প্রকান্ড দোতলা বাড়িটার সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম আমি ,তখন প্রায় শেষ বিকেল। বিকেলের আলোয় বাড়িটাকে দেখাচ্ছে কেমন যেন এক ক্লান্ত বৃদ্ধের মত। বাড়িটার অবস্থা দেখে কিছুটা হতাশই হলাম। কিন্তু রিপা ততক্ষনে চেঁচিয়ে ঊঠেছে, " কি সুন্দর বাড়ি!' " এই বলে । আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ওর দিকে তাকালাম। আসলে এখানে আসার ইচ্ছে আমার একদমই ছিল না । রিপার ইচ্ছেতেই আসা। রিপার চিৎকার শুনেই বোধ হয় বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন। চিনতে এক মুহুর্ত ও দেরি হল না আমার। সলিম চাচা। , "কে ,কে", কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করতে করতে সামনে এসে দাঁড়ান চাচা। আমার দিকে ভালো করে তাকাতেই, " তুই ? এতদিন পরে? তুই সত্যি?", বলতে বলতে চাচা যেন হতভম্ব হয়ে যান! কে্ননা পাশে দাঁড়ানো রিপাকেও দেখতে পেয়েছেন ততক্ষনে! "বউরে নিয়ে আসছিস? ", শান্ত -সুবোধ মেয়ের মত রিপা চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করে! ততক্ষনে চাচার অনুচ্চ চিৎকারেই পাশের বাড়ি গুলোর অনেকেই এসে গেছে।
সন্ধ্যা না মিলাতেই আশেপাশের প্রায় সব বাড়ির সবাই চলে এল। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। জানুয়ারী মাসের এই তীব্র শীতে কনকন করে কাঁপতে কাঁপতে চাদর গায়ে জড়িয়ে উঠোনে এসে চেয়ার পেতে বসেছি আমরা কয়েকজন। আমরা মানে আমি, সলিম চাচা, সহ গ্রামের আরো কয়েকজন মুরুব্বী। সবাই জানতে উদগ্রীব , এতদিন পরে ,বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে একেবারে বউ নিয়ে গ্রামে হাজির কেন আমি! সলিম চাচা চুপ করে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। চাচা গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী করতেন। এখন অবসরে। বাবা-মামা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়িটা তিনিই দেখে রেখেছেন। কিন্তু সময়ের অভাবে কখনোই চাচার সাথে যেভাবে যোগাযোগ করা হয়নি। বিয়ের সময় এসে চাচাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি-পত্র ও তেমন দেয়া হত না। বার বার বলতেন একবার গ্রামে আসার জন্য। কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া হত না। "বাবা দেশের অবস্থা কেমন?", উদ্বিগ্ন মুখেই জানতে চান আসাদ চাচা । "দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না চাচা। ঢাকা থেকে ওরা সব বাঙালি অফিসারদের বদলি করে দিচ্ছে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন নতুন লোক আসছে। কি যে হচ্ছে আমি নিজেও ঠিক জানি না"। "তোকেও বদলি করে দিয়েছে নাকি?", সলিম চাচা এতক্ষন পরে মুখ খোলেন। "হ্যাঁ চাচা, আমাদের এই থানাতেই", স্থির দৃষ্টিতে চাচার দিকে তাকিয়ে বলি আমি। "ঢাকা থেকে একেবারে এই থানায়?, কি হচ্ছে এসব?", চাচা বিড় বিড় করে বলেন। ভিতর থেকে ততক্ষনে শুনতে পাচ্ছি অনেক কথা! "বউ তুমার চেহারা-ছবি তো খুব সুন্দর!", বয়স্ক কেউ একজন বললেন, " সন্ধ্যার পর পুস্কনীর ধারে একলা যাইও না"। হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম আমি! আমি চাইছিলাম একেবারে সরকারি কোয়ার্টারেই উঠতে। কিন্তু রিপা জেদ ধরল ,সে কিছুদিন গ্রামে থাকবে বলে। অদ্ভুত এক মেয়ে!"নিজের থানায় এসে নিজের গ্রামে থাকবে না? ", ঘাড়টাকে একদিকে বাঁকিয়ে চোখটা বড় বড় করে বলেছিল ও। আমার পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয়নি।
বহুদিন পরে এক অন্যরকম সকাল দেখছি আমি। নিস্তব্ধ কুয়াশায় চারদিক যেন ডুবে গেছে। দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। এত ভোরে ঢাকায় থাকতে কখনোই ওঠা হয় না। আমাদের বাড়িটার ডান পাশে পুকুর, এর উপর দিয়ে তাকালেই ওপাশে ধান ক্ষেত। এখন ধান নেই ক্ষেতে। যতদূর চোখ যায় শুধু কুয়াশা এখন। ছোটবেলাতে কত মালকোঁচা মেরে হা-ডু-ডু খেলেছি এই ক্ষেতে! "তুমি উঠে গেছ?", ঘুম ঘুম চোখে রিপা পাশে এসে দাঁড়ায়। "ইশ , কি সুন্দর!", "তুমি কি করে দেখছো সুন্দর! তুমি তো এখনো চোখই খোলনি ঠিকমত!", হাসতে হাসতে বলি আমি। "এত কথা বলো না, আমার হাতটা খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটু ঘষে দাওনা! ", হাসতে হাসতেই ওর হাত দুটো আমার হাতের ভিতর নিয়ে নেই। কি যে অদ্ভুত ভালো লাগে বিয়ের পাঁচ বছর পর ও এই মেয়েটার হাত ধরতে!
এই কয়েকদিন আমি মাইল দুয়েক হেঁটে প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছি। তেমন কোন কাজই নেই অফিসে। সব কিছুই যেন থম মেরে আছে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন নিয়ে নানা রকম গুজব চারদিকে। গুজবটাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত। শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়া হচ্ছে না। মার্চের শুরু থেকেই তুমুল উত্তেজনা। প্রতিদিনই গ্রামে মিছিল হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ বলে গভীর রাতেও কোন কোন তরুন চিৎকার করে উঠছে। কি যে আনন্দ এই শব্দটা শুনতে! সত্যি কি স্বাধীন হব আমরা?
পুকুর পাড়ে বসেছিলাম আমি আর রিপা। "তুমি কি জানো , গ্রামে আমাদের নিয়ে কত হাসাহসি হয়!", চাপা হাসি হাসতেই হাসতেই কথাটা বলে রিপা। "কেন?"। "এই যে তুমি আমি একসাথে সন্ধ্যার আগে হাঁটতে বের হই! মাঝে মাঝে বিলের পাড়ে যাই! "এসব নিয়েই ওরা হাসাহাসি করে! "কি করব বলো! সবই আমার কপাল!" "মানে?", অবাক হয়ে জানতে চায় রিপা। "প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস.....তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ", মানে বুঝেছো এবার?
মার্চের আটাশ তারিখে আমাদের এখানকার থানা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে নিল স্থানীয় লোকজন। বক্কর ভাই এসে বলল, "অস্ত্র গুলা আমরা তোমার কাছেই রাখতে চাই। ভারতে যাওয়ার সময় যাকে যাকে অস্ত্র দেয়া হবে তা তুমি আর হাবিলদার ইউসুফ মিয়া ঠিক করবা"। অমত করার প্রশ্নই আসে না। রক্তে যেন আগুন জ্বলছে। পুরো ঢাকার সব বা্ঙালিকে নাকি মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা। মানুষ প্রান ভয়ে ছুটে আসছে গ্রামে। এর প্রতিশোধ আমরা নিব না? অবশ্যই নিব। এপ্রিলের ষোল তারিখে যখন বাসার উঠোনে দাঁড়ালাম আমি, তখন রিপা চুপচাপ বসে আছে দাওয়ার উপরে। "তুমি যাচ্ছ যাও। আমি তোমার জন্য অপে্ক্ষা করব"। "রিপা দুটো রাইফেল রইল বাড়িতে। সলিম চাচা আছেন। সাবধানে থেকো"। পিছন থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ শুনলাম আমি। কিন্তু না, আমি এখন পিছনে ফিরে তাকাব না। কক্ষনো না।
খুব অচেনা লাগছে গ্রামটাকে। গ্রামের শুরুতেই আজিজ চাচার টিনের বাড়ি ছিল। কোন চিহ্নই নেই ওটার। বক্কর ভাইয়ের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রহমান কে দেখা গেল। ছুটে এসে সে জিজ্ঞেস করল, " রায়হান ভাই, বাঁইচা আছেন? ভাই বাঁইচা আছেন আপনে? " রহমান কাঁদতে থাকে। "ভাইজান মইরা গেছে। আব্বারে ওরা ডাইকা নিয়া গুলি কইরা মারছে। আমি পলায় আছিলাম ডোবার ভিতরে"। "রহমান , আমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছে?", ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে ধাক্কা দিয়ে বাড়িতে দৌঁড়ে যাই। " আজরফ রাজাকার আপনে যাওয়ার দুই মাস পরেই মিলিটারিরে যায়ে আপনার কথা কইয়া দিছিল। হেয় মিলিটারি নিয়া আইছিল আমাগো গ্রামে। ভাবী আর সলিম চাচা দোতলার উপর থিকা গুলি কইরা দুইটা মিলিটারী মারছিল।গুলি শেষ হইয়া যাওনের আগে , ভাবী মাথায় গুলি কইরা .......চাচারে উঠানের মাঝখানে বেয়নেট দিয়া খুঁচায়ে মারছে", একটানে কথাগুলো বলে রহমান কাঁদতে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না আমার কি করা উচিত। শুধু বুঝতে পারি শূন্য লাগছে অসম্ভব শূন্য লাগছে। একটা চুড়ি পরা হাতের কথা মনে পড়ছে, দুটো চোখের কথা মনে পড়ছে , বোধ হয় আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।
এই চল্লিশ বছর পরেও আমি গভীর রাতে সেই চুড়ির শব্দ শুনি। পুকুর ঘাটটা আগের মতই আছে। গ্রামের পথ গুলোও পরিবর্তন হয়নি। এখনো আকাশ ঢেকে দেয়া কুয়াশা পড়ে। বিকেলগুলোতে এখন আমি একাই মাঠের ধারটায় বসে থাকি। তুমি নেই? কক্ষনো না। তুমি আমার পাশেই আছো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১৫