খুব স্পষ্টভাবেই মনে পড়ে দিনটার কথা। বাবার ছোট্ট দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বছর ছয়েকের এক পিচ্চি ছেলে। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। রাস্তার ওপাশে বিক্রি হচ্ছে ঈদ কার্ড। জানি না এটা কি জিনিস, কিন্তু জানি এটা খুব সুন্দর আর এটা ঈদের আগে সবাইকে দিতে হয়! পাশের বাসার রুম্পা আমাকে একটা দিয়েছে! মুহুর্তেই আবদার, "বাবা,আমি কার্ড কিনব "। খুব কঠিনভাবেই জবাব এ্লো, এসব কেনা যাবে না। অবুঝ আমি চিৎকার করে উঠলাম।পরিনামে জোর একটা চড় এসে পড়ল আমার গালে। কেন জানি সেদিন কান্না পায়নি, শুধু অবাক লেগেছিল। বাসার সামনের রাস্তাটায় রোজ বিকেলে কালো , শুকনোমত একটা ছেলে অনেকগুলো রঙ্গিন বেলুন নিয়ে আসত এক হাতে ধরে। কি সুন্দর! এগুলো নাকি ছেড়ে দিলেই আকাশের ও পাশের রাজ্যে চলে যায়! মেঘগুলোকে নাকি ছুঁয়ে দেয় এই রঙ্গিন বেলুন গুলো! বিশ্বাসই হয় না আমার! এত এত দূরে যায় বেলুন? "মা আমাকে বেলুন কিনে দাও না"। নিজের ঘরের জানালার সাথে বেঁধে রাখার জন্য নয় , আকাশের মেঘগুলোকে ছুঁয়ে দেয়ার জন্যই এই ইচ্ছে আমার। না, কখনোই আমাকে বেলুন কিনে দেয়া হত না। আকাশের ওপাশের রাজ্যেও কখনো যাওয়া হত না। জানি না, আজ ও কেন যেন আমার সেই বেলুন কেনার ইচ্ছে যায়নি! চলতি পথে যখন দেখি কোন ক্লান্ত বেলুন ওয়ালা হতাশ চোখে এদিক -ওদিক তাকাচ্ছে কোন মানুষের খোঁজে, আমি এক পা-দু পা করে এগিয়ে যাই। সম্মোহিতের মত বেলুন গুলোর সামনে দাঁড়াই। না, কেনা হয় না। হয়ত আকাশের ওপাশের রাজ্য আমার জন্য নিষিদ্ধ।
শৈশবের এই অপুর্ণতাই হয়ত আমাকে শিখিয়েছিল নির্লিপ্ততার ভাষা। তাইতো কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলোতে যখন মধ্য দুপুরে আমার বন্ধুরা তাদের সদ্য কেনা সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত পুরো এলাকা, আমি চুপচাপ বসে থাকতাম ছোট মাঠের এক প্রান্তের শিমুল গাছটার নিচে। কিংবা কখনো হতাম কারো দ্বি চক্র যানের পেছন সঙ্গী! পিকনিক পিকনিক! তুমুল উত্তেজনা! সমস্ত উত্তেজনা আর আগ্রহ যখন দু'চোখে নিয়ে এসে মায়ের সামনে দাঁড়াতাম, শুকনো মুখে আমাকে শুনতে হত"এসব বিলাসিতা আমাদের জন্য নয়। এত বড় হয়েছো তুমি, আমাদের অবস্থা তো জানোই"। বন্ধুরা নৌকায় করে নদীর ওপাড় চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম আমি। ঠিক তারপরই এক পাশের নিরিবিলি ঘাটটাতে বসতাম নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে।
খুব অল্প কিছু নিজস্ব স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যখন চলে এলাম এই বিরাট শহরটাতে , তখন যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম আমি। যাক, এবার আমার নিজের জীবন! কিন্তু এই জীবনেও যে প্রতি মাসেই বাড়ি থেকে নিয়মিত টাকা না পাওয়া , টিউশনি লাইফের অপমান আর প্রতি মুহুর্তে অস্তিত্বের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হবে তা কে জানত! সন্ধ্যার নিভে আসা আলোয় ধীর পায়ে বিষন্ন মনে হেঁটে আসা, এই আমার প্রতিদিনের গল্প।
আমার খুব মনে পড়ে সেই বৃষ্টির দিনটার কথা। তুমি-আমি এক সাথে একটা রিকশাকে ডেকেছিলাম। ল্যাব রিপোর্ট আনতে ভুলে যাওয়া আমি নিতান্ত সৌজন্যবোধের কারনেই তোমাকে বলেছিলাম রিকশায় উঠতে। যে অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা দেখেছিলাম তোমার, তাতেই যে আমি পাগলের মত
ভিজতে ভিজতে হলে ছুটেছিলাম , তা ভাবলে আজো হাসি পায়! এরপর.....কত বিকেল-মধ্য দুপুর কিংবা কুয়াশা ঢাকা সকালে দেখেছিলাম তোমার সেই হাসি। আমার আবার ইচ্ছে হত আকাশে ওপাশের রাজ্যটাকে ছোঁয়ার , ঈদের দিন কয়েক আগে কারো হাতে একটা সুন্দর কার্ড তুলে দেয়ার! ইচ্ছে হত পুরো ক্যাম্পাসে সাইকেল নিয়ে একটা ছুট দিতে! কিন্তু......"তুমি আমাকে আজ বিয়ে করতে পারবে?", স্পষ্ট করেই প্রশ্নটা ছিল তোমার। " কি হয়েছে? এটা কি বলছ? "। তুমি কোন উত্তর দাওনি আর। সেই হাসিটাও আর দেখা হয়নি আমার।
আজ ও যখন আমি আমার স্বপ্নগুলো জামার বুক পকেটে জমা রেখে একা হেঁটে আসি রাস্তা ধরে , তখন আর দশজনের মত রাস্তায় পড়ে থাকা নুড়ি পাথরকে লাথি মারতে পারি না প্রচন্ড তীব্রতায়। হয়তোবা আমার মতই অনেকগুলো না ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে পথের ধুলি মেখে চিৎ হয়ে আকাশ দেখে নুড়ি পাথরটা। আমি লাথি মারতে পারি না, প্রচন্ড মায়া লাগে। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে চলে আসি। ঠিক এভাবেই হয়ত আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় আমার স্বপ্নগুলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৬