মাঝে মাঝে পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে। মনে হয় এখনো সেই দিনগুলো চির নতুন, চির দুরন্ত।
দেখতে দেখতে বয়স পঞ্চাশের কোঠায় পৌছে গেলো। জানিনা আর কত দিন, কখন অন্য দেশের দূত এসে আমার দরোজার কপাটে আঘাত দিয়ে মনে করে দিবে, " সময় হয়েছে না ফেরার দেশে ফিরে যাবার।"
আজ থেকে ঠিক ৪৬ বছর আগে, দিনটা সেদিন ১৫ ই ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে দেশের অনেক অঞ্চলেই স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছে। আগামী কাল ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় ভাবে আমরা পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তি পাবো। কি নিদারুণ এক স্বপ্নময় দিন। আমরা আর কারো দাস নই। নিজেই নিজের রাজা। ভাবতেই আমার কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছিল।
সচরাচর আমি তখন মায়ের সাথে ঘুমাতাম। বাবা আমাদের সাথে নেই। ৭ নম্বর সেক্টরে নাকি সে যুদ্ধ করছে। কিন্তু অনেকদিন যাবত কোন চিঠিপত্র পাইনি। মা খুব আশা করে বসে আছে। কাল সকালে বাবা আসবে লাল সবুজের পতাকা হাতে। আমিও বাবার অপেক্ষায়। অনেকদিন বাবাকে জড়িয়ে ধরি না, তার সাথে গঞ্জের হাটে যাই না। বাবা আসলে আবার আমি হাটে যাবো।
আমি আর মীনাক্ষী তখন কাছাকাছি বয়সের। আমি মাকে বলে একটি পতাকা বানিয়েছি। মীনাক্ষীর মা নেই। পাকিস্তানি হানাদাররা ওর মাকে একদিন রাতে তুলে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। মীনাক্ষীর দাদিমা একটি পতাকা বানিয়ে দিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঠিক ভোরে আজানের শব্দে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ দেখি মীনাক্ষী আমার হাত ধরে টানছে ঘুমের মাঝে। আমি ছোট ছোট ঘুম জরানো চোখে মীনাক্ষীর দিকে তাকিয়ে আছি। যেনো নতুন দিনের সূর্যের মত ওর উজ্জ্বল চোখদুটো জ্বল জ্বল করছে। আমাকে প্রায় টেনে ঘুম থেকে তুলে ফেলে। মীনাক্ষী আমকে বলেছিল, " তোর পতাকা কোথায়? " মা এর মধ্যে আমার আর মীনাক্ষীর পতাকায় দুটো ছোট লাঠি বেধে দেয়।
সেই ছোট চার বছরের বালিকার হাত ধরে লাল সবুজের পতাকা হাতে আমি আর মীনাক্ষী স্বাধীন বাংলার স্বাধীন পথে।
আমরা ছুটছি তো ছুটছি। হঠাৎ মীনাক্ষী চিৎকার করে উঠে "জয় বাংলা "। আমি ওর কন্ঠে কন্ঠে মিলিয়ে চিৎকার করি " জয় বাংলা - জয় বাংলা। " আমাদের চিৎকারে যেনো ভোরের পাখিদের ঘুম ভেঙে যায়। কিচিরমিচির শব্দে ওরা জানিয়ে দেয় মুক্ত বিহঙ্গের মত এই স্বাধীন বাংলার আকাশে আজ ওরাও স্বাধীন। আর কোন বুলেটের শব্দ, বাতাসে মিশে থাকা লাশের গন্ধে তাদের দম ফুরিয়ে আসবে না। আমি আর মীনাক্ষী - আমরা চিৎকার করি। জয় বাংলার চিৎকার, স্বাধীন কন্ঠে চিৎকার।
চিৎকার করতে করতে আমরা আমাদের স্কুল মাঠে আসি। অনেকদিন যাবত আমরা স্কুলে আসি না। স্কুল পাঙ্গনে পা দিয়েই দেখি আমার প্রিয় রাবুপু দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সে দিনের ছেঁড়া শাড়ি পড়ে। তখন আমি কিংবা মীনাক্ষী আমরা জানতাম না রাবুপুর সেই শাড়ি কেনো বা কিভাবে ছিঁড়েছিল? শুধু দেখেছি দ্বীর্ঘ নয়মাস যাবত বুবু একটি ছেঁড়া শাড়ি পড়ে আছে।
মীনাক্ষী আবার চিৎকার করে উঠলো " জয় বাংলা, জয় বাংলা। "
রাবুপু দৌড়ে এসে আমাকে আর মীনাক্ষী কে জড়িয়ে ধরলো। আমাদের জড়িয়ে বুবু গেয়ে উঠেছিল, " আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। "
আমার এখনো দিব্যি মনে পড়ে সেদিন আমি দেখেছিলাম, "রাবুপুর চোখে স্বচ্ছ স্ফটিক জল। "
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ১১:১৪