গল্প লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক সমাজকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ বার্তা পৌঁছিয়ে দেওয়া। গল্পের ভেতর লুকিয়ে থাকে জীবনের অর্থ, মানুষের সুখ-দুঃখ; আয়েশ ও দুর্ভোগের কাহিনী। গল্প মানুষকে কল্যাণ আর মঙ্গলের মসৃণ পথ দেখিয়ে দেয়। সমাজের অসঙ্গতিগুলো গল্পকার বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন। তাই একজন গল্পলেখককে সমাজ সংস্কারক বলা যায়।
গল্পকার জসীম আল ফাহিম একজন সাদামনের মানুষ । সাদাকে সাদা বলতে এবং কালোকে কালো বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন না। সদা হাসিখুশিময় এই মানুষটির লেখালেখির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের প্রচলিত বিচ্যুতিসমূহ পাঠকের সামনে তুলে ধরা এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা। গল্পের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন ছড়া, কবিতা এবং উপন্যাস। এ পর্যন্ত তাঁর মোট ৩৩ টি বই প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে ২৬ টি গল্পগ্রন্থ, ৪ টি উপন্যাসগ্রন্থ এবং সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ৩ টি গ্রন্থ। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি এ পর্যন্ত মোট ৩টি পুরস্কার পেয়েছেন। যথা:-
১. মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০০৭
২. কেমুসাস তরুণ সাহিত্য পদক ২০০৯
৩. জালালাবাদ কবি ফোরাম সম্মাননা ২০১৫।
অমর ২১ শে বইমেলা ২০১৮ তে সিলেটের পায়রা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘টুসি ডাকে ম্যাও ম্যাও’। প্রকাশক: সিদ্দিক আহমদ। ১৬ পৃষ্ঠার এ বইটিতে মোট ৪ টি গল্প স্থান পেয়েছে। ৪ টি গল্পতেই লেখক পাঠককে বিশেষ বার্তা দিয়েছেন। এখানে গল্পগুলোর সারমর্ম তুলে ধরা হলো।
এক নাদুসনুদুস বিড়াল ভাগ্যের জোরে এক গৃহস্থ বাড়ি আশ্রয় পেয়েছিল। এখানে তাঁর খাওয়া-দাওয়া; আদর যতেœর কোন অভাব ছিলনা। কিন্তু সে লোভের বশবর্তী হয়ে চুরি করে খাদ্য ভক্ষণ করতে লাগলে একসময় গৃহস্থের কাছে বিষয়টি ধরা পড়ে এবং গৃহস্থ তাঁকে তাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে, সে দইওয়ালার বাড়িতে আশ্রয় পেলে সেখান থেকেও দই চুরির অভিযোগে সে বিতাড়িত হয়। এভাবে সে বেশ কয়েকটি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলে একসময় সে বনে চলে যায়। সেখানেও বেশি খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার আশায় বাঘের সাথে ভাব জমাতে গেলে বাঘ তাঁকে খেয়ে ফেলে। [‘মিনিবিড়াল’ গল্পের সারকাহিনী]
লোভ কখনো মঙ্গল বয়ে আনেনা। এতে মানুষ হয়তো সাময়িক সুবিধা লাভ করতে পারে কিন্তু একসময় তাঁর নেতিবাচক প্রভাব জীবনে পড়ে। লোভের ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ নিজের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। নিজের প্রাপ্যটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ‘অতি লোভে তাতী নষ্ট’ এ কথাটি সর্বাংশে সত্য।’ লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ সাময়িক কল্যাণ দেখে। অথচ বুঝতে পারে না আড়ালে থাকা চরম ক্ষতি। গল্পকার ‘মিনিবিড়াল’ গল্পে বিড়াল চরিত্রের আড়ালে লোভের ভয়ানক পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছেন।
এক বিড়াল খাঁচার ভিতর আবদ্ধ এক বুলবুলিকে খেয়ে ফেলার স্বপ্ন বুনছিল। তাঁর বিবেকবোধ এতটাই নিচ ছিল যে, সে বুঝতেই পারেনি এতে অসহায় বুলবুলিটির জীবন হরণ হবে। সেখানে ছিল বিড়ালের অত্যাচারে জর্জরিত এক ইঁদুর। খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে বিড়ালকে আক্রমণ করতে হবে এই শর্তে সে বুলবুলিকে খাঁচা কেটে মুক্ত করে আনে। ঘটনার একপর্যায়ে যখন বিড়ালটি একটি কাঠবিড়ালিকে খেতে লাগলো তখন বুলবুলিটি তাঁকে আক্রমণ করে। ফলে, কাঠবিড়ালি পালিয়ে যায় এবং বিড়াল তাঁর অসৎ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। [‘লোভী বিড়াল’ গল্পের সারকাহিনী]
এটি হচ্ছে বইটির ২য় গল্প। এ গল্পেও লেখক লোভের পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজের একটুখানি ভালোর জন্য অনেক মানুষ বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থটুকু আদায়ে বেশ উঠেপড়ে লাগে। ফলশ্রুতিতে, একসময় সে-ই চরম দুর্ভোগে নিপতিত হয়।
পর্ণা নামক ছোট্ট এক মেয়ে ছিল উদার হৃদয়ের অধিকারী। জীবের প্রতি তার ছিল অসীম মমতা। একদিন বাবার সাথে কেনাকাটা করতে গেলে সে দেখল রাস্তার পাশের নালার কিনারে একটি বিড়াল কান্না করছে। সে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরল ঐ বিড়ালটাকে বাসায় আনতে। কিন্তু, তাঁরা আনলো না। ফলে, সে খুব কষ্ট পেল এবং তা সহ্য করতে পারল না। বিড়ালটিকে না আনায় এতটাই সে কষ্ট পেল যে, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। একপর্যায়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার জানালো যে, মেয়েটি কোন কারণে খুব কষ্ট পেয়েছে। ফলে সে জ্ঞান হারিয়েছে। যখন তাঁর বাবা আবার তাঁকে সেই বিড়ালটি ফিরিয়ে এনে দিলেন তখন সে বিড়ালটি পুষতে লাগল এবং খুব খুশি হল, সেই সাথে সে তাঁর আনন্দময় পুরনো জীবনে ফিরতে সক্ষম হল। [‘ছোট্ট বিড়ালছানা’ গল্পের সারকাহিনী]
পৃথিবীতে উদার ও নিষ্ঠুর দুই ধরনের লোক বাস করে। উদার হৃদয়ের অধিকারী লোক পৃথিবীতে থাকার কারণেই পৃথিবীতে আজও দরিদ্র লোকেরা কিছুটা হলেও শান্তিতে দিনযাপন করছে। অপরদিকে, নিষ্ঠুর প্রকৃতির কিছু উদ্ভট মানুষের কারণে পৃথিবী ক্রমেই দানবীয় রূপ লাভ করছে। গল্পকার উক্ত গল্পটির মাধ্যমে নিষ্ঠুর ও উদার দুরকম প্রকৃতির মানুষের কর্মকা- চিত্রিত করেছেন। ‘পর্ণা’ চরিত্রটি এখানে উদার মানবিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।
তৃষাণ নামের এক কচি শিশু স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি বিড়ালকে ধরে নিয়ে আসে। কিন্তু তার মা তা মেনে নেননি। তাই মায়ের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে বিড়াল ছানাটিকে সে আবার ফেলে আসতে হয়েছিল। কিন্তু, পরবর্তীতে বিড়াল ছানাটি আবার চলে আসে। তৃষাণ তাকে খুব আদর যতœ করত। যখনই সে বিড়ালটিকে ‘টুসি’ বলে ডাকতো তখন বিড়ালটি তার কাছে চলে আসতো। খাদ্যদ্রব্য চুরির অভিযোগে আবার তার বাবা বিড়ালটিকে তার আড়ালে ফেলে আসলে বিড়ালটি আবার চলে আসে এবং আদরের বিড়ালটিকে ফিরে পেয়ে সে বেশ খুশি হয়।
পশুদেরও বোধশক্তি রয়েছে। যেখানে স্নেহ-মমতা পায় সেখানে বারবার যায়। তেমনি, আমাদের সমাজের দরিদ্র লোকজন কোন বিত্তশালী উদার লোকের কাছে একটুখানি ঠাঁই পেলে বারবার সেই মানুষটির কাছে যেতে চায়। ‘বিড়াল’ চরিত্রটি এখানে মূলত দরিদ্র লোকেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
বইটির ৪ টি গল্পেই একটি প্রধান চরিত্র ‘বিড়াল’ রয়েছে। এ চরিত্রটি দু’টি গল্পে ইতিবাচক ও দু’টি গল্পে নেতিবাচক রূপ ধারণ করেছে। বইটি শিশুদের কাছে লোভের পরিণতি ফুটিয়ে তুলে; সেইসাথে উদার -মানবিক ও হৃদয়বান হওয়ার সুমতি প্রদান করে। আমি আশা করি, বইটি শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে এবং সেই সাথে বেশ সমাদৃতও হবে৷
লেখক: নাসিম আহমদ লস্কর
শিক্ষার্থী; বিবিএ প্রোগ্রাম
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১৭