somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরিজ রিভিউঃ পৃথিবী তাদের ওপর নির্ভর করেছিলো আর তারা একে অপরের উপর (Band of Brothers)

২৯ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Band of Brothers (HBO Miniseries) – 10 Episode

পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বাজেটে নির্মিত টিভি সিরিজের লিষ্টে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১ম স্থানে থাকা সিরিজটির সাথে।


সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। যারা বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস আর ইউরোপ, আমেরিকার ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি জানেন তারা জেনে থাকবে যে ইউরোপ এবং আমেরিকার ভূখন্ড সম্পূর্ণ আলাদা। যুদ্ধ প্রথমত শুরু হয় আমেরিকা এবং জাপানের মধ্যে। কিন্তু, পরবর্তীতে বৃটেন, রাশিয়া, ইতালি, জার্মানির মতো দেশও এতে যোগ দিলে ইউরোপেই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্ববৃহৎ রণক্ষেত্র। আমেরিকা ও ইউরোপ আলাদা ভূখন্ড হওয়ার পরও এ যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যরা পুরোপুরি তাদের নিজ দেশের বাইরে ব্যাপক পরাক্রমশালী ভূমিকা রাখে তাদের এয়ারফোর্স এবং নেভি সীলের সাহায্যে। বলতে গেলে এ যুদ্ধে ইউ.এস. এয়ারফোর্সের ভূমিকা অপরিসীম কারণ, দু ভূখন্ডের মাঝে বিশাল সমুদ্র থাকায় আমেরিকান মিলিটারিদের ইউরোপে আক্রমণের জন্য বিমান ছিলো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তার মধ্যে বিশেষ করে এয়ারফোর্সের প্যারাট্রুপার দের ভূমিকা অসামান্য। প্যারাট্রুপারদের জঘন্য সব জায়গায় উড়োজাহাজ হতে মাটিতে ল্যান্ড করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হতো। নিজ দেশের বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জায়গায়, আলাদা পরিবেশে একই সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হতো তাদের।

লেখা কৃতজ্ঞতাঃ Shahriar Kamal Siddiquee Sourav (ফেবু)

হলিউডের সবচাইতে বাস্তবিক নির্মাতা Steven Spielberg এবং অন্যতম শ্রেষ্ট অভিনেতা Tom Hanks এর একটি অনবদ্য নন-ফিকশনাল প্রোডাকশন। প্রায় শ’খানেকের উপর অভিনেতা মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেছেন এবং মোট ৯ জন ডিরেক্টর এই সিরিজের ১০ টি এপিসোডের ডিরেকশন দিয়েছেন। প্রতিটি ডিরেকশনেই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের টানাপোড়েন, হাসি, কান্না, আবেগ, বন্ধুত্ব আর ভয়াবহতাগুলো উনারা আমাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অসাধারণরূপে হাজির করিয়েছেন।

গল্প শুরু হয় ইউ.এস. এয়ারফোর্সের একটি মিলিটারি ইউনিট “Easy Company” র ইউরোপে লড়াই করে যাওয়া সৈন্যদের নিয়ে। কম্পানির ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে শুরু করে যুদ্ধ করতে যাওয়া, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সারভাইভ করা এবং পুরো সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জার্মান সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষে জার্মানিতে ঢুকে হিটলারের Eagles Nest দখল করা পর্যন্ত সব খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই সিরিজটি মূলত বিখ্যাত আমেরিকান বায়োগ্রাফার Stephen E Embrose (দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বায়োগ্রাফি লেখক) রচিত Band of Brothers, E Company, 506th Regiment, 101st Airborne: From Normandy to Hitler’s Eagle’s Nest (1992) বইয়ের এবং D-Day (1994) বইয়ের আংশিক এর মিলিত মোশন পিকচার ভার্সন। এই বিখ্যাত বায়োগ্রাফার ১৯৮৮ সালে Easy Company, Dog Company, Fox Company সহ U.S. Airborne এর বিভিন্ন কম্পানিতে থাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের বেঁচে যাওয়া সদস্যদের কাছ থেকে সবগুলো বাস্তব ঘটনা একত্রিত করে বই দুটোতে লিপিবদ্ধ করেন।

সিরিজের মূল গল্প Easy Company কে ঘীরে সংঘটিত যুদ্ধকালীন বিভিন্ন অপারেশন এবং সারভাইভিং নিয়ে। পুরো সময় যুদ্ধে তাদের কম্পানি বেশিরভাগ সৈন্যকেই যুদ্ধক্ষেত্রে হারায়। সিরিজে ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যুগুলো এতোটাই বাস্তবিকভাবে টেনে আনা হয়েছে যে স্ক্রিণে তাকালে বুঝার উপায় থাকেনা এটা ১৯৪৫ সাল নাকি ২০১৮ সালে। যুদ্ধে একটা সৈন্যের জীবন কতোটা তুচ্ছ আর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ কতোটা হিংস্র আর নির্মম সেটা এ সিরিজটা না দেখলে অজানাই থেকে যাবে।


D-Day তে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে কম্পানির মেজর মারা যাবার পর একজন সিনিয়র ল্যাফটেন্যান্ট এর অসামান্য নেতৃত্বে একটি কম্পানিকে এগিয়ে নেয়া এবং সফল হওয়া। পরবর্তীতে মেজর হিসেবে তার ডেডিকেশন, কঠিন থেকেও কঠিনতর সময়ে একটি মিলিটারি ইউনিটকে নেতৃত্ব প্রদান করে ইউ.এস. থেকে ইউরোপের একাধিক দেশে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অবশেষে জার্মানি অবধি নিয়ে যাওয়ার এই বাস্তব গল্প কল্পনাকেও হার মানায়।

- সেকেন্ডের ব্যবধানে পাশেই যুদ্ধরত একজন সহকর্মীর মাথায় গুলি ঢুকে যাওয়া…
- যার সাথে একটু আগেও চিল্লায়ে কথা বলতে বলতে রাইফেলে ফায়ার করা হচ্ছিলো হঠাৎ তার মাথা চোখের সামনে উড়ে যাওয়া, আর মুহূর্তে সব নিরব …
- নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া নিথর দেহের পাশে শুয়ে লড়াই করা…
- প্রচন্ড বোম্বিং এর সময় গর্তে ঢুকে থাকা দুই সহযোদ্ধা অপরজনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ডাকতে ডাকতে ওই আশ্রয়দাতা দুজনের শরীরই বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া…
- যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ পা হারিয়ে ফেলা বন্ধুকে কাঁধে তুলে আনতে গিয়ে নিজেরই পা হারিয়ে ফেলা…
- নিজের চোখের সামনে নিজের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দেখা…
- পাশে যুদ্ধরত বন্ধুর গলায় গুলি বিঁধে যাবার পর অনবরত গুলি বর্ষণের শিকার হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করতে না পারা। সাহায্য করার কথা দিয়েও মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর বন্ধুকে যুদ্ধের মাঠে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে প্রাণ নিয়ে কোনরকম চলে আসা…
- যুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ করে মিলিটারি বেস এ এসে লন্ড্রিতে কাপড়ের জন্য গিয়ে যুদ্ধে যাবার আগে লন্ড্রিতে দিয়ে যাওয়া অনেকগুলো মৃত সহযোদ্ধার কাপড়ের বান্ডেল দেখে হতভম্ব হয়ে যাওয়া…
- যুদ্ধের মাঠে স্ত্রীর ডিভোর্সলেটার হাতে পাওয়া…
- যে ডাক্তার পুরো যুদ্ধকালীন সময় ধরে জীবন বাজি রেখে কম্পানির আহত সৈন্যদের সেবা করেছেন, শেষ মিলিটারি অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসার অভাবে তারই মৃত্যু, আর মৃত্যুর সময় একটাই চিৎকার “I don’t wanna die”


এমন অনেকগুলো ঘটনার ফ্লো প্রতিটা মুহুর্তে বুক কাঁপিয়ে তুলে। একটা মাত্র কম্পানির সাথে এতোটা ভয়াবহতা কল্পনা করতে পারা যায় না। তাহলে ১৯৩৯-১৯৪৫ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার ব্যাটালিয়নের লক্ষ লক্ষ কম্পানির মিলিটারিদের সারভাইভিং পিরিয়ড় কতোটা ভয়াবহ ছিলো তা কোনোদিনও ভাবা সম্ভব নয়…

যুদ্ধের সময়কার পলিটিক্স আর অন্যান্য বৈশ্বিক দন্ধের কথা হয়তো বই পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু, যুদ্ধের মাঠে একজন যুদ্ধরত সৈন্য কতোটা অসহায় আর নিঃস্ব তা ওই যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফেরা সৈন্যরা ছাড়া কারো পক্ষে ছিটেফোঁটাও আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
হাজারো চৌকস প্রাণের বলিদান হওয়া সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭২ বছর পরও যদি কোনোভাবে একবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখে আসার অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় তাহলেই একমাত্র সেই ধ্বংসযজ্ঞ আঁচ করতে পারা যাবে। তাই.. Band of Brothers দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঠে একটি কমপ্লিট টাইম ট্রাভেল।


সিরিজ শেষে Major Richard Winters (Dick) এর মতো কম্পানি লিডার, Captain Lewis Nixon এর মতো ব্যাটালিয়ন লিড়ার, Bill Guarnere এর মতো বন্ধু, Technical Sergeant Donald Malarkey এর মতো সাহসী টেকনিক্যাল সার্জেন্ট, Blithe Albert এর মতো ঘুরে দাড়ানো সৈনিক, Doctor Grade Eugene এর মতো জীবনবাজী রেখে সাহায্য করে যাওয়া ডাক্তার, Frank Perconte, Ed Heffron, Amos Taylor, , Shifty Power, Carwood Lipton এর বেঁচে যাওয়া যাওয়া, পঙ্গু হওয়া এবং মারা যাওয়া শতো সৈন্যরা কোনদিনও মন থেকে হারাবে না। এরা কোন গল্পের হিরো নয়, বাস্তব হিরো। যাদের বাস্তব গল্পের কাছে হাজারো কাল্পনিক গল্প তুচ্ছ…


সবশেষে সিরিজের Easy Company লিডার Major Dick Winters এর নিজমুখে দেয়া সেই উক্তি “Do you remember, the letter that Mike Ranne wrote me? You do? Do you remember how he ended it?
‘I cherish the memories of a question my grandson asked me the other day, when he said, ‘Grandpa, were you a hero in the war?’ Grandpa said, ‘No, but I served in a company of heroes’

এই উক্তিটার মর্ম এখন হয়তো বুঝা যাচ্ছেনা। পুরো সিরিজ শেষেই এই কথাটির যথার্থতা আর গভীরতা বুঝতে পারা যায়....


লেখা কৃতজ্ঞতাঃ Shahriar Kamal Siddiquee Sourav (ফেবু)



সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৮ রাত ২:২০
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×