আজ সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে ভাবছিলাম এখন থেকে বছর তিন-চার আগের কোন সন্ধ্যা কিংবা বিকেলের কথা! ছোট্ট -শান্ত এক শহরে তখন ছিলো আমার বসবাস। মনে পড়ে যাচ্ছে কত শান্ত বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়েছি রুপসা-ভৈরবের তীরে। বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় রূপসা ব্রিজ, রিকশায় মিনিট বিশেকের পথ। যারা কখনো খুলনায় যাননি তাদের জন্য বলি, খুলনায় রি্কশায় চড়ার মজাই আলাদা! ফাঁকা রাস্তা, শান্ত-নিরিবিলি শহর, রাস্তার দুপাশেই গাছ! এরকম চমৎকার পরিবেশে রিকশায় ঘুরে বেড়াতে কার না ভালো লাগে! যাই হোক, রূপসা খুব কাছে হওয়ায় প্রায় দিনই বন্ধুরা মিলে এ্কসাথে চলে যেতাম রূপসার পাড়ে অর্থাৎ ব্রিজের ওখানে। নদীর উন্মাতাল বাতাস আর ব্রিজের চমৎকার স্ট্রাকাচারাল ভিউ মিলেমিশে একাকার! একদম সরাসরি সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজের উপরে চলে যাওয়া! এরপর এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটা, মাঝে মাঝে থেমে নিচের ছোট্ট পিচ্চি নৌকা গুলোকে ঢেউয়ের তালে দুলতে দেখা কিংবা একদম পুরো চোখ মেলে নদীর ওই দূরের বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকা , কি অদ্ভুত মজা! এভাবে আসলে যারা ব্রিজের উপর থেকে নদী কিংবা নদীর বাঁক দেখেননি তাদের এই দৃশ্যের প্রকৃত সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভর দুপুরে রোদ মাথায় করে ব্রিজ পার হয়ে ও পারের কোন গ্রামের ভেতর ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গ্রাম্য চায়ের দোকানে হাত-পা মেলে বসে আরাম করে চায়ে চুমুক দেয়া, কি শান্তি! কখনো বা গ্রামে না ঢুকে মসৃন হাইওয়ের এক পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেদিক ইচ্ছে সেদিকে চলে যাওয়া! রাস্তার পাশে ধানক্ষেতের মাঝের আইলে নেমে দশ দিকে চোখ মেলে দেয়া, কি না করেছি! তবে এই ঘোরাঘুরি যে শুধু বিকেলেই হয়েছে তা না, বরং ছুটি পেলেই সকালে কিংবা মধ্য দুপুরেও এরকম অভিযানে বেড়িয়ে পড়েছি বন্ধুরা মিলে। তিনজনের কিংবা চারজনের দল, যেদিক ইচ্ছে সেদিক ছুটে যাই, ব্রিজের পাশে হাঁটা রাস্তায় বসে অর্থহীন ছবি তুলি কিংবা ভ্যান দেখলে লাফ দিয়ে তার পিছনে চড়ে বসা , এগুলো ছিলো নিত্যকার কাজ! খুব ক্লান্ত হয়ে গেলে ব্রিজের নিচের সুন্দর বাঁধানো বসার জায়গাটাতে আরাম করে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক!
আগেই বলেছি , আমার বাসা থেকে রূপসা খুব বেশি দূরে না। তবে এই রূপসাই কিছুটা ঘুরে যখন খুলনা শহরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে তখন এর নাম হয়েছে ভৈরব। সেই হিসেবে আমার বাড়ি ভৈরবের পাড়ে। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ ভৈরবের পাড়, আমার বাসা থেকে। সুতরাং বিকেলে ভৈরবের পাড়ে যাই নি, এমন দিন একটাও কাটিয়েছি কিনা মনে পড়ছে না! এস এস সি পরীক্ষার পরের সময়। বিরাট ছুটি। আমরা তিন বন্ধুর দল একসাথে গিয়ে হাজির হতাম ভৈরবের তীরে। নদীর ঘাট থেকে কিছুটা কাঠের জেটির মত বানিয়ে নদীর অনেকখানি ভেতর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা। তিনজন মিলে একসাথে সেটার একেবারে প্রান্তে যেয়ে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসতাম! জোয়ারের সময় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যেতো! সকালে বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম, দুপুরে খাওয়ার জন্য আধ ঘন্টা এই বিরতি ছাড়া সারাদিন আমরা নদীর পাড়ে কিংবা খেলার মাঠে!উপরে আকাশে মেঘ -ছায়ার খেলা , নিচে নদীর পাড়ের উত্তাল বাতাস আর এর ভেতর জোয়ারের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, কি অসাধারন ছিলো সেই অনুভুতি! কখনো তেল-বাহী জাহাজ গুলো ছুটে গিয়ে আরো উন্মত্ত করে দিয়ে যেতো ঢেউগুলোকে। শুধু সকাল কিংবা বিকেল নয়, কত সন্ধ্যা যে এভাবে নদীর পাড়ে বসে থেকেছি তার হিসেব নেই। যেদিন পড়াশোনা থাকত সেদিন না রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত ও কাটিয়েছি নদীর পাড়ে। নীরব চারিদিক, এর মাঝে মিটমিট হারিকেন জ্বালিয়ে নদীতে এপার- ওপার করছে দুই একটা নৌকা, মৃদু বাতাস আর আকাশে পূর্ন চাঁদ , এই সৌন্দর্য, তখনকার অনুভুতি প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। পূর্নিমা রাত গুলোতে অদ্ভুত এক আলো জেগে থাকত নদীর উপর, সেই আলোয় প্রচন্ড রহস্যময় লাগতো নদীর ওপারের গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গ্রামগুলোকে! কি ঘোর লাগা বিস্ময় নিয়ে যে সেদিকে তাকিয়ে থেকেছি কতবার! আমরা যেখানে বসে থাকতাম নদীর পাড়ে , তার একটু দূরেই ছিলো ত্রি-মোহনা। তার কিছু দূরে নৌবাহিনীর জেটি। অন্যরকম এক জগত মনে হতো সেখান থেকে তাকিয়ে নেভীর ছোট ছোট জাহাজের আলোগুলোকে দেখলে!
ঝুম বর্ষায় খোলা ডিঙ্গি নৌকায় ভিজতে ভিজতে নদী পার হওয়া, সে অন্য এক মজা! কখনো বা নদীর ওপারে গ্রামের ভেতর ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ নামা ঝুম বৃষ্টি আর সেই বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গ্রামের পথে হাঁটা! বাড়ি কিংবা দোকান কিংবা পথের পাশের ছোট্ট চালা থেকে গ্রামের মানুষজন হা করে তাকিয়ে দেখছে আমাদের! ভাবছে , এই পাগলগুলো কোথা থেকে এলো! আমাদের কিন্তু কোন বিকার নেই! সেই ভিজতে ভিজতেই আবার নৌকায় ওঠা এবং আবারো নদীর পানিতে বৃষ্টির জল মিশে যাওয়া দেখতে দেখতে ফিরে আসা!
নদী পার হয়ে ওপারের গ্রাম গুলোতে ঘুরে বেড়ানোর নেশা ছিলো প্রবল। কোন উদ্দেশ্য নেই, চিন্তা নেই, দ্বিধা নেই, শুধু হাঁটতে থাকা আর দেখা! তাছাড়া ওই পারের চারদিকেই নদী হওয়ায় (গ্রামগুলোএকসাথে কিছুটা দ্বীপের মত) একটু পর পর গ্রামের মেঠো পথের পাশের ধান ক্ষেত কিংবা সুপারি বন ছাপিয়ে উঁকি দিত নদী! এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একবার পথ হারিয়ে ফেললাম আমি আর আমার বন্ধু! যতই খুঁজি ,নদীর ঘাটের আর দেখা পাই না! মহা সমস্যা! এদিকে গ্রামে কাউকে চিনিও না যে কার বাড়ির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করব! প্রচন্ড সঙ্কোচে পড়লাম! কি করা যায়! একবার একটা দোকান দেখেছিলাম, কিন্তু ঘুরে এসে অন্য পথে চলে আসায় সেই দোকানও দেখছি না! এমন সময় হঠাৎ শুদ্ধ শহুরে উচ্চারনে পাশ থেকে কেউ একজন বলল, "আপনারা কি পথ হারিয়েছেন?" পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমদেরই বয়সী এক তরুনী। বিব্রত ভঙ্গিতেই জানালাম কথাটা সত্য! আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে সেই তরুনী বলল, "আপনাকে প্রায়ই এদিকে ঘুরতে আসতে দেখি! ওপারে থাকেন নিশ্চই! ওপারের ঘাটের ওদিকেও আপনাকে দেখেছি!" আমি বিস্মিত! আমাকে দেখেছে সেই জন্য না, খুলনা এত ছোট্টশহর , তার চেয়েও ছোট এলাকা নদীর এপার-ওপার , সুতরাং কেউ কাউকে চিনতেই পারে! আমি অবাক হচ্ছি গ্রামের একটা মেয়ে এত চমৎকার ভাবে কথা বলছে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে! যাই হোক, পরে জানলাম সে আমার সাথেই কোন এক প্রাইভেটে পড়ত! তার সহায়তায় দুই পথহারা পথিক খুঁজে পেলাম নদীর ঘাট! এরকম আরো কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে হয়েছে!
এইচ এস সির পর থেকেই মোটামুটি খুলনা ছাড়া! এখন তো বছরে কয় দিন খুলনায় থাকা হয় তা আঙ্গুল গুনে বলা যাবে! এজন্যই এ্খন আরো প্রচন্ড রকম মিস করি আমার ছোট্ট শহরটাকে , ভৈরবের পাড়ের রোদ ছায়ার দুপুরকে কিংবা রূপসা ব্রিজের ওপারের বিকেলগুলোকে। এখনো যে কয়দিনের জন্য খুলনায় যাওয়া হয় ছুটে বেড়াই নদীর এপার থেকে ওপার, রূপসা ব্রিজ থেকে ওদিকের হাইওয়ে কিংবা গ্রামের পথ! অথবা আমাদের প্রিয় আড্ড দেয়ার মোড়ের চায়ের দোকান! সেই সাথে অলকার বিরিয়ানি , হাউজিং মোড়ের দশ টাকার চটপটি এসব ও মিস হয় না! কিন্তু এত অল্পতে কি আর মন ভরে! তাইতো প্রচন্ড যান্ত্রিক এই শহরে, তার চেয়েও যান্ত্রিক জীবনে (আক্ষরিক অর্থেই যান্ত্রিক জীবন!) খুব বেশি অভাব বোধ করি সেই দিনগুলোর। ভালো থাকুক আমার প্রিয় শহর, ভালো থাকুক প্রিয় মুহুর্তগুলো , ভালো থাকুক চেনা-অচেনা মুখগুলো! ভালো থাকুক প্রিয় স্মৃতি, ভালো থাকুক ফেলে আসা সময়!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১৫