হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক যিনি তার পাঠককে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। হয়ত মিস গাইডও করতেন কিন্তু তার দায় লেখকের না। যখন আমি প্রথম হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ি তখন আমি ক্লাস সিক্স এ পড়ি। প্রথম বইটা ছিল 'অনন্ত অম্বরে'। সেখানে একটা লাইন ছিল এমন - "এ আমার আপন আধার"। কথাটা আজও আমি আমার ব্যক্তিজীবনে ব্যবহার করি। আমার পরিবারের কাছে যে কথা আমি বলতে চাই না সেখানে আমি কিছুটা কমিক করে বলি, "এ কথা তোমাদের বলব না, এ আমার আপন আধার।" আমার বউ এ কথা শুনলেই রেগে যায়। কারন তাকে বলব না এমন কিছু থাকুক সে চায় না। কিন্তু এ লাইনটা বলতে আমার খুব ভাল লাগে। 'গৌরীপুর জংশন' বইয়ে এক নারী চরিত্র আরেকজনের সাথে পরিচয় হওয়াকে "চিন পরিচয়' বলেছিল। আমি আজও এই শব্দ ব্যবহার করি। হুমায়ূন আহমেদ তার এক ছেলেকে 'ছোট্ট আব্বু' বলে সম্বোধন করেছিল। ডাকটা ভাল লাগায় আমিও মাঝে মাঝে আমার ছেলেকে এভাবে আদর করে ডাকি। তার আরেকটি বইয়ের নাম 'এই শুভ্র, এই' এর মত করে আমারও ডাকতে ভাল লাগে। অফিসে আমাদের প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। যেদিন আমি যাব না সেদিন কলিগদের হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নামের মত করে বলি "আজ আমি কোথাও যাব না"। তার 'কবি' বইয়ে নায়কের নাম মুহিব। আহা কত আনন্দ নিয়েই না বইটা পড়তাম।
খুব অল্প বয়সে পড়ার জন্য কিছুটা পাকনামি আমার মধ্যে এসে পড়েছিল। এই যেমন তখন আমি রাতের বেলা না ঘুমিয়ে আমাদের বাসার করিডোরে হাটতাম। বৃষ্টিতে ভিজতাম। হিমু ভাবটা তো ভালই লাগত। কিন্তু আম্মার চেলাকাঠের কথা মনে করে আর ওই দিকে পা বাড়াই নি। মিসির আলীও অসাধারন লাগত। তখন আমি মিসির আলীকে অনুসরন করতাম। আন্দাজে কিছু বলতাম। আমার মনে আছে এই অভ্যাসের জন্য আমার বড় বোন আব্বার কাছে বিচার দিয়েছিল আমি নাকি হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরন করি।
নুহাশ পল্লী আমি কখনও যাই নি। পত্রিকায় যা আসে তা পড়ে পড়ে আমারও এমন একটি রিসোর্ট করার ইচ্ছা। তবে এত বড় না। কারন হুমায়ূন আহমেদের জ্ঞ্যান, আগ্রহ আর প্রয়োজন আমার সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ন না। তবুও গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ীর কথা ভাবতে ভাল লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ কত বড় লেখক তা আমি মাপতেও পারব না। জ্ঞান আহরনের জন্য পাঠ্য বই, রেফারেন্স বই আছে। সাহিত্য থেকে আনন্দ পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ন। আমি পেতাম, তাই পড়তাম। 'হোটেল গ্রেভার ইন' যে কতবার পড়েছি। যতক্ষন পড়ি ততক্ষনই ভাল লাগে। সব বই হয়ত ভাল লাগেনি। আমাদের এখানে সবচেয়ে যে ভাল ব্লগ লিখেন তার সব পোস্টই কি ভাল হয়? সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ল তা হল হুমায়ূন আহমেদ পড়তে পড়তে পড়ার আগ্রহ তৈরী হল। তারপর যখন তার বই হাতের কাছে পেতাম না তখন যা পেতাম তাই পড়তাম। এই করে করে হয়ত অনেক ভাল বই পড়া হয়েছে। এই যে আমি পড়ি তার কারন হুমায়ূন আহমেদ। যদিও এক্ষেত্র সেবা প্রকাশনী বা রকিব হাসানদের নামও আসে।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বলেই এদেশে প্রকাশনা শিল্প এতদূর এগিয়েছে। বইমেলায় তার জন্যই যাওয়া হয়। সাথে আরও কিছু যোগ হয় কিন্তু মূলটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের বই। তার বই পড়তে পড়তেই আমাদের পড়াই ভিতটা তৈরী হয়েছে। এখন যে কোন বইই পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি। খেয়াল করে দেখবেন আমাদের অনেকেই কখনও উপন্যাস পড়ে না। তাদের মধ্যে এই আগ্রহই কোন কালে তৈরী হয়নি। আমাদের যাদের মধ্যে হয়েছে তাদের অনেকের কারন 'হুমায়ূন আহমেদ'।
এমন এক মানুষ আজ চলে গেল। তার আত্না শান্তিতে থাকুক। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন বলে আমরা পড়তাম, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বলে আমি আজ পাঠক, হয়ত ব্লগারও।