somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘসঙ্গী অথবা এক মধ্যরাতের গল্প

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জানালার পাশ থেকে সরে আসার আগেই চোখে বালি ঢুকে গেলো! আচমকা শুরু হওয়া দমকা বাতাসটা কিন্তু আসি আসি করছিলো আরো কিছুক্ষন আগে থেকেই। খুব ধীরে দূর কোথাও থেকে আসছিলো ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা বাতাস। এরপরই এ্কদম হঠাৎ করেই চলে এলো দমকা হাওয়ার ঝাপটা। আমি বসে ছিলাম তখনো কিছুটা দ্বিধান্বিত মুগ্ধতা নিয়েই! আর তাই চোখে এসে ঢুকে গেল বালুকনা। চোখ কচলাতে কচলাতেই জানালার কবাটটা টেনে দিলাম। সুইচ টিপে লাইট জ্বালতে গিয়েই টের পেলাম ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। কি আর করা। আবছা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েই মগ থেকে চোখে পানি দিলাম। মোমের আলোটা জ্বেলে আবার বিছানায় এসে বসতেই কেমন করে যেন কিছু কথা মনে পড়ে গেল। তাইতো এই কলম ধরা! কেমন আছো নীহার? আমি জানি তুমি এখন মুখ বাঁকিয়ে হাসছো! নিশ্চই ভাবছো , এতক্ষন পরে, এত বকবকানির পরে আমার জানার ইচ্ছে হলো তুমি কেমন আছো! কি করব বলো! আমি যে চিরকালই এমন! স্বার্থপর! তুমি নিজেই তো কত মধ্য দুপুরে আমাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে আমাকে এই কথাটা বলেছো! কারন হচ্ছে আমি সারাটা দিন পেরিয়ে গেলেও কেন তোমার সাথে গতকাল দেখা করলাম না! কি করবো বলো! তোমার আম্মাকে কিংবা ছোট বোনকে দেখতে যাবার নাম করে কয়বারই বা তোমার বাসায় যাওয়া যায়! আর তোমার বড় আপাও যেন কিছু বুঝে গিয়েছিলেন! তাইতো কেমন করে যেন তাকাতেন আমি তোমাদের বাসায় গেলে। মিটিমিটি হাসতেন। আমি এদিকে লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতাম আর গভীর মনযোগে দেখতাম তোমাদের বসার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা ! আর রুনুটা যে কি ফাজিল ছিলো! আমি তোমাদের দোতলা বাড়ির সামনের বারান্দায় পা রাখা মাত্রই উপর থেকে চিৎকার করে বলত, আপু বাসায় নেই! সেই সাথে খিল খিল হাসি! তুমিই বলো , এর মাঝে কি তোমার বাসায় প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব!

নীহার তোমার কি মনে আছে , ঝুম বৃষ্টির দিনগুলোর কথা? আমাদের এই ছোট মফস্বলে এমনিতেই মানুষ কম , আর বৃষ্টি হলে তো সবাই যেন ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে শুধু খিচুড়ি খাওয়াতেই ব্যস্ত হয়ে যায়! তোমার -আমার বাড়ির মাঝের নির্জন গলিটা হয়ে যায় আরো নির্জন! আমার রুমের জানালাটার সাথে একটু বাঁকা লাইন করে ছিলো তোমার জানালাটা! ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে , তুমি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে ভিজছো , সেই সাথে ভিজছে তোমার হাতের সবুজ চুড়ি গুলো আর আমি তন্ময় হয়ে দেখছি সেই দৃশ্য ! এভাবে দেখতে যেয়ে কখন যে আমার গায়ের জামাটা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে একাকার হয়ে যেত তা টের ও পেতাম না! সম্বিত ফিরে পেতাম যখন ওদিক থেকে তুমি চিৎকার আমাকে বলতে, "অনেক দেখা হয়েছে আমাকে। এবার যাও। জ্বর বাধিয়ো না"! বলেই দড়াম করে জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেতে!পরদিন অবধারিত ভাবে তোমাকে দেখতে যেতাম আমি। তোমার ঠান্ডার সমস্যা আছে। কাজেই এতক্ষনে যে টনসিলের ব্যাথায় তুমি গলায় মাফলার জড়িয়ে বসে আছো তা আমার অজানা ছিলো না! কিন্তু এই কথা মাথায় আসতো না যে সাত সকালে তোমাদের বাসায় হাজির হলে সবাই ভাববে , আমি কি করে জানলাম তুমি কাল বিকেলে ভিজেছো আর এর জন্য তুমি টনসিলের ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছো! কি করবো বলো! প্রেমে পড়লে ছেলেরা যে বোকা হয়ে যায়, তা তো তুমি জানোই! একদিন তোমাকে বলেছিলাম, "ওভাবে জানালা বন্ধ করো কেন? আমি তোমাকে খুব বিরক্ত করি? আর তাকিয়ে থাকবো না তুমি বৃষ্টিতে হাত ভিজাবার সময় " । একদম সরাসরি আমার দিকে তাকিয়েছিলে তুমি। তোমার চোখে পানি যেন উপচে পড়বে তখনই ! "তুমি না দেখলে আমিও আর হাত ভিজাবো না"। আমি কিছু বলতে পারিনি আর! কিইবা বলা যায় তোমার মত পাগলীকে!

কোনদিন ভার্সিটি থেকে ফিরতে সন্ধ্যার একটু পর হলেই বাসায় এসে দেখতাম তুমি হাজির! আমার মায়ের সাথে বসে গল্প করছো! আর আড়চখে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছো! আম্মা নাস্তা আনার জন্য সরলেই শুরু হয়ে যেত তোমার বাক্য বর্ষন! "নিশ্চই অনেক বান্ধবী হয়েছে ভার্সিটিতে, তাইতো আড্ডা দিয়ে আসতে এত দেরি হলো! ভার্সিটির ওরকম নতুন নতুন সুন্দরীদের দেখলে কি আর মাথা ঠিক থাকে?" সারাদিন ক্লাশ করে , এরপর আবার ভার্সিটির বাসে প্রায় ঝুলে ঝুলে বাসায় এসে তোমার এই কথা শুনে আমার রাগ করার কথা! কিন্তু না, আমার একটুও রাগ হতো না! বরং ভাল লাগত! কেন? কি জানি , এটাকেই ভালবাসা বলে কিনা! এই পিছুটান , শৃঙ্খলের বাঁধাটাই যেন সন্ধ্যা গুলোকে ভরিয়ে দিতো!

পহেলা বৈশাখের দিন লাল-সাদা শাড়ি পড়ে আমাদের বাসায় এসেছিলে তুমি। আম্মা তোমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন , "নীহার তোকে তো পরীর মত লাগছে! " পাশেই ছিলাম আমি। চোখ-মুখ কুঁচকে বলেছিলাম "ধুর ওকে তো পেত্নীর মত লাগছে! তোমার চোখটা গেছে মা! " কিছু বলোনি তুমি। কিন্তু যেই তুমি আ্মাদের বাসায় এসেছিলে আমার সাথে পাশের পাড়ার মেলায় যেতে সেই তুমি তক্ষুনি বাসায় গিয়ে হাতের চুড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলেছিলে, রুনুকে প্রচন্ড জোরে চড় মেরে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলে! উফ, সামান্য রসিকতার কি মূল্যটাই না আমাকে দিতে হয়েছিলো! কত সাধ্য-সাধনা, কৌশল করে তোমাকে সেদিন বিকেলে মেলায় নিয়ে যেতে পেরেছিলাম!

নীহার আমার দিনগুলো কাটছিলো ইচ্ছে পূরনের হাত ধরে। কি ঘোরলাগা সেই দিনগুলো। কিন্তু ছন্দ থাকলে যে তার ছন্দ পতন ও হয় । হঠাৎ করেই মারা গেলেন বাবা। বাবার রেখে যাওয়া বিশাল ঋনের বোঝা দেখে আক্ষরিক অর্থেই মাথায় হাত পড়ল আমাদের। সদ্য পাশ করা আমি তখন বিধবা মা, ঋনের বোঝা আর ছোট তিন ভাই-বোনের চিন্তায় দিশেহারা। পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি একটু খড় -কুটো! যদি আঁকড়ে ধরে স্রোতের তীব্র টান সামলানো যায়! তুমি মাঝেই মাঝেই আসতে আমাদের বাসায়। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই রুনু এসে তোমাকে ডেকে নিয়ে যেত তোমার মায়ের কথা বলে। আস্তে আস্তে অদৃশ্য হতে লাগল তোমার ছায়া। আমি জানতাম তোমার কোন দোষ নেই। তোমার বাসা থেকেই তুমি বন্দী। তবু ও যেদিন শুনেছিলাম তোমাকে আজ দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম তোমাদের বাসায়। অনেকক্ষন বসেছিলাম , সেই ঘরটায়, তোমাদের সেই বসার ঘরটায়। কেউ আসে নি। কাজের বুয়া শুধু এসে এক কাপ চা দিয়ে গিয়েছিলো। অনেকক্ষন পর রুনু এসে নীচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেছিলো , "আপনি চলে যান হাসান ভাই। কেন বসে আছেন এখনো"। আমি চলে এসেছিলাম ,নীরবে। তোমার বিয়ের দিন কোন অনুভুতিই আমাকে স্পর্শ করেনি, শুধুমাত্র তীব্র বোধহীনতা গ্রাস করে নিয়েছিলো। আজো জানিনা কেন সেদিন সারারাত রাস্তায় হেঁটেছিলাম পাগলের মত ! সেই শুরু হলো আমার রাত জাগার গল্প। আজো জেগে আছি! তাইতো এই মধ্যরাতে তোমাকে আবোল-তাবোল চিঠি লিখছি!

মা নেই অনেক দিন হলো। বদলে গেছে অনেক কিছুই। যেই আমি খড়-কুটো ধরতে চেয়েছিলাম একদিন বাঁচার আশায় সেই আমিই যেন আজ মহীরুহ! তোমাদের বাড়িটা আছে আগের মতই!। রুনুর বর সন্ধ্যার পর কলেজ থেকে ফিরলে মাঝে মাঝেই ওরা দুজন আসে আমাদের এখানে। আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না। প্রচন্ড সঙ্কোচ হয়। আর তোমাকে তো চিঠি লিখছিই! তুমি তো আমাকে সব জানাবেই। এবার বিদায়, অনেক রাত হলো। আজ আর না। তোমার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি,
আমি

বাতাসের ঝাপটা কমে গেছে অনেকখানি। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে আরো জোরে। অদ্ভুত নেশা ধরানো একটানা শব্দ। চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরলাম। এবার ঢুকিয়ে দিলাম ড্রয়ারে। কতগুলো চিঠি জমলো? জানি না, জানা হয় না। কিন্তু এরকম নির্জন রাত গুলোতে খুব ইচ্ছে হয় আমার, চিঠি লিখি। সেই মানুষটাকে যার বৃষ্টি ভেজা হাত ছুঁয়ে দেখা হয় নি কোনদিন, হবেও না। আরো জোরে নামল বৃষ্টি । মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে জানালার পাশে এসে বসলাম আমি, সেই জানালাটার পাশে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৪
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনে হাসি আর কান্না.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

জীবনে হাসি আর কান্না.....

কবি সুনির্মল বসু তার "হবুচন্দ্রের আইন" কবিতায় হবুচন্দ্র রাজা আইন করে কান্না নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ এখন সেই কল্পিত কবিতার রাজা হবুচন্দ্রের মতো আইন করে কান্না নিষিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

'৭৪ সালের কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল এখন সময়ের দাবী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৫


বিগত আম্লিক সরকারের আমলে যে কুখ্যাত আইনের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করে গায়েব করার চেষ্টা চলতো তা হলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইন ব্যবহার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণচোখ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৩৮


(ষড়ঋপু সিরিজের তৃতীয় কাহিনি — লোভ)

⸻ সতর্কীকরণ: ছায়া পড়লে আলোও কাঁপে ⸻

এই কাহিনি কেবল একটি গল্প নয়। এটি এক মানসিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে লুকিয়ে আছে মানব আত্মার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এসব লুটপাটের শেষ কোথায়!

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:১৮

আধা লিটারের পানির বোতল দোকানদার কেনে সর্বোচ্চ ১২.৫০ টাকায় আর ভোক্তার কাছে বিক্রি করে ২০ টাকা। এগুলো কি ডাকাতি না?

গোপন সূত্রে যতটুকু জানা যায়,
প্রাণ ৮.৫ টাকা কেনা
ফ্রেশ ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চারুকলায় আগুনে পুড়ে গেল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের শোভাযাত্রা উদ্‌যাপনের জন্য বানানো দুটি মোটিফ আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও আরেকটি শান্তির পায়রা।



আজ শনিবার সকালে চারুকলা অনুষদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×