা টাকাও আমি তোমাকে দেব না। আমার এত খারাপ লেগেছে সেদিন ! আমি কি ওকে টাকার জন্য বিয়ে করেছি ?
যা-ই হোক , মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল কিন্তু বিপর্যয় দেখা দিল বছরখানেক আগে। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ওর চেয়ে বয়সে ছোট এ রকম একটা ছেলের প্রেমে পড়ল ও। ছেলেটা চোখের ডাক্তার। আমি ওকে বাধা দেব এটাই তো স্বাভাবিক। আমার দুটো বাচ্চা আছে। তাদের ভবিষ্যতের কথা আমাকে ভাবতেই হবে।
কিছুদিন আগে সেই ছেলেটা আর সীমা দুজনে মিলে আমাকে চেপে ধরল। আমাকে খাটের সাথে বেঁধে ফেলল। তারপর কী যেন একটা তরল জিনিস আমার চোখে দিয়ে দিল। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করলাম আর বললাম , আমাকে মেরে ফেল , সীমা। এভাবে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না।
সিলভিয়া কাঁদছেন। ৩০৭ বললেন , সীমা তার নাম বলেছে টিনা। আমার নামও মিথ্যে বলেছে। বলেছে , আমি তার পরিচিত। ঠিক আছে। আমিও আর কোনো দিন তাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে চাই না।
সিলভিয়া কান্না সামলে বললেন , অপারেশনের সময় আপনি মানসিকভাবে দৃঢ় থাকবেন। চোখ ভালো হলে তো ভালো। যদি ভালো না হয় আপনি বৃদ্ধনিবাসে বাড়ির পরিবেশেই থাকবেন। এখানে আসার পরে আপনার কোনো অযত্ন হয়েছে ?
: না।
: আপনি যখন যা চাবেন তখন তা পাবেন। আপনার সব দায়িত্ব আমার।
: আপনি কখনো আমার রুমে গিয়েছেন ?
: জি।
: এখানে আসার আগে আপনার কণ্ঠ আমি কোনো দিন শুনিনি। এখন মনে হচ্ছে অন্য সবার থেকে আপনার কণ্ঠটা আলাদা। আমার হারিয়ে যাওয়া বেলির সেই কণ্ঠস্বর। আমার চোখ যদি ভালো না হয় তাহলে আমি মনে করব আপনি দেখতে বেলির মতো।
সিলভিয়া জানেন , অপারেশনের পরে চোখ থাকে খুব নাজুক। ব্যান্ডেজ খোলার পরে বেশি উত্তেজিত বা আবেগাপ্লুত হলে চোখ আবার খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তিনি ডাক্তার এবং নার্সদেরকে অনুরোধ করলেন নিরাপদ সময় পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষনে রাখতে। সেটাই করা হল।
ভদ্রলোক সুস্থ। সিলভিয়াকে তার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কাউকে কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকলেন বিছানায়। কিছুক্ষন পরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। তিনি বুঝতে পারলেন এটা সিলভিয়ার হাঁটা। চোখ বন্ধ করেই শুয়ে থাকলেন তিনি। পায়ের শব্দ তার বিছানার কাছে এসে থামল। তিনি চোখ খুললেন। তার চোখে অপার বিস্ময়। ঝটপট উঠে বসলেন, বেলি , তুমি সিলভিয়া হলে কবে ?
সিলভিয়ার দুচোখ বেয়ে নামতে শুরু করল শ্রাবনধারা।
রচনা- ৭.১০.২০১১
প্রকাশ- ডিসেম্বর, ২০১১