এই মুহুর্তে আমার যেটা খুব প্রয়োজন তা হচ্ছে গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলা। শীতকাল বলে অভ্যেস মতই এই জিনিস গায়ে চড়িয়ে বের হয়েছিলাম। কিন্তু বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই যেভাবে রোদ উঠল অসহ্য লাগছে এখন। এর উপর বাসের কোন খোঁজ নেই। আজ আবার অফিসে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নতুন চাকরি, এখনই বসের গরম চোখ দেখার কোন মানে নেই! সাত -পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন জ্যাকেটটা খোলার জন্য একটু ঘুরে দাঁড়ালাম, তখনই শুনলাম , "এক্সকিউজ মি, একটু যেতে দেন "। কথাটা কানে আসার সাথে সাথেই আমার ইচ্ছে হল "ওরে বাবারে , গেছিরে ", বলে বিকট এক চিৎকার দিতে! কেননা কেউ একজন তার হিল জুতা দিয়ে আমার পায়ের উপর কঠিন এক পাড়া দিয়েছে! কিন্তু অতি ভদ্রতার খাতিরে এই চিৎকার চেপে রেখে যখন মুখ তুলে তাকালাম, তখন দেখলাম এক জোড়া দুঃখিত চোখ! "আমি খুব স্যরি, আসলে লাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া আমার উচিত হয় নি "। "না, না ঠিক আছে। তবে হিল জুতার উচ্চতা আরেকটু কম হলে ভালো হয়!"। কথাটা বলে নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে! নিশ্চই এখন কঠিন কিছু শুনতে হবে আমাকে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা। "আপনি মজা করে কথা বলেন! " এর মধ্যে বাস চলে এসেছে। কোনমতে একটা হাসি দিয়ে লাইনের পিছু হাঁটা শুরু করলাম।
সপ্তাহে ছয়দিন এই লাইনে দাঁড়ানো আমার জন্য অপরিহার্য। সদ্য পাশ করে বেরিয়েছি । বাসার সামনের রাস্তা থেকে অফিসে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এই বাস। কাজেই এ ছাড়া উপায় নেই। সি এন জির কথা ভাবতেও ভয় লাগে! পরদিন সকালে একটু দেরিই হয়ে গেল আমার বাস কাউন্টারে পৌঁছাতে। ভাগ্য ভালো, বাসটা এই মাত্র এলো। তাড়াহুড়ো করে টিকেট নিয়ে লাইনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল সামনের একরাশ কালো চুল! মনে মনে বললাম , " কে তুমি কেশবতী! " হায়, কিন্তু সেই কেশবতী বাসের পা দানিতে পা রাখতেই হেল্পার বলল, সিট শেষ! পরেরটায় আসেন! রাগে আমার তখন চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। "আরে মিয়া আমার দেরী হয়ে গেছে, একজন দাঁড়ায় গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না", এই কথা শেষ করার আগেই হেল্পার মিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! ঠিক তখনই সামনে দেখলাম গতকালের চোখ দুটো! আচ্ছা, ইনিই সেই কেশবতী! "আপনার বোধ হয় খুব তাড়া, আপনি যান" । "আরে না, অসুবিধা নাই!আপনি আবার লাইনে দাঁড়াবেন নাকি। যান আপনি"। "আপনি তো অদ্ভুত লোক। যান । আমার সমস্যা নেই। " ড্রাইভার ততক্ষনে অস্থির! সুতরাং উঠে গেলাম আমি বাসে। বাসে উঠে মনে মনে হাসলাম, বেচারী আমার পায়ে পাড়া দেয়ার কথা মনে রেখেছে!
পর পর কয়েকদিন দেখলাম , মেয়েটা আর আমি প্রায় একই সময়ে লাইনে এসে দাঁড়াই। নিশ্চই আশেপাশে কোথাও থাকে। দিন তিনেক পর সাহস করে যখন পাশের সিটে বসলাম, তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল মেয়েটা, "কেমন আছেন?"। "ভালো, সেদিনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, আমার অবাক লেগেছে যখন দেখলাম আপনি আমাকে মনে রেখেছেন! ", হাসতে হাসতেই জবাব এলো, "মনে রাখব না? আপনি তো আমাকে হিলের উচ্চতা কমানোর পরামর্শ দিলেন! ফ্রীতে অনেক উপদেশই পাওয়া যায়! কিন্তু অচেনা মানুষের কাছে এমন উপদেশ! " লজ্জায় রীতিমত নিজের উপর রাগ এসে গেল আমার! কি দরকার ছিল এভাবে পাশে সিটে বসার? "রেগে গেলেন নাকি? আমি কিন্তু মজা করছি! "। কিছুক্ষনের মধ্যেই জানা হয়ে গেল নাম, কে কোথায় থাকি, কি করি! জানলাম ও একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছে। থাকে আমাদের কছেই,নতুন এসেছে । এই কারনেই এই প্রত্যহ দেখা!
এর পরের কিছুদিন কিভাবে গেল , কি হল আমি কিছু জানি না! যেই আমি ভার্সিটি লাইফে নিজের ব্যাচের মেয়েদের সাথেও লজ্জায় কখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারি নি , সেই আমি কিভাবে প্রিয়ন্তীর ফোন নম্বর চাইলাম্ , কথা বললাম! এখন আবার বসে আছি একটা রেস্টুরেন্ট এ! "কি ব্যাপার চুপ করে আছো কেন?" স্বভাবসুলভ মিটিমিটি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল ও। "দেখো একটা কথা বলা দরকার"। "বলে ফেলো"। "রাগ করো না যেন"। "তুমি দেখি বাচ্চাদের মত কথা বলছ ! " । "তোমাকে আমার ভালো লাগে, খুব! ", প্রায় মরিয়া হয়ে কথাগুলো বলে ফেললাম আমি! "কথাটা আরো আগে বললে কি খুব অসুবিধে হত?" , এই প্রথম প্রিয়ন্তীকে লজ্জা পেতে দেখলাম আমি!
ইশ, আজ তো প্রিয়ন্তীর পরীক্ষা, এখনো আসছে না কেন? লাইনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে ভাবছি আমি। কিছুক্ষন পরেই ওকে দেখলাম প্রায় দৌঁড়ে আসতে। দেরি হয়ে গেল না তোমার ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। "খুব বেশি না, এখন বাসে উঠলেই হবে"। "চলো তোমাকে সি এন জিতে দিয়ে আসি"। "কথা কম বলো তো। এখন তোমার কাছে এমনিতেই টাকা নেই। মাসের শেষ", ধমক খেলাম একটা! হায় , কি ভাগ্য! আজ আমি এসে দাঁড়াতেই সিট শেষ! ইচ্ছে ছিল ওর সাথে যাব, ওকে ভার্সিটি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাব। হলো না! "তুমি আজ যাও! আমকে যেমন একদিন তুমি যেতে দিয়েছিলে!" "না, তোমার সাথে যাবো", বলল ও। "পাগল নাকি! তোমার দেরি হয়ে যাবে। যাও তো" , রীতিমত বকা দিয়েই বাসে উঠালাম ওকে। হেসে উঠ গেল ও।
পনের মিনিট পর যখন কাউণ্টারে দাঁড়িয়ে শুনলাম আগের বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে , আমি জানি না কিভাবে ছুটে গিয়েছিলাম। মাথায় আঘাত পেয়েছিল ও । চব্বিশ ঘন্টা পর ডাক্তার যখন জানালো , ওর জ্ঞান আর কখনো ফিরবে না, আমি কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষন শূন্য চোখে তাকিয়েছিলাম ডাক্তারের দিকে।
"ভাই এবার আমি যাই। আপনি তো লেখালেখি করেন, তাই আপনাকে বললাম কথাগুলো। একটা গল্প লিখবেন প্লিজ এটা নিয়ে? আটটা বেজে গেছে। আমাকে আবার বাসের লাইনে দাঁড়াতে হবে"। তাড়াহুড়ো করেই উঠে গেল ছেলেটা। নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম আমি। সকাল সাতটায় যখন আমাকে ঘুম থেকে তুলে ময়লা গেঞ্জি পরা উদভ্রান্ত চেহারার এই ছেলেটা কিছু কথা বলতে চাইলো, তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ওর গালে একটা থাপ্পড় মারি। কিন্তু তার প্রবল আগ্রহের কারনেই বিরক্তি চেপে কথা শুনতে রাজি হয়েছিলাম। ছেলেটা চলে যেতেই আমার রুমে যে ছেলেটা কাজ করে ও এলো। " ভাইজান, ওই পাগলটা আপনার এখানে আইছিলো ক্যান"? বলল ও। "পাগল?", কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি আমি। "হ , হারাদিন ওই রাস্তার মোড়ের বাস কাউন্টারে দাঁড়ায় থাহে । হে কোথাও যায় না। খালি লাইনে দাঁড়ায় থাহে আর নিজের লগে কথা কয়। পুরাই পাগলা"।
মাস তিনেক পরে বাস কাউন্টার টার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঝুম বৃষ্টির মাঝে দেখলাম একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কাউন্টারের মাঝে দাঁড়ালেও ছেলেটা বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছে। হয়ত অপেক্ষা করছে ও, কোন ছায়ামানবীর জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৬