বই ১) গণজাগরণের পূর্বাপর
লেখকঃ কবির য়াহমদ
২০১২ সালে বাংলাদেশে একটি ঘটনা ঘটেছিল ফেব্রুয়ারি’র ৫ তারিখে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত প্রথম ই-বুক শাহবাগের সাথে সংহতি আমার সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হয়। এই বিষয়টি আমার জন্যে ভীষণ গর্বের। আর এই বিষয়টি আরও বেশী গর্বের যে, আমার খুব কাছের লেখক বন্ধু কবির য়াহমদ, যিনি গণজাগরণ মঞ্চের নিবেদিতপ্রাণ ও সক্রিয়কর্মী; যিনি গণজাগরণকে খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন, তার বই এর প্রকাশ প্রিয় অনুপ্রাণন প্রকাশন করল। তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছেন গণজাগরণ ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত।
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
জাগরণের পূর্বাপর। কবির য়াহমদ।
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০১৪।
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন।
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান। পৃষ্ঠা: ৯৬।
মূল্য: ২০০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১৫০ টাকা।
লেখকের কথা
ইতিহাসের পাঠ, মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের এ পাঠ অধিকাংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সন্দেহ নেই। ব্যতিক্রমী পাঠের অনন্য নজির শাহবাগে গর্জে ওঠা তারুণ্যের আন্দোলন; গণজাগরণ আন্দোলন। শহীদ জননী যে শুরু করেছিলেন চেতনার অবিনশ্বর শিখা হয়ে তা ধরে রাখছে এই প্রজন্ম এবং ধারণ করে যাবে পরবর্তী প্রজন্মগুলো অনাদিকাল! একাত্তর বাংলাদেশে প্রমাণ করেছিল এখানে থাকতে হলে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবেই থাকবে হবে। ধর্ম যার যার দেশ সবার- এই আপ্তবাক্য বুকে ধারন করে দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম এবং অতঃপর বাংলাদেশ। অথচ একাত্তরের পরাজিত শত্রু পাকিস্তানি দল জামায়াত-শিবির একাত্তরে তাদের পরাজয়ের বদলা নিয়েছিল বিভিন্নভাবে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটি এক সময় আবারও সিদ্ধ হয়ে যায়, পেয়ে যায় রাজনীতির সুযোগ। যা আমাদের সবচেয়ে বড় লজ্জার ইতিহাস। আমরা লজ্জিত হই যখন দেখেছিলাম রাজাকারেরা মন্ত্রি হয়ে যায়, প্রাণের পতাকা উড়িয়ে ভেদ করে যায় রাজপথের বাতাস। হায় লজ্জা! অবাঞ্ছিত এক অধ্যায়!
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়কার সবচেয়ে কার্যকর গণআন্দোলন ২০১৩’র গণজাগরণ। রাজাকার কাদের মোল্লার প্রহসনের রায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ সেটা ছিল এক ইতিহাস। এই গণআন্দোলন সফল হয়েছিল। শাহবাগের গর্জনে সারাদেশ জেগেছিল। জেগেছিল সিলেট থেকে সারাদেশ।সিলেটে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে বুঝতে পারি এই দেশের মানুষ দেশকে কতখানি অন্তরে ধারণ করে, কতখানি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ ভুলে যায় তার অবস্থানের সাংঘর্ষিকতা।
‘জাগরণের পূর্বাপর’ মানবতাবিরোধী অপরাধী রাজাকারদের অপরাধের কিছু তথ্য, গণজাগরণ মঞ্চ পরবর্তী সময়ের দেশের পরিস্থিতির আলোকপাত, রাজাকারদের বিচার, হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবির এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়েই। এক তরুণ যেভাবে দেখে সময় আর দেশ- আমিও এর বাইরের কেউ নই। যেখানে চেতনায় জাগরূক সদা বাংলাদেশের হৃদয়, সেখানে আমি এক মুগ্ধ পথিক। আমি আমার চোখেই বাংলাদেশকে দেখি; বাংলাদেশও নিশ্চয়ই আমাকে দেখছে!
বই ২) গোধূলির প্রস্থানে জ্বালাও পূর্ণিমা
লেখকঃ কুহক মাহমুদ
বাংলা ব্লগের শুরু থেকেই লিখে যাচ্ছেন এই পাগলাটে লোকটা। ব্লগ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়েই তাকে সামনের সারিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু বেনামে চলার কারণে প্রাপ্য খ্যাতি কপালে জোটেনি। বাংলা ব্লগে তিনি কত নিকের অধিকারী আমার জানা নেই। কোন কবির এত নিক থাকতে পারে তা এই লোকের সাথে না মিশলে জানতাম না। বুড়ো বয়সে কবিতার সাথে পরকীয়া করা এই লোকটির এবারের বইমেলায় একটি সন্তান জন্ম হয়েছে। প্রথম প্রেমের মতই মধুর হোক এই বইমেলা তার জন্যে এই কামনাই করি। কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা ও নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসা যোগ্য।
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
গোধূলির প্রস্থানে জ্বালাও পূর্ণিমা
কুহক মাহমুদ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০১৪।
গোধূলির প্রস্থানে জ্বালাও পূর্ণিমা
প্রচ্ছদ: অনুপ্রাণন। পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
কবিতা হলো কবির যাপন, চিন্তা ও দর্শনের কাব্যায়ন। প্রথমত একজন কবিকে হতে হয় সচেতন যাপনকারী। সাধারণ চোখে দেখা জীবনের নানান ছবির ভিন্নতর সৌন্দর্যে উপস্থাপনই কবির কাজ। চিন্তা ও চেতনাগত উন্মেষ কবিতাকে সার্বজনীন করে। একজন ব্যাক্তি কবির উপলব্ধি হয়ে ওঠে সকলের সাধারণ কন্ঠস্বর। দর্শন শব্দটির রয়েছে ব্যাপক প্রপঞ্চ। যা দিনে দিনে কারো মনে আদর্শরূপ পায় না। হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রবাহমানতা হতে এটি গড়ে ওঠে। একজন কবি পাঠ ও যাপনের বহুরৈখিকতায় তা অর্জন করে। কবিতা অনেকভাবে করা যায়। কবিতা তার অবয়ব পায় কখনো ছন্দযুক্ত ভাবে আবার কখনো সরল কথনে। কবি কুহক মাহমুদের এ কাব্য গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যেন চমৎকার গদ্যকথন। কখনো এর ধরনকে বলা যায় কাব্যগল্প। কাব্য করে গল্প বলায় বেশ মুনসিয়ানা দেখিয়েছে কবি। কবির ঘটনাবহুল যাপনের নানান অনুষঙ্গ সাবলীল ও কাব্যময় কথনে উঠে এসেছে কবিতায়। কবি ব্যক্তিক ইচ্ছা, আকাংখ্যা, অনুভূতি, প্রেমকে বিভিন্ন আঙ্গিকের মাধ্যমে সার্বজনীন করে তোলেন একান্ত নিষ্ঠার সাথে। ভারতীয় দর্শনের সাবলীল ব্যবহার কবিতায় নতুন ব্যঞ্জনা প্রদান করেন। কবির নিজের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং কাব্যচর্চার জন্য তথাকথিত প্রতিষ্ঠাকে নিমেষে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত। নিজেকে 'ইতিহাসের ভ্রান্ত সৃষ্টি' বলে মানুষের পায়ের তলায় বসে থাকেন মানুষ হবে বলে। মানুষগুরুতে নিষ্ঠা স্থাপন করেন। যখন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কুকুরের পায়ের কাছে বসে থাকে মানুষের ভেতরের কুকুরকে আবিষ্কার করতে। কবি দিন যাপনের মাঝে কাব্য স্বরস্বতীকে ধরে রাখতে চান। কবি 'উম্মুল স্বভাবধারী রঙিন পানীয়ের বুদ্বুদে মেপে চলা মহাকালের ত্রিশঙ্কু'।
তিনি চান 'বাল্মীকি প্রত্যয় প্রসূনে আমি করোটির পূজারী হবো'। বাল্মীকি মহাকবি যার হাতে মহাকাব্য রামায়ণ রচিত হয়েছে। কবি তাঁকে কাব্যগুরম্ন হিসেবে মেধা বিকাশের দিক্ষা নিতে চান। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রতি আনুগত্য আমাদের মুগ্ধ করে। 'ঈশ্বর' কবিতায় কবির সাফল্যের সিঁড়িকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যাবার প্রত্যয় ফুটেছে।
বই ৩) ছায়াগুলো জেগে থাকে
লেখকঃ সোলায়মান সুমন
এ সময়ের তরুণ গল্পকার সোলায়মান সুমনের গল্পের মূল জায়গায় রয়েছে সমাজ ও শ্রেণি চেতনা। তার লেখার এই দিকটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তার বইয়ের সাফল্য কামনা করি।
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
ছায়াগুলো জেগে থাকে
লেখকঃ সোলায়মান সুমন
প্রচ্ছদ: অনুপ্রাণন। পৃষ্ঠা: ৬৪।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
জীবনের অসহনীয় বাস্তবতাকে তো গল্পকার উপেক্ষা করতে পারেন না। সুমন এভাবেই গল্প লেখেন। জাফর তালুকদার যেমনটা বলেন- 'এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর আমাকে টেনে নেয় সুমনের গল্প- যা ঠিক প্রচলিত ধারার নয়, পাঁচে পাঁচে দশ হবে তাও বলা যাবে না। অঙ্কের পুরনো পাঠের নিয়মে, ওঁর গল্প একের ভিতর বহু, একটি মুখের ভেতর অনেকগুলো মুখ, একটি চোখের ভেতর মাছির মতো ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য চোখ- কখনও তাঁর কাহিনি এগোয় সমান্তরাল ভঙ্গিতে, কখনও এবড়ো-থেবড়ো একেবারে রুক্ষ প্রান্তর যেন বা-ঠিক ছকে মেলে না, মেলানো যায় না প্রচলিত জীবনের হিসেব নিকেশও; তাঁর চরিত্ররা বহুমাত্রিক, ভাঙাচোরা, জটিল পোকাকাটা, কখনও আবার চোখ-ধাঁধানো, কিংবা নুয়ে পড়া, ধূসর ও উচ্ছলতার পরাগরেনু মেখে তারা ঘুরে বেড়ায়, হামা দেয়, অট্টহাস্য করে, অশ্রু ফেলে- এভাবে নানা কৌণিক বিণ্যাসে তারা দাঁড়ায়, আলো ফেলে, মঞ্চ থেকে নেমে আবার মিশে যায় অন্ধকারে। এই মানুষগুলো এভাবে ফিরে ফিরে আসে তাঁর গল্পে।' আরও গল্প আছে পাণ্ডুলিপিটিতে। কিন্তু সুমন যে ছায়াগুলোর জেগে থাকার আকাঙ্ক্ষা করেন সেই ছায়া সবসময় জেগে থাকে না। ছায়া যদি মানুষের অন্তর্গত বিবেক হয়, কোথায় তা? সুমন জানেন, হয়তো গভীরগোপন সত্তায় মানুষ একেবারে বিবেকবর্জিত হয় না। কিন্তু তাকে জেগে থাকা বলে না। নিভৃতে থাকার নাম গা বাঁচিয়ে থাকা। চরিত্রবান থাকার নাম হয়তো সুযোগের অভাব। গল্পের জন্য কাহিনি-চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে লেখককে দৃশ্যমান জগতকে পরিবর্তন করে নেন। সব লেখকই, এমনকি রবীন্দ্রনাথও কাহিনি বলবার জন্য চরিত্র বানিয়েছেন এবং বলতে গিয়ে বলে ফেলেছেন সমাজের, মানুষের আসল সত্যটাই। সুমনও পেরেছেন। মুখ ও মুখোশসমেত মানুষকে উন্মোচন করতে চেয়ে আমাদের যা চাক্ষুষ করিয়েছেন কখনো আমরা স্তম্ভিত হয়েছি, কখনো মুষড়ে গেছি, কখনো আশান্বিত হয়েছি, কখনো বেদনার্ত হয়েছি। কিন্তু যে ছায়ার জেগে থাকার প্রয়োজন মনে করেছেন সুমন, সে ছায়াটি অপস্রিয়মান। তবে সুমনের আকাঙ্ক্ষা যে আলোর সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়, আমরা ইঙ্গিতটুকু পেয়েই আর তৃপ্ত হতে চাই না। আমরা উদ্বোধন চাই সত্যের, দৃঢ় অভিব্যক্তির-নিজের মধ্যে; সুযোগের অভাবে আমরা চরিত্রবান হয়ে উঠতে চাই না। সুযোগ পেয়েও যেন অমানবিক সত্তাকে পেছনে ঠেলতে পারি। যেন নিভৃতে গা বাঁচিয়ে না চলে সামনে এসে দাঁড়াতে পারি। আর তখনই আমরা বলতে পারব- 'ছায়াগুলো জেগে আছে'।
গভীর গোপন সত্তা থেকে আমরা আকাঙ্ক্ষা করি- ছায়াগুলো জেগে থাক।
বই ৪)মেঘের দেশে ফিরে যাবার গল্প
সুলতানা শাহ্রিয়া পিউ
কবি ও আবৃত্তিকার সুলতানা শাহরিয়া আপা এবারে গল্প লিখেছেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ মেঘের দেশে ফিরে যাবার গল্প।
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
মেঘের দেশে ফিরে যাবার গল্প
সুলতানা শাহ্রিয়া পিউ
প্রচ্ছদ: অনুপ্রাণন। পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
গল্পের বাইরে লেখিকা এ বইতে যে সব গদ্য রচনা করেছেন সেগুলোও দুর্দান্ত এবং তুখোড়। এই অধিবাসের যে নিসর্গ, তার পরতে পরতে লেখিকা যেনো পাখি, প্রজাপতি এবং পছন্দের সূক্ষ্ণতা এবং ঘনিষ্ঠতার বিবরণ তুলে এনেছেন এবং রূপ, রস ও গন্ধের নির্যাস। এগুলোতে রয়েছে ফুলের-মৌ, খেজুর রসের মাতাল করা ঘ্রাণ, নবান্নের ঢেউ, শালিকের কিচির-মিচির, সমস্ত ঋতুবৈচিত্র, পূর্ণিমার জোছনা, একতারার বাউল, দেড়শতবর্ষী বটগাছ, কলমিলতা, কাঁদাজল সর্ষেক্ষেত, নদীপাড়, তৃনমূল, গাছ-গাছালি, ডালপুরি, লাল-চা, গোধূলীর লাল আভা, পুকুরের শ্যাওলা জলে হাঁসেদের জলকেলি, কুয়াশা ও শিশির স্নাত শীতের নবীণ প্রভাত, জুঁই ফোটার খেলা, গভীর রাতে বৃষ্টিপাত, হিজলের ছায়া, বেলী, কামিনী, রজনীগন্ধা, কাঁঠালচাপা, রংধনু তথা চিরদিনের বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র।
এছাড়া রয়েছে পহেলা বৈশাখ, ৭ই মার্চ, ১৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বরের মত অমোঘ দিবসগুলোর বাণী। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লেখা 'কেউ কোথাও নেই' পাঠককে বিষণ্ন করে তুলবে। তা এমনি স্মৃতি জাগানীয়া। এ বইটি স্বাধীনতার পক্ষের। মূলত স্বদেশ নিয়ে লেখা হলেও প্রবাস, প্রবাসী ও প্রবাসীর ব্যথা বর্ণনায় লেখক সফল। তার রচনা কৌশলকে ইংরেজি Laconic শব্দটি নিয়ে প্রকাশ করা যায়। চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলে দ্রুত এবং সংক্ষিপ্ত দৃশ্য গ্রহণের মাধ্যমে লেখিকা খুব কম জায়গা নিয়ে জীবনের গভীর বাণীচিত্র এঁকেছেন।
পিউ'র উপজিব্যের প্রবণতা ও ঝোঁক এবং লেখনিশৈলী, মূলত একজন গদ্যকারের চেয়ে কাব্যকারের। তার সৃজনশীলতার দক্ষতা রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে নিসর্গ বিষয়ে বেশি। মানুষের জীবনের সংকটে বিধাতার ও ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের ভূমিকার ব্যাপারে লেখিকা সম্ভবত সন্দিহান। তিনি প্রশ্ন করেছেন- 'সাভার গার্মেন্টস দূর্ঘটনার আগে ওখানের একজনও কী নির্ধারিত প্রাসঙ্গিক স্তোত্র পাঠ করেননি?' এখানে পাঠক জহির রায়হানের 'বরফ গলা নদী'তে উচ্চারিত জীবন জিজ্ঞাসার কথা মনে পড়বে।
বই ৫)যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব
আশরাফ জুয়েল
ফেসবুকে যারা লেখালেখি করেন, তারা অনেকেই আশরাফ জুয়েলের কবিতা পড়েছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব
আশরাফ জুয়েল
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান। পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
শিরোনামহীন কবিতাটি চমকপ্রদ শব্দযোজনা ও অল্প টানে আঁকা গভীর সঞ্চারী ছবি। প্রথম পাথেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সেই দৃষ্টি ক্রমে ক্রমে মুগ্ধতায় পরিস্ফুট হয়ে উঠে। আসলে শব্দকে যথেচ্ছ ব্যাবহারের শক্তি আশরাফ জুয়েলের আছে। তার কলম তার ব্যাবচ্ছেদ ছুরির চেয়েও ধারালো। 'আহাম্মক আমি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে/ কলম ঘুষে মন্দভাগ্যের কথা লিখে যাচ্ছি'।
চাটগাঁ থেকে কানসাট কবিতাটি পড়তে পড়তে ভাষার টানে বাংলাভাষী হিসেবে রোমাঞ্চ হয় যে হটাত মনে হয় যে এখানকার গাছগুলি মনে হয় বাংলায় কথা বলে, বাতাসের শব্দ বুঝি বাংলা। এটা নতুন বাংলাদেশ। বাংলাভাষার দেশ। পশ্চিম বাংলায় যে মর্যাদা নেই, সেই দেশ প্রেম মাটিকে ভালোবাসা। 'আমার গন্তব্যের ছক এঁকে ফেলেছি/ নিরেট নিঝুম অন্ধকারে শূন্যদৃষ্টি- বাংলাদেশ'।
কোল্ড কফি ঠোঁটে কফিহাউসে কবিতার প্রেক্ষিত কোলকাতা কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস। সীমান্ত ডিঙিয়ে আশরাফের কল্পনায় চিত্রিত হয়েছে অগ্রজ কবির কফিহাউস ভ্রমণ। তার সাথে নিজের ভাবনা সম্পৃক্ত করা যে কি দারুণ মুন্সীয়ানা সেটা কবিতাটি পড়ামাত্র পাঠক বুঝবেন। নিরাসক্ত কণ্ঠে বললাম, 'অমিতদা ইটস আ গেম'।
প্রকাশিত ৪৫টি কবিতা নিজস্ব প্রকাশভঙ্গীতে উজ্জ্বল। পুরোটাই সুখপাঠ্য। কিন্তু একটা সমালোচনার জায়গা আশরাফ জুয়েল কিন্তু রেখে গেছেন। সেটা হচ্ছে প্রেম। আশরাফ কবিতায় প্রেমকে শরীর থেকে বিযুক্ত করে সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তুলনামূলকভাবে সহজ ও নিরাপদ রাস্তা বেঁচে নেয়া। রক্ত-মাংশের সবল প্রণয়কে স্পর্শকাতরতার ভাষায় ফুটিয়ে তোলা কিছুটা কঠিন। শালীনতার সীমা রেখে যৌবনের উত্তাপ, শরীর, যৌনতা কবিতায় আঁকা বেশ কঠিন ব্যপার। তার আগে যে কোন কবিকে বুঝে নিতে হবে যে তিনি যখন কবিতা লিখছেন তিনি শুধুমাত্র কবি। তিনি দায়বদ্ধ শুধু কবিতার কাছে। অন্য পরিচিতি কিছু নেই। তাঁকে হাঁটতে হবে সত্যের আবরণ উন্মোচন করতে করতে। 'অশ্বমেধের ভস্ম ওড়ে/ জড়িয়ে তোকে ইচ্ছে করে/ দরজা খুলি রক্তে ঢুকে/ গভীর গোপন তীব্র সুখে/ পরাগরেণু গর্ভকেশর।/ ওলটপালট।/ বৈশাখী ঝড়।' [উত্তরণ]।
প্রথম কবিতা সংকলন হিসেবে আশরাফ জুয়েলের 'যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব' সাড়া জাগাবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমরা শুধু প্রতীক্ষায় থাকবো তাঁর ভবিষ্যতের নবতম উদ্ভাসের। বাংলাদেশকে বলবো 'ভবিষ্যৎ তৈরি থেকো' [যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব]।
বই ৬)শাদা পরচুল অন্ধকার
রেজওয়ান তানিম
নিজের বই নিয়ে আমার এখানে আলাদা করে কিছু বলার নেই। কেউ যদি এরপরেও আমার ভাবনা ও আঙ্গিকগত বিষয়গুলো জানতে চান, তাহলে এখানে আমার সাক্ষাৎকারটি দেখুন- Click This Link
শাদা পরচুল অন্ধকার
রেজওয়ান তানিম
প্রচ্ছদ: শন লারসন। পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
আমরা জানি, মানবসভ্যতার ইতিহাসে অভিজাত শাসক অথবা বিচারক শ্রেণির নারী ও পুরুষদের পরচুলার ব্যবহার ফেরাউন ও রোমান সম্রাটদের সময় থেকেই প্রথমে প্রচলিত হয়। পরবর্তীকালে, পরচুলার ব্যবহারে ভাঁটা পরলেও এই প্রবণতা ভিক্টোরিয়ান আমলে ইউরোপের অভিজাত, বিচারক ও আইনবিদদের মাঝে পরচুলা, বিশেষ করে শাদা পরচুলার ব্যবহার আবার ফিরে আসে আভিজাত শ্রেণি-শাসক ও বিচারকদের মাথায় এবং উপনিবেশবাদী ধারায় সওয়ার হয়ে এই প্রচলন ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোতেও চালু হতে দেখা যায়, যার অপভ্রংশ এখনো এককালের বৃটিশ উপনিবেশ হিসাবে আমাদের দেশেও এর কিঞ্চিত দেখা মেলে, বিশেষ করে আদালতের অঙ্গনে, বিচারকের আসনে। কবিতাগুলোতে শাদা পরচুলা এসেছে কখনো শাসক, কখনো শোষকের চরিত্রে, সুন্দর ও সাধারণের জীবনের প্রবল প্রতিপক্ষের রূপক চরিত্রে।
বাঙলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট। তিনি অনেক যুক্তিতর্ক দিয়ে বৈদিক ধারণা ও মিথের বিপরীতে বাঙালিদের মাছ খাওয়ার অভ্যাসকে সমর্থন করেছিলেন। তিনিই অনেক শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন যে মাছ-মাংস খাওয়ায় কোনো দোষ হয় না। কিছু তিথি ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে মাছ না খেলেই হলো। অনেকে বলেন বাঙালির চিরাচরিত অভ্যাসকে সমর্থন না জানিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তেল বা চর্বির তালিকায় জীমূতবাহন ইলিশ মাছের কথা উল্লেখ করেছেন। বাঙালির আরেক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যও এই মত সমর্থন করেন। বৃহর্দ্ধমপুরাণে আছে যে সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ ব্রাহ্মণেরাও খেতে পারেন। কিন্তু যে মাছ গর্তে বা কাদায় বাস করে, মুখ ও মাথা সাপের মত অর্থাৎ যেমন, বান মাছ, দেখতে কদাকৃতি, আঁশহীন, পচা, শুকনো মাছ 'ব্রাহ্মণ' তথা এদেশীয় বাঙ্গালি অভিজাত শ্রেণি বাঙ্গালি হলেও তাদের ভক্ষণের জন্য 'নীচু জাতের' মাছ হিসাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবে নিম্নতর সমাজে এসব কেউ মানত না। সমাজে স্তর বিন্যাসে এটাও একটা কারণ। আর সমাজ স্তরের এই বিন্যাসে 'বান মাছ' অচ্ছুত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। এই অন্যায় সামাজিক 'অচ্ছুত', বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার, বান মাছ'- যার ভাগ্যে এই বিরূপতা, বহুমুখী কারণে এবং তার অন্যতম কারণ, 'শাদা পরচুলার নীচে উদ্ধত মস্তিষ্কের নিগড়ে অশুভ চিন্তার কালো অন্ধকার'।
বই ৭) প্রতিকবিতা ও অবাধ্য গোলাপ
মনির ইউসুফ
তরুণ কবি মনির ইউসুফ মূলত দেশ ও সমাজের ভাবনা তাড়িত হয়েই লেখেন। তার এই বইয়ের নাম শুনলেও তা বুঝা যায়। তার এবারের কাব্যগ্রন্থের সাফল্য কামনা করি।
সংক্ষিপ্ত তথ্যঃ
প্রতিকবিতা ও অবাধ্য গোলাপ
মনির ইউসুফ
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
গোলাপ পবিত্রতা, স্নিগ্ধতা এবং প্রেমের প্রতীক। মোগল সম্রাটদের মিনিয়েচার বা তৈলচিত্রে হাতে গোলাপ দেখা যায়। গোলাপ বা পুষ্প নিয়ে, বাগান নিয়ে রচিত গ্রন্থ প্রায় সবই বিখ্যাত।'গুলিস্তাঁ' (শেখ সাদী) থেকে 'কেয়ার কাঁটা' (বেগম সুফিয়া কামাল) তার উদাহরণ। আবদুশ শাকুর মৃত্যুর পূর্বে 'গোলাপ বিষয়ক বই লিখে বিখ্যাত হন। নাট্যকার মমতাজ উদদীন আহমদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম ছিল 'ফুলের নামে নাম'। স্থানের নামের আগে, মাজারের নামে বা প্রতিষ্ঠানের নামে গোলাপ পাওয়া যায়। মনির ইউসুফ সেই গোলাপকে দেখেন অবাধ্য রূপে। এই বিনষ্ট বা অবাধ্য পবিত্রতা কবির কাব্যভুবনকে অস্থির করে তোলে, তিনি দ্রোহ-চিন্তায় প্রতিরোধে নিমগ্ন হন, বিরুদ্ধতাকে ধারণ করেন, কবিতার সৃজন প্রথা থেকে দূরে নিয়ে আসেন তিনি। গদ্যকবিতা নয়, তাঁর সৃজন কবিতার বাহনরূপী এক নিবিষ্ট গদ্য। বক্তব্য নয়, বুদ্ধিজাত চরণও নয়, বরং বিশুদ্ধ এক বোধ নিয়ে এবং অন্তর্গত যাতনায় প্রতিহত করার চেতনা নিয়ে গদ্যোক্তি করেন অন্তরপ্রবাহী অন্য কোন অঙ্গীকারে। তারই নাম শিরোনাম ধারণ করে নতুন কবিতা নির্মাণ করেন স্পর্ধিত উচ্চারণে কবি মনির ইউসুফ
বই ৮) কুমীরের ডিমবসতি
সরসিজ আলীম
কবি সরসিজ আলীম এর ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ কুমীরের ডিমবসতি। আসা করছি বইটি পাঠকপ্রিয় হবে।
কুমীরের ডিমবসতি
সরসিজ আলীম
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান।
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৪: পৃষ্ঠা: ৬৪।
মূল্য: ১৫০ টাকা। বই মেলায় ছাড়কৃত মূল্য ১০০ টাকা।
অনুপ্রাণনের বক্তব্যঃ
'কুমীরের ডিমবসতি' পাঠে এমনটি মনে হতেই পারে কবিতার ভাষা এক আবিষ্কারের ভাষা। কবি ভাষাকে ব্যবহার করেন এক আবিষ্কারের ভাষা হিসাবে। কবিতা শব্দাতিরিক্ত এক আবেশ। কবিতা শব্দকে ছাড়িয়ে যায়। আধুনিক কবিতার অনেক বড় এক অলংকার তার চিত্রকল্পময়তা। চিত্রকল্পে সরসিজ সাজিয়েছেন এক অনবদ্য গ্যালারি, সেখান থেকে ছিটে ফোঁটা কয়েকটি:
১. "দেখো দেখো বৃক্ষগুলো ছায়ার উপর কেমন দাঁড়িয়ে আছে, নাকি ছায়ারা বৃক্ষদের পদতলে বসে সুখ লিখে যাচ্ছে!" [ফের দুপুরের মেয়ে]
২. "আমার কাঁধের উপর চড়ে বসলো ডানাভাঙা সূর্য"
[কাজরী তিথি যেনো না জানে]
৩. "দানার ঝাপটানিতে রোদের চুল খুলে যায়" [প্রভাতবেলা সারাবেলা]
৪. "কয়েকজন সন্ধ্যা গাছের আড়ালে আধারের তলে বসে গল্প ছড়াচ্ছে"
[সন্ধ্যার গল্প]
৫. "হাওয়ায় উড়তে উড়তে আমার মনভালোর উপরে বসে একটা ফুল"
[শীতের কেনা-কাটা]
কবিতাংশগুলির উদ্ধৃতি থেকে এই কাব্য পাণ্ডুলিপিটির একটা বৈশিষ্ট্ বেরিয়ে আসে। যদি সুনিদ্দিষ্ট করেই বলতে হয়, তাহলে বলা যায়:
১. এক একটি অনুভবের স্পার্ক এক একটি কবিতা।
২.কবিতাগুলো নৈব্যক্তিক পর্যবেক্ষণের ব্যক্তিগত দিনলিপি। বস্তুবিশ্ব ও চেতনা-বিশ্বের অন্তবয়নের পারস্পারিক বিকার।
৩. কবিতায় আখ্যান বিশিষ্টতার প্রাবল্য।
৪. বিশ্বায়ন ও আধুনিক নাগরিক চেতনাবোধ।
৫. কবি তার কবিতাযাপনে সব সময়ই চেয়েছেন রোমান্টিকতা, রহস্যময়তা, কৌতুকপ্রিয়তা। রয়েছে নিজের সাথে নিজের লুকোচুরি খেলার প্রবণতা।
সর্বপরি মানুষের অন্তপ্রকৃতিস্থিত গোপনীয়তাকে উদ্ধার করে কবিতার শরীরে স্থাপন করা। বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে, এমন আশা করতেই পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:৫৪