বাংলাদেশের বর্তমান সমাজপ্রেক্ষিতে শিক্ষকতাকে সবচেয়ে সম্মানজনক ও স্বচ্ছ পেশা মনে করা হয়। শিক্ষকতা এমন এক পেশা যেখানে উৎকোচ গ্রহণের কোন সুযোগ থাকেনা; এ পেশার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জ্ঞানের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ও নৈতিকতাঅক্ষুণ্ণ রাখা। একজন আদর্শ শিক্ষক সবসময় নিজেকে পঠন ও পাঠনে নিয়োজিত রাখেন। তাঁর অন্যতম কাজ হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা ও সকলের মাঝে তা ছড়িয়ে দেয়া। একজন আদর্শ শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে শিক্ষা দেন সে শিক্ষা পরবর্তীতে সে জাতিকে সে পথে পরিচালিত করে। দেশ ও জাতিকে উন্নত করে গড়ে তুলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পড়ে একজন আদর্শ ও উদ্যমী শিক্ষকের। যারা শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত তাঁরা সকলেই শিক্ষক কিন্তু সকলে আদর্শ শিক্ষক নন। একজন শিক্ষক ভবিষ্যত প্রজন্মকে হীরকের খনি হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন আবার বজ্জাতের খনি হিসেবেও গড়ে তুলতে পারেন।
একজন আদর্শ শিক্ষকের কতগুলো বিশেষ গুণাবলি রয়েছে। চলুন একপলকে দেখে নেয়া যাক সেই গুণাবলিগুলো:
১. একজন আদর্শ শিক্ষক কোন ছাত্রছাত্রীকে নিরুৎসাহিত করেননা। কোন ছাত্রছাত্রীকে তিনি কখনো বলেননা যে, তোমার দ্বারা এটি ওটি সম্ভব না। তিনিদর্শনের শিক্ষার্থীকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আবার সিএসই-র শিক্ষার্থীকে দার্শনিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
২. তিনি কখনো ক্লাসে এসে অলসভাবে বসে থাকেননা৷
৩. শুধু বিষয়ভিত্তিক আলোচনা না করে তিনি বাস্তব জগত সম্পর্কেও ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলোচনা করেন৷
৪. মোটিভেটেড লেকচার ক্লাসে ডেলিভার করেন৷
৫. ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বের মুখোমুখী হোন৷
এছাড়াও একজন আদর্শ শিক্ষকের আরো অনেক গুণাবলী রয়েছে৷ অনেক শিক্ষক আছেন যারাশিক্ষকতা জীবনে কখনো বইয়ের সংস্পর্শে যাননি৷ অথচ দিনের পর দিন তিনি ক্লাস করাচ্ছেন৷ ফলে, তার কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখতে পারেনা৷ পড়ালেখা কোন পুঁথিগত বিষয় নয়৷ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ধ্যান -ধারণারওপরিবর্তন হয়৷ ফলশ্রুতিতে, লেখাপড়ার বিষয়গুলোতেও পরিবর্তন আসে৷ একজন আদর্শশিক্ষক বিশ্বের নতুন নতুন বিষয়গুলোর প্রতি সবসময় নজর রাখেন৷ ক্লাসে এসে ছাত্রছাত্রীদের সাথে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন৷ ফলে নতুন পথেরযাত্রীরা নতুন নতুন বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারে৷ নতুন নতুন বিষয়গুলো জানতে জানতে তারাও নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে৷ নতুন পথের সন্ধানে তারাওবেরিয়ে পড়ে৷ আসলে, মহাবিশ্ব হচ্ছে পরিবর্তনের দৌড়ঝাঁপের এক মাঠ৷ এখানে কোনকিছুই গতানুগতিক নয়৷ সবকিছু যদি গতানুগতিক হতো তাহলে আমাদের এখনো সেই আদিম সমাজে বসবাস করতে হতো৷ আমরা আধুনিক যুগের দেখা পেতাম না৷ যে অন্ধকারেছিলাম সে অন্ধকারেই থেকে যেতাম৷
বাংলাদেশের এই মুহূর্তে দরকার কিছু উদ্যমী শিক্ষকের যারা শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালন না করে এর বাইরেও যেন কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক৷ একজন শিক্ষক যে কেবল যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াবেন তা নয়, তাঁকে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে নিজ উদ্যোগে নবীন থেকে শুরু ককে প্রবীণদের যেন লেখাপড়া করানোরউদ্যম থাকতে হবে৷ সেই লক্ষ্যে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে৷ এরকম শিক্ষক যদি ২০% ও পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে দেশ আর এরকম পিছিয়ে পড়া দেশ থাকবেনা৷ দেশ হয়ে যাবে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ৷
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন শিক্ষকের উদাহরণ এ প্রসঙ্গে টেনে নিয়ে আসা যায়৷ আমি তখন সবেমাত্র প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠেছি৷ আমি ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ছাত্র৷ মনে মনে হিসাববিজ্ঞানকে খুব ভয় পাই যেহেতু আমার এসএসসি এবং ইন্টারমিডিয়েট লেভেল ছিল মানবিক বিভাগ ভিত্তিক৷ স্যার প্রথমদিন ক্লাসে আসলেন৷ আমি মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছি৷ স্যার যদি ক্লাসে ভালো করে নাপড়ান তাহলে আমি এই কোর্স কিভাবে শেষ করবো৷ কিন্তু স্যার প্রথমদিন এমনভাবে ক্লাস নিলেন যে, ওই কোর্সটির প্রতি আমার ভয় কেটে গেল৷ তিনি ক্লাসে শুধুকোর্সভিত্তিক গতানুগতিক আলোচনাই করেননা৷ বাস্তবজগত সম্পর্কে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন৷ ফলে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারে৷
একদিন আমি স্যারকে বলেছিলাম, "স্যার আমি তো ম্যাথ পারিনা৷" স্যার আমাকে কোন প্রশ্নই করলেন না যে, ‘‘তুমি কেনো ম্যাথ পারনা৷” সরাসরি তিনি আমাকে বোর্ডে নিয়ে গেলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন ও আমাকে দিয়েই ম্যাথটা সমাধান করালেন৷ ফলে, ম্যাথের প্রতিএই বিশেষ ম্যাথটার প্রতি আমার ভয় অনেকটা কেটেগেলো৷ এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের নাম আজিম উদ্দিন৷ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি শুধু আমার মন জয় করেননি, করেছেন অনেক শিক্ষার্থীর মন জয়৷ অনেক শিক্ষার্থী তার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখতেপেরেছে৷ আমাদের মনে ও মননে এই শিক্ষক আজীবন থাকবেন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে৷
প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এরকম কিছু উদ্যমী শিক্ষকদের দরকার৷ যাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ তার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কিছু আহরণ করতে পারে৷
উৎসর্গ: আজিম উদ্দিন স্যার
প্রভাষক; ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট৷
লেখক: নাসিম আহমদ লস্কর
অনার্স প্রথম বর্ষ; ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট৷