একসময় আমরা একটা অসাধারণ জাতি ছিলাম। একটু মাথা খারাপ, একটু পাগলাটে আর অনেকখানি হৃদয়বান। তখন আমরা হিন্দু ছিলাম না, মুসলিম ছিলাম না, খৃষ্টান ছিলাম না, বৌদ্ধ ছিলাম না, আস্তিক ছিলাম না, নাস্তিকও ছিলাম না। আমরা শুধুই বাঙালি ছিলাম। বুকের গভীরে বাংলাদেশকে ধারণ করা বাঙালি। একজন আরেকজনের প্রতি গভীর মমতা নিয়ে বাস করা বাঙালি। আমরা অস্ট্রেলিয়ার সাথে ক্রিকেট ম্যাচের সময় নির্ঘাত হারব জেনেও শেষ বল পর্যন্ত রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতাম কোন একটা কাকতালীয় ব্যাপারের জন্য। হেরে গেলে শত্রুর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। জিতে গেলেও শত্রুর গলা জড়িয়ে ধরেই কাঁদতাম। কিন্তু এখন আর আমরা সেই বাঙালি নেই। আমরা এখন “সাকিব কোন প্লেয়ার হল" বলে “ম্যারি মি আফ্রিদি" প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এখন আমরা শুধুই হিন্দু, শুধুই মুসলিম, শুধুই আস্তিক, শুধুই নাস্তিক। আমরা একে অপর কে আঘাত করে বিমলানন্দ পাই! আরেকজনকে আঘাত করাটাই এখন আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
১৯৭১ সালে এদেশে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। কত আশা আর কত স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিল লক্ষ ছেলে! শুধু আমাদের জন্য, আমরা যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকি সেজন্য, আমরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারি সেজন্য, শুধুমাত্র সেজন্য ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। শুধু একটা অসাধারণ দেশের স্বপ্ন দেখেছিল বলে ২ লক্ষ মা বোনকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। ভাবা যায়?
এই দেশটা যখন স্বাধীন হয়েছিল তখন আক্ষরিক অর্থেই এটা ছিল একটা শ্মশান। শুধু একটা পোড়া জমি আর কিছু মৃতপ্রায় মানুষ নিয়ে একটা ছোট্ট দেশ। তলাবিহীন ঝুড়ি বলে গাল দেওয়ার পরও যাদের কিচ্ছু বলার ছিল না। এদেশের মানুষের সম্বল বলতে ছিল কেবল বুক ভরা স্বপ্ন। তারা ঘুমে- জাগরণে শুধুই লাল-সবুজ স্বপ্ন দেখতো। সেই স্বপ্নকে পুৃঁজি করে আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশ। আমরা স্বপ্ন পূরণ করে আরো বড় স্বপ্ন দেখেছি। সেটা পূরণ করে আরো বড় স্বপ্ন।
এদেশের মানুষ সম্ভবত এখন আর স্বপ্ন দেখে না। বরং যারা স্বপ্ন দেখে তাদের স্বপ্নকে অবলীলায় খুন করে। দুর্নীতি কী সেটা বোঝার আগেই শিশুর হাতে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন তুলে দেয়। সারাজীবন যে মেয়েটা মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে টাকার বিনিময়ে সেই স্বপ্নকে কিনে নেয় অন্য কেউ। অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন দেখা এখন এদেশে নিষিদ্ধ। স্বপ্ন দেখেছো কী তোমার ঘাড়ে এসে পড়বে ধারালো অস্ত্র। ব্যস। পৃথিবীতে তোমার জীবনের সেখানেই ইতি। তারপর যখন সেই স্বপ্নটা আরেকজন দেখা শুরু করবে তখন তাকেও মেরে ফেলবে ওরা। তারপর একটা সময় সবাই স্বপ্ন দেখতে ভয় পাবে। কেউ আর স্বপ্ন দেখবে না। স্বপ্নকে পুৃঁজি করে যে দেশটা তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে সেই দেশটা যদি হুট করে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয় তাহলে দুঃস্বপ্নেরা হানা দেবে সে দেশে। সেদিনের পদশব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনারা কী পাচ্ছেন না?
সময় এসেছে এক হওয়ার। আসুন আমরা সবাই আবার বাঙালি হই। আবার কাঁধে কাঁধ মেলাই। হিন্দু, মুসলিম আস্তিক, নাস্তিক সবাই আমরা বাংলাদেশ হই।
দুঃস্বপ্নদের আটকানোর এখনই সময়। অনেক কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই দেশ। একে এত সহজে হারতে দেওয়া যায় না। ৭১ আবার ফিরে এসেছে। এখন সময় যুদ্ধে যাওয়ার। এই যুদ্ধ ন্যায়ের। এই যুদ্ধ দেশপ্রেমের। এ যুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার। এ যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বেড়ানো যায় না। আছেন কি কোন বাঙালি?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৬