১.
'হাজেন কাউকে খুন করতে পারে এ কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে- বিশ্বাস হয়না।'
আমরা মানে আমরা। যারা নপুংসকের দল। আমরা দিনের যাবতীয় অনর্থক ব্যস্ততা সেরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে হাঁটু পরিমান লুঙ্গি উলঙ্গ করে হারু মিয়ার চা দোকানে গিয়ে উপগত হয়ে সমাজ রাষ্ট্র উদ্ধার করি। আকিজ বিড়ির ফুটকি টানতে টানতে ঠোঁটের কালশিটে চামড়াকে আরো কালো করে তিন টাকায় এককাপ চা চারজনে গিলে খাই। নখের উল্টা চামড়া উত্থিত করে রক্তাক্ত আঙুলের ভাঁজে নুন রেখে চেটেপুটে পেটপূঁজা সারি। হারু মিয়ার ঘ্যান ঘ্যান সত্ত্বেও তার বেলাবিস্কুট আর গরম পানির চা'য়ের বাকী পড়ে যাওয়া হিসাবের পৌনে তিন টাকা ভুল ধরি। রফিকের বিশেষ অঙ্গের কাছাকাছি কোথায় বিষ ফোঁড়া উঠেছে সেটা আমাদের আলোচনায় চা'য়ের কাপে ঝড় তোলে। মালেক মহাজনের লাল গরুটার লেজের গোবরে পোকা কয়টা লেগে আছে সে হিসাব করতে গলদঘর্ম হই। কিন্তু, মালেক মহাজনের লেজের আগায় কয়টা কুত্তা বসত করে সে হিসাবে আমরা কোনদিনও যাইনা। আমাদের অনভ্যস্থ মুখ কখনো তেমন গুরু গম্ভীর আলোচনায় অংশগ্রহন করতে পারেনা বলে আমরা কখনোই আক্ষেপ করিনা। কারণ বিশেষ বিশেষ সময়ে যখন চৈত্রের খরতাপে বা শীতের বাতাসে আমাদের কর্মক্লান্ত ক্ষুধার গোড়াগুলো ভেঙে ভেঙে যায় তখন আমরা মালেক মহাজনের নুন খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকি।
আর তার চৌয়ারিতে গিয়ে মতিনের বউ কিভাবে পোয়াতি হল সে চিন্তা না করে বরং মতিনের বউ কেন মালেক মহাজনের বিরুদ্ধে সব ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়, সে জন্য তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে চলি। একটু পর পর মহাজনের পালিত কুত্তা, যে মহাজনের পিঠের ঘামাচি খুঁটে দেয় এবং পিঠ চুলকিয়ে দেয়, তাতে মহাজন আরামে চোখমুখ বুজে থাকেন, যখন গরম গরম নুন এনে পাতে দেয় তখন আমরা তার সবটুকুন জিহ্বায় চেটে খাই। অতএব, মহাজনের লেজে কয়টা কুত্তা থাকে সে অংক আমরা কষতে পারিনা।
২.
সূর্যটা যখন আঁচল দিঘীর পশ্চিম পাড় ঘেসে একবারে নিষ্প্রভ রঙে লজ্জিত হয়,আর বাঁশবাগানের পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে একটা সশব্দ শোরগোল পড়ে যায়, ঠিক তখন আমরা নপুংসকের দল কিচিরমিচির করতে করতে হারু মিয়ার ঝাপির নীচে এসে বসি। বাইরে একটা অসংযুক্ত টুল টেনে এনে পা তুলে নবাবের বাচ্চার ভঙ্গিতে মৌজ করি। কখনো অসতর্কতায় বকশো আলীর নিম্নবস্ত্র যদি কিঞ্চিত প্রদর্শিত হয়ে পড়ে আমরা মোটেও হৈ চৈ করি না। বরং আমরা ধৈর্য ধরে লুঙ্গির প্রান্তে লেগে থাকা নোবানের পলেস্তরা ঝেড়ে বসে হাত নাকের কাছে ধরে আতর গোলাপ জলের গন্ধ শুকি। হারু মিয়া কেতলির পুরাতন পাতা ফেলতে ফেলতে মুখ দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে চুক চুক শব্দ করে ।
'ম্যা ভাই, বিশ্বাসই হইতাছে না হাজেন এ কাম করবো। '
হারু মিয়া ফিসফিস করে বলে ওঠে।
আমাদের নপুংসকের দল হারু মিয়াকে বিষম ধমক দিয়ে থামিয়ে দিই। আর অনর্থক অযাচিত মন্তব্যের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করি। আমাদের চোখে তখন রনির নিথর লাশ কবরে শোয়ানোর ভাঁজ আর উদ্ধত ভঙ্গিতে হাতকড়া পরে দাঁড়িয়ে থাকা হাজেনের চোখ ভেসে ওঠে । হাজেনের চোখে আমরা যে নির্ভয়ের ছায়া দেখেছিলাম সে কথা আমরা বেমালুম ভুলে যেতে থাকি। আমরা নিজেদের ভেতর নিজেরা চাপা পড়ি। এবং মুখ ফসকেও উল্লেখ করিনা যে, হাজেনের মত প্রতিবাদী হয়ে ওঠা আমাদেরও দরকার কি না!
৩.
থানা পুলিশের গলা খাঁকাড়ি আর পাড়াময় গিজ গিজ উৎসুক মানুষের ধকল শেষে রনিকে প্রোথিত করা গেলেও তখন বেলা গড়িয়ে পড়েছিল আঁচল দিঘীর গভীর কালো জলে। রফিকের চাঁতালে দাঁড়িয়ে যখন আমরা আরো একটা আকিজ বিড়ি টানতে টানতে বিড়ির ফুটকি পর্যন্ত পৌঁছাই, তখন দিঘীর মধ্যে নিত্য জলকেলি করা হাঁসগুলো সন্ধ্যার আগে অসময়েই খোয়াড়বন্দী হতে চলে গিয়েছিল। দিঘীর উপর ভেসে থাকা পদ্মপাতাগুলো সারাদিনের শেষে নির্জীব হয়ে শুধু ভেসে ছিল। তাদের কারো কোন আগ্রহ ছিলনা অঞ্চলে কি ঘটছে। কারণ তারা অ-মানুষ। মানুষের মত করে তারা নিজেদেরকে ভাবতে পারেনা। মাঝে মাঝে তাদের মত অ-মানুষ হতে ভীষণ ইচ্ছে বেড়ে ওঠে।
'মহাজন, আপনে এদিকটা দেখেন আমি ওদিক সামলাবো। খালি খরচ পাতির ব্যাপার আরকি! বোঝেনইতো।'
বাম হাতের তালুতে লাঠি ঘষতে ঘষতে মহাজনের পাদদেশে বসে দারোগার আশ্বাস বানী ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সে আশ্বাস বানীতে থমথমে পাড়া গাঁ নীথর হয়ে পড়ে গভীর নিঃশ্বাস তুলে দম ফেলা শ্রমিক বা ফোঁস তোলা সাপের শান্ত হওয়ার মত। আমরা দারোগার কথা কানে তুলতে তুলনে পুরোনো ময়লা টুপিটা খুঁজে নিয়ে মসজিদের দিকে ছুটে যাই। মরণের চিন্তা আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে রনির মৃত্যুপরবর্তি অনেকটা সময়।
তারপর সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ছবীর মুন্সীর বাড়ীর নেড়ি কুকুরটার যে আর্তনাদ ছিল সেটাও নীরব হয়ে গেল। ডাকাতিয়া নদীর ঘোলা জল ততখানি নিঃশব্দে ফরসা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। এমনকি হারু মিয়ার কেতলির ঘমঘমে ধোঁয়াও আর আমরা উড়তে দেখিনি। অঞ্চলের কাউকে আর হাজেনের শেকল পরা হাতের চিত্র বনর্না করতে বা তার খুন পরবর্তী দাম্ভিক আত্মবিশ্বাসের ফুলকি কিংবা তার আশু পরিণতি সর্ম্পকে ভবিষ্যতবাণী করতে শোনা যায়নি।
৪.
অঞ্চলে আমার অল্পবিস্তর সুনাম ছিল। সে সুনামটুকু মুঠোফোন পূর্ব যুগে শহুরে কোন পড়ুয়া ছেলের বাপের কাছে টাকা চেয়ে পত্র পাঠানো সময়ের। তারা ছুটে আসতো কালো বা নীল হরফের কিছু অক্ষরের মানে বুঝতে। আমি অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত 'শিক্ষীত' হিসেবে তখন গাম্ভীর্যের সবটুকুন ঢেলে পত্রটি হাতে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বানানে ভুল পাঠ করতাম। সে ভুল পাঠে যদি 'পত্রখানি পাইয়া আমার জন্য দুই হাজার টাকা পাঠাইয়া দিবেন' কে তিন হাজার টাকা পড়তাম সেটা সত্য বলেই গণ্য হতো।
তো, সে সময় যখন দারিদ্রক্লিষ্ট হাজেন তার শহরবাসী মেয়ের বহুল আকাঙ্খিত পত্রটি নিয়ে আমার ডেরায় হাজিরা দিত, তখন মামার কাছে থেকে পড়ুয়া মেয়ের পত্রটি আমি যথা সম্ভব পাঠোদ্ধার শেষে ততধিক গম্ভীর মুখে সারবস্তু বোঝাতে গিয়ে তাকে বলতাম,
'তোমার মেয়ে অত্যধিক সুখে আছে। তোমার জন্য সামনের মাসে কিছু টাকা পাঠাবে। আর তুমি যেন কোনরুপ দু:শ্চিন্তা না কর।'
অত্যধিক আনন্দে গদগদ করতে করতে বউ মরা হাজেনকে দেখে আমার বিশ্রী হিংসা হ'তো। সরল আর বিনয়ী হাজেন ছিল একগুঁয়ে। রিকশা টানা পেশীবহুল শক্ত শরীরটা দুলিয়ে সে যখন হাসতো, তখন মনে হতো তার চোয়াল দু'টো কেউ দীর্ঘক্ষণ টেনে ধরে রেখেছে।
কিছুদিন পরে যখন শহর থেকে বার্তা এলো 'হাজেনের একমাত্র মেয়েটি কোন জটিল দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগে তার মায়ের পথ ধরেছে,' তখন অনেকেই দেখেছিল হাজেন তার রিকসার হুড তুলে তপ্ত দুপুরে আঁচল দিঘীর পাড়ে বসে বসে নীরবে জল ঝরাচ্ছে।
৫.
সন্ধ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে হারু মিয়ার চা'য়ের দোকানে আবার গুরুতর আলাপ জমে উঠলো। যদিও সে আলোচনা খুবই গোপনে এবং ফিসফিস করে। আলোচনা শেষে প্রত্যেকেই অলঙ্ঘনীয় সর্তকবানী দিতে ভুল করল না।
'সাবধান! এসব কথা না কওয়াই ভাল।'
কিন্তু কানাঘুষা চলতেই থাকে। এবং মিনতির মাঝে হাজেন যে তার মৃত মেয়ের ছায়া খুঁজে গিয়েছিল, সে আলোচনা সবাই আড়ালে আবডালে করতে থাকলো। ছিন্নবস্ত্রে হাজেন যখন রিকসায় প্যাডেল মেরে প্রায়শঃ সকালবেলা পিতৃহীন মিনতিকে উচ্চ বিদ্যালয়ের গন্ডি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতো, রনি'র খিস্তিখেউর সত্ত্বেও রিকসার হুড তুলে দিয়ে সাঁই করে তাকে পাশ কাটিয়ে যেত, তখন মিনতিকে ঘিরে চাপা উত্তেজনায় আমরা নপুংসকের দল মনে মনে রনির ছিন্ন কল্লাই কামনা করতাম। কারণ, আমরা রনির মত ক্ষমতাবানের ভাগ্নে নই; তার মত মনের কামনা-বাসনার কথা মিনতিকে অবলীলায় বলে দিতে পারতাম না। এবং তাকে 'বাগানে ফুটে থাকা ইরানী গোলাপ' বলেও সম্বোধন করতে পারতাম না।
রনি মালেক মহাজনের গৃহপালিত ছিল এবং তার পরিচয় ছিল কুত্তা রনি নামে। আমরা কদাচিত গোপনে তাকে সে নামে নিজেদের মধ্যে সম্বোধন করতাম। প্রকাশ্যে আমাদের সাহস হতোনা। কারণ, আমরা মালেক মহাজনের নুন খেতাম।
আমরা যখন ফসল শেষে কর্মহীন থাকতাম তখন মালেক মহাজনের বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুঁ দিলেই আমাদের প্রতি নুনের ছিটা আসতো। আমরা জিহ্বার অগ্রভাগে সেটা চেটে চেটে খেতাম। আর মালেক মহাজনের গুন গাইতাম।
এমনকি, যে রাতে কুত্তা রনি মিনতিকে এসিডে ঝলসে দিল এবং হাজেন ও অন্যান্যরা জ্ঞানশূন্য হয়ে ডাক্তার নিয়ে ছুটোছুটি করছিল, সেদিও আমরা মালেক মহাজনের নুন খেয়েছিলাম রাতের খাবারে। আর মিনতির ঝলসানো মুখটাকে কল্পনায় এঁকে সময় নষ্ট না করে আমরা ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম এই আলোচনা করতে করতে যে, শহরের বড় ডাক্তার ভাল করে ওষুধ করলেই এটা সেরে যাবে। কিন্তু মিনতির সীমাহীন কষ্ট আমরা দু'চোখে দেখার কোন প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ, নুন খেয়ে সেদিন আমাদের ভীষণ ঘুম পাচ্ছিলো।