খুব ছোট বেলায় যখন গ্রামে থাকতাম তখন একবার চাচা কোথা থেকে দুইটা খরগোশ নিয়ে আসছিলেন পালার জন্য। খুব মজা করে দেখতাম চাচার আদিখ্যেতা! সকালে গাজর, দুপুরে চাল-ডাল, বিকেলে গাজর আর সাথে সাগু! হুট করে দুই সপ্তাহের মাথায় খরগোশদু'টোর একটা মরে গেল। চাচার সে কি কষ্ট। সে কি কান্নাকাটি। মনে হয়, ওনার মা মারা গেলেও এত ব্যথিত হতেন না!! ঠিক তার দু'দিন পর অবশিষ্ট যে খরগোশটি আছে সেটিও চাচাকে আরো শোকের সাগরে ভাসিয়ে আমাদের গুডবাই জানিয়ে তার বন্ধুর কাছে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম চাচার আচরণে। একেবারে চুপচাপ, কোন টুঁ শব্দটিও করলেন না।
আমাদের ইন্টারের ব্যাচ ২০০৫. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব। তাদের সবার সাথে হয়ত তেমন পরিচয়ও নেই। কিন্তু তাও হঠাৎ করে কোথাও রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, শপিং কোর্টে দেখা হলে যখন বলে ওঠে, "তুই 'এ না??" মনের মাঝে কোথাও যেন একটা টান লাগে। আরে, এ তো আমারই বন্ধু। আয় দোস্ত, বুকে আয়।
ইদানীং, কি যেন একটা হয়েছে। কোন কিছুই আর ভালো লাগে না। কারো সাথেই আর বন্ধুত্ব করতে ভালো লাগে না। সবকিছুতেই কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব। যাহ্ বেটা ভাগ, তোমার সাথে কথা বলব না, ভাল্লাগে না।
হুট করে গত মার্চ-এপ্রিল'র দিকে একটা নিউজ পত্রিকায় দেখলাম, "খাগড়াছড়িতে গাড়ি দুঘর্টনায় ১১ জন নিহত।" গা কর্লাম না। রোজই তো কত দুঘর্টনার খবর আসে। বিকেলের দিকে ফেইসবুকে ছেলেদের স্ট্যাটাস, "কপিল আর নাই।" সাথে সাথে ফোন, কি ব্যাপার ঘটনা কি? "কলেজিয়েটের কপিল"। গ্রেট!!
মে মাসেই খুব সম্ভবত: আবারও ফেইসবুক স্ট্যাটাস, "এইটা কি করলি দোস্ত?" ঘটনা কি? "আই.ইউ.টি.র ছেলে জাফলংয়ে.."
গত মাসে আবারো স্ট্যাটাস, "আর.এফ.এস.টি একটা ফাউল জিনিস।" ঘটনা কি? "এস.এস.এম.সি'র দুইটা ছেলে.. "
প্রথম ঘটনায় সহমর্মিতা, পরেরগুলা তেমন একটা গায়ে লাগে নাই। ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। শুধু ব্যাচমেট। হয়ত, পাথর হওয়ার সূচনা।
অনেকদিন পর, কাল নেটে এক্সেস পেলাম। ব্লগারদের পোস্ট পড়ছি, মন্তব্য করছি, সাথে ফেইসবুকও খোলা। দেখছি, ছেলেরা আবারো স্ট্যাটাস দিচ্ছে, "R.I.P. miss u AVI" মনে করলাম আরেকটা ব্যাচমেট। আহা। তখনো ভালো করে বুঝি নি। রাত প্রায় দেড়টার দিকে এক বন্ধুর ফোন, "অভিষেকের ঘটনা শুনছিস??" সাথে সাথে মাথায় আসল একটা গাট্টা-গোট্টা, চুপচাপ, হাসিখুশি, হাতে লাল রঙের সুতো বাঁধা একটা ছেলের মুখ। তাও জিজ্ঞেস করি, "কোন অভিষেক?" "চিটাং কলেজের। এখন সি.এম.সি.। পুকুরের পানিতে.. " আমি আর কথা বাড়াই না। ফোনটা রেখে দেই।
একে একে সবার স্ট্যাটাস, ফোনের পর ফোন, এস.এম.এস। তখনো শিওর করে কেউ বলতে পারে না, ঠিক কি হয়েছে, কি করে এক্সিডেন্ট?
সারারাত ঠিকমত ঘুম হয়না। গত পূজায়ও যার সাথে মন্ডপে মন্ডপে লাফালাফি, নাচানাচি.. আর দেখা হবে না তার সাথে?
সকালে উঠেই মেডিকেল। প্রথমবারের মত মর্গ দেখা। যে অটোপসি রুমে গত পরশুও ক্লাশ করে গেল, আজ সেখানে, সেই বিছানায় সে নিজে শুয়ে। কি সুন্দর, গাট্টাগোট্টা শরীর। তখনো তার মুখের কোণে সেই চিরচেনা হাসি। একে একে বন্ধুরা আসতে থাকে। একেকজনের মুখ পাথরের মত। হুট করে একজন কেঁদে দেয়। আমার কান্না আসে না। হয়ত ছোটবেলার সেই চাচার মত অবস্থা।
সেখান থেকে বাসায় নেয়া হয়। বন্ধুরা, তার আত্মীয়রা সবাই ভীড় করি বাসায়। মা'র সে কি অবস্থা। থাক, সেটা না হয় আড়ালই থাক। আর বাবা? নিজে হার্টের রোগী, বাইপাস করা। তিনি তো বাইরে চুপচাপ, শান্ত। ভেতরে কি অবস্থা, সে তো অনুমেয়। সেটাও থাক। বাচ্চা একটা মেয়ে, কে তা জানি না। দাদা, দাদা করে চিৎকার। হয়ত, কাজিন। খুব করে হয়ত ভালোবাসত ছোট্ট বোনটাকে। কে জানে? আর, তার খুব কাছের বন্ধু যারা? যে ছেলেটার পাশে বসে গত চারটি বছর ক্লাস করেছে? অথবা, সেই ছেলেটি, যার সাথে রোজ সকালে ক্যাম্পাসে যেত রিকশা করে? সবই থাক।
সেখানে থেকে শ্মশানঘাট। আমি আর যাই না। ভাল্লাগে না। দায়িত্ব এড়াই। হয়ত, নিজের কাছ থেকেই নিজেকে পালিয়ে নিতে চাই। শুধু ফেরার সময়, একটা বন্ধুর একটা কথাই কানে বাজে, "ওর বিয়েতেও হয়ত আমরা এতজন আসতাম না। একটা মৃত্যু অনেক কিছু বদলে দেয়।"