মাঝে মাঝে অসাধারণ ক্যারিশমা সম্পন্নরা অবশ্য ‘বড় নেতা’ অথবা ‘মহানায়ক’-এর আখ্যায়ও ভূষিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারা সবাই সমসাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটের নায়ক। কিন্তু ‘ইতিহাসের নায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাসের আপন তাগিদেই তার ‘নায়কের’ উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ‘ইতিহাসের নায়ক’-ই হয়ে উঠে ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর-স্থপতি।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের একজন অবিসংবাদিত বড় মাপের নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের মহানায়ক’। আরো সত্য করে বললে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘ইতিহাসের এক মহানায়ক’।
রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়কের এই অবস্থানে উত্থিত হতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাবনা-চিন্তা আদর্শবোধ-জীবন দর্শন ইত্যাদি আত্ম-পরিচয়ের মৌলিক উপাদানগুলো ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। এক অবস্থান থেকে উন্নততর অবস্থানে সেসবের উত্তরণ ঘটেছে।উত্তরণ ও বিবর্তনের এই গতি কোনোদিন বন্ধ হয়নি, অব্যাহত থেকেছে তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত।
রাজনীতির অনেক আঁকা-বাঁকা পথে তাঁকে চলতে হয়েছে, অনেক আগু-পিছু করে করে তাঁকে রাজনীতির দুর্গম পথ পরিক্রম করতে হয়েছে, বাস্তবতার প্রতিকূলতার মুখে কখনো কখনো তাঁকে সাময়িক আপোষও করতে হয়েছে,- কিন্তু তাঁর সার্বিক বিবর্তনের গতি ছিল সামনের দিকে, প্রগতি অভিমুখে।
এটাই ছিল নিশ্চিত ও আবশ্যম্ভাবী। কেন? কারণ, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক, ছিলেন জনতার নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক পণ্ডিত তিনি কখনওই ছিলেন না। তিনি সর্বজ্ঞানী অথবা কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞও ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন নেতা। তিনি ছিলেন মানুষের লোক। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। সব বিষয়ে শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। মানুষবর ওপর জনতার ওপর তাঁর এহেন অপার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তাঁর ক্রমবিবর্তনের প্রগতিমুখীন হওয়াটাকে আবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।
শুরুতে ছিলেন দুরন্ত কিশোর-মুজিবর। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তার পর মুজিবুর রহমান, অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তার পর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তাঁর নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি ‘জাতির পিতা’। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তাঁর অবস্থানের ইত্তরণ।
তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তাঁর চিন্তাধারা-জীবন দর্শনেও উত্তরণ ঘটেছে। শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসেবে। কিন্তু সেসময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা প্রগতিমুখীন যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সারোয়ার্দ্দী সাহেবের অনুগামী।
তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। তিনি একই সাথে ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট- এই তিন দলের ঝাণ্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচীতে সঙ্গী-সাথী-অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবন দীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তখন থেকেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের সাথে তাঁর পরিচয়, কিছুটা ঘনিষ্ঠতার সূচনা। তখন থেকেই তার মাঝে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি একটি গভীর মনের টানের উন্মেষ। সাথে সাথে অসাম্প্রদায়িক বোধের জাগরণ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি তাঁকে অতি দ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তোলে। সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে যান। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাষানী-সারোয়ার্দ্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন। জেলে ও জেলের বাইরে আওয়ামী লীগে কাজ করতে করতে কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের সাথে তাঁর সংযোগ আরো ঘনিষ্ঠ হয়।
প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ‘শেখ সাহেব’ দুইবার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ গঠিত হয়। চলে নবগঠিত ন্যাপের ওপর আওয়ামী-হামলাবাজি। ‘শেখ সাহেব’ অচিরেই বুঝতে সক্ষম হন যে, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু তাঁর নেতা সারোয়ার্দ্দী সাহেবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। দলের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এ্যাসেমব্লিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। প্রগতিশীলদের সাথে তাঁর নৈকট্য আরো বৃদ্ধি পায়।
আইউবী সামরিক শাসন জারির পর প্রবল নির্যাতন ও আক্রমণের মুখে ‘শেখ সাহেব’ অনেকদিন হতাশায় আচ্ছন্ন থাকার পর আবার চাঙা হয়ে ওঠেন।
‘৬১-সালের শেষ দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মনি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠকে তিনি মিলিত হন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করা কৌশল নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। ‘শেখ সাহেব’ একাধিকবার পার্টির নেতাদের বলেন যে, গণতন্ত্র, বন্দীমুক্তি প্রভৃতি দাবির সাথে সাথে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিও এখনই উঠানো উচিৎ। পার্টির নেতারা তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, ‘স্বাধীনতার দাবিটি সঠিক বটে, তবে তা উত্থাপনের জন্য এখনো অবস্থা পরিপক্ব হয়নি। এখন গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে।’ ‘শেখ সাহেব’ তাঁর নেতা সারোয়ার্দ্দী সাহেবের সাথেও কথা বলেন। শেষ বৈঠকে তিনি পার্টির নেতাদের বলেন যে, ‘দাদা, আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, কিন্তু তার পরেও আমার কথা অনেক থেকে গেল, যুক্তিগুলো সব মানলাম না’।
সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বছরগুলোতে জেলখানাগুলো ভরে উঠল রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে। ‘শেখ সাহেব’ এবং আরো অনেকেরই নিয়তি হলো জেলে যাওয়া, আবার বের হয়ে আসা, আবার জেলে যাওয়া। ‘শেখ সাহেব’ও দেখলেন যে, ‘আমরা তো আসি-যাই, কিন্তু কিন্তু জেলখানার প্রায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে রয়েছেন কমিউনিস্ট নেতারা। তাদের কাজ তো দেখি সবসময় আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো ও বিদায় দেয়া’। কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ তাঁকে অভিভূত করে। এ কারণে তিনি আজীবন কমিউনিস্টদেরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। তাদের সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতিও একটি সহানুভূতি ও আকর্ষণ তাঁর মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে।
৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ‘শেখ সাহেব’ বুঝতে পারেন যে, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেশোরে নামার সময় এসে গেছে। তিনি ৬-দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও নামডাকওয়ালা নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি দৃঢ়চেতাভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন।
আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে সাহসী মহাবীরের মতো আপসহীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন বাঙালির স্বাধিকারের দাবি নিয়ে। দলের কর্মীরা শুধু নয়, সমগ্র দেশবাসী এই ৬-দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর পেছনে সমবেত হতে থাকেন।
সরকার মরিয়া হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে তাঁকে সবদিক থেকে ‘শেষ করে দেয়ার’ চেষ্টায় নামে। কিন্তু ‘শেখ সাহেব’ ছিলেন ইতিহাসের পক্ষে এবং ইতিহাস সৃষ্টির মতো প্রজ্ঞা, জেদ, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন। পাক-সরকারের প্রতিটি আঘাত তাঁর জন্য বীরমাল্য স্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচু স্তরে পৌঁছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬-দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১-দফা। সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক। শেখ সাহেব হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
‘৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনে। ইয়াহিয়া খান সেই বিজয়কে কেঁড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেয়। দেশের অঘোষিত সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার নস্যাৎ করার পথ গ্রহণ করা হয়।
প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’। ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, তবুও শত্রুর হাত থেকে এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্’।….. ইত্যাদি। স্বাধীনতার পথে বাঙালির যাত্রার শীর্ষ পর্যায়ের ও প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন জাতির জনক। নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সাংবিধানিক রূপ প্রদানের কাজটি তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। রচিত হয় ‘৭২-এর সংবিধান, ঘোষিত হয় ৪ ( গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ) রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।
একথা সত্যি যে, শেষ বিচারে ইতিহাসের স্রষ্টা হলো জনগণ। কিন্তু ব্যক্তির ভূমিকাকেও ইতিহাস অগ্রাহ্য করে না। ইতিহাসের চাহিদা অনুযায়ী যে ব্যক্তি জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারেন, এবং জাগ্রত জনগণের গণবাণীকে সঠিক রূপে প্রতিফলিত করতে পারেন-তিনিই হয়ে ওঠেন ‘ইতিহাসের নায়ক’।
ইতিহাসের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’- তোমায় সালাম!
[(লেখক- মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সূত্র- মত ও পথ।) ছবি নেট থেকে নেয়া। অক্ষরগত ভুল হতে পারে লেখকের লেখার কোন পরিবর্তন করা হয়নি।]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:০৯