আকাশ গরীব ঘরের ছেলে। বাবা-মায়ের তাকে পড়ানোর সামর্থ নেই। তবু থেমে থাকেনি সে.. বরং বাবার পাশাপাশি সে-ও শাহবাগ এলাকায় পার্ট টাইম রিকশা চালিয়ে যতটুকু পারে আয় করে নিজের খরচ জোগায়। এরপরও কলেজের অন্যতম সেরা মেধাবী, মনোযোগী আর নিয়মিত ছাত্র সে। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই কলেজের প্রিন্সিপালের একটা কথা সদা তার কানে লেগে ছিলো, "যে শিক্ষার্থী বছরের প্রতিটা দিন ক্লাসে উপস্থিত থাকবে, ১টা দিনও মিস দিবে না- বছর শেষে তাকে সার্টিফিকেট আর ১হাজার টাকার একটা প্রাইজবন্ড দেয়া হবে ।"
সেই থেকে তার স্বপ্ন ওই ১হাজার টাকা । মায়ের ভালো কোনো কাপড় নেই, ছেঁড়া কাপড়ে মানুষের অপমান সয়েও অন্যের বাড়িতে কাজ করে, বাবা-র ছেঁড়া লুঙ্গি দুটো সবসময় চোখে ভাসে। আহ! ওই হাজার টাকার প্রাইজবন্ডটা যদি পেয়ে যায়.. কিছুই না শুধু ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে, সে কি পারবে না!
কলেজে আজ সকাল ১১টায় ক্লাস হবার কথা। উপস্থিত থাকতে হবে দশ-পনেরো মিনিট আগে, এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন ফর্মের কিছু কাজ আছে। অাকাশের ইচ্ছা, ভোর থেকে ১০টার কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত যতটুকু পারে রিকশা চালিয়ে তারপর প্রতিদিনকার মতো কলেজের কাছের গ্যারেজটায় রিকশা রেখে কলেজে যাবে ।
তখন খুব সম্ভব সকাল সাড়ে ১০টার কিছুটা বেশি বাজে, অাকাশ সারাটা সকাল পুরান ঢাকার দিকে জ্যাম ঠেলে রিকশা চালিয়ে কার্জন হল থেকে যাত্রি নিয়ে শাহবাগ মোড়ের একটু আগে এসে নামিয়ে দিলো। এমনিতে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, কলেজে পৌঁছাতে ওখান থেকে আধ ঘন্টা লাগে তার উপর দেখলো চারপাশে মানুষ আর মানুষ! রিকশা ঘুরাতে যাবে অমনি হঠাত্ কোত্থেকে এক পুলিশ এসে হাতের লাঠিটা দিয়ে খুব জোড়ে তার রিকশায় বাড়ি মারা শুরু করলো, সামনে অনেক রিকশা-মানুষ থাকায় সে ঘুরাতেও পারছিলো না! কিন্তু পুলিশ এলো-পাথারি বাড়ি মেরেই যাচ্ছে আর ধমকাচ্ছে। সামনের রিকশার গায়ে বাড়ি মারতে যেয়ে একটা বাড়ি হঠাত্ আকাশের পায়ে লেগে গেলো। "উরে বাবারে..." বলে যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে বসে পড়তে নিয়েও পারলো না সে, পুলিশ তার অবস্থা দেখে পিঠেও শক্ত লাঠির আরেকটা বাড়ি মারলো। আকাশ সহ্য না করতে পেরে চিতকার করে বলে উঠলো, "বাইরান ক্যান! যাইতাসিই তো । সামনের রিকশাগুলি সরন লাগবো না??" কথা শুনে পুলিশটা রেগে গিয়ে ওর পায়ে একটা লাথি মেরে বললো, "আবার মুখের উপ্রে কথা কস!!! যা এইখান থন.. তর বাপেরা আইতাসে দেখস না! বেশি তেড়িবেড়ি করলে ওগো হাতে ছাইড়া দিমু, ল্যাঙটা কইরা ঘুরাইবো তরে..."
আকাশ কিছু না বলে কোনো মতে রিকশা নিয়ে ওই নরক থেকে সরে এলো। পা-ব্যাথায় রিকশা একটা টানও দিতে পারছিলো না, দাঁতে দাঁত চেপে পাটকাঠির মতো শরীরটার সমস্ত শক্তি বের করে রিকশা টেনে চললো... গাল বেয়ে দরদর করে ঘাম আর অশ্রু ঝড়ে পড়ছে তবু থামছে না সে । কলেজে এখন পৌঁছাতেই হবে! কিন্তু ততক্ষণে ১১ টা বাজতে কেবল দশ মিনিট বাকি, আর সামনেই বড় বড় মিছিল, জ্যাম। পারলে তো সে হেটেই কলেজে চলে যেতো, কিন্তু রিকশা তো ফেলে যাওয়া সম্ভব না, আবার এই জ্যাম ঠেলে কয়টা বাজবে কলেজে যেতে তারও ঠিক নেই। আকাশ ঠিক কি করবে বুঝতে পারলো না.. পায়ের তীব্র ব্যাথা নিয়ে, রিকশায় বসে তার হান্ড্রেড পার্সেন্ট উপস্থিতির সেই ১হাজার টাকা, মায়ের ১টা শাড়ি বাবার ১টা লুঙ্গি, বাবা-মায়ের গর্বিত হাসি চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
দৃষ্টি ক্রমেই ঘোলা থেকে আরো ঘোলা হয়ে আসলো, আর সামনের মিছিলের ধ্বনিটা কানে এসে বিষের মতো বিঁধতে লাগলো, "ছাত্রলীগ মহান হও, সোনার সুন্দর বাংলা গড়ো। জয় বাংলা..."
আজ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকলে খুব আনন্দ করছে। বুঝলাম বাঙালি খুব উত্সব পাগল জাতি আর আজ আনন্দের দিনে একটু তো আনন্দ করতেই হয়!
কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, এর কতটা ভয়ংকর দিকও ছিলো! এই দিনটার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ কি করছিলো? একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন-আগ্রহ-উত্সাহ তার নিজ দেশের মানুষই ধ্বংস করে দিলে সে এই দেশকে কি দিবে?
যেই তথাকথিত 'জনসেবক'রা দেশের জনগনকেই সারাটাদিনের ভোগান্তিতে ফেলে, একটা শিক্ষার্থীর স্বপ্নকে এভাবে ধ্বংস করে দেয় তারা কি করে মহান হতে পারে আমি জানি না! তারা কি করে দেশের সুন্দর ভবিষ্যত্ হতে পারে আমি জানি না! তারা কি করে বঙ্গবন্ধুর পবিত্র আওয়ামিলীগ দলে ঢুকে এই দলেরই ভবিষ্যত হতে পারে তা আমি জানি না! আমি সত্যিই জানি না...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৪:০৪