প্রেম ও ভালবাসা প্রায় কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করলেও এদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে বাংলা ভাষায়। সাধারণত আমরা প্রেম শব্দটি ব্যবহার করি সবচেয়ে বেশি যখন কোনো সম্পর্কের মধ্যে জৈবিক চাহিদা অন্তর্ভুক্ত থাকে। ভালবাসা শব্দটি আমরা জৈবিক এবং আত্নিক দুই ক্ষেত্রেই ব্যবহার করি। মা-ছেলের ভালোবাসা, বাবা-মেয়ের ভালবাসা বলতে ও শুনতে আমরা যতটা কমফোর্টেবল ফিল করি মা-ছেলের প্রেম, বাবা-মেয়ের প্রেম বলতে এবং শুনতে ততোটা কমফোর্ট ফিল করি না। গল্পের শিরোনাম দেখেই নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে কি ধরণের সম্পর্ক নিয়ে লিখতে চলেছি। ইহা আমার জীবনের এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা ছিলো !
সাল ২০১৮; ঢাকার মিরপুরে তখন আমাদের নিজেদের জমি ছিলো। স্থানীয় এমপির সাথে জমি সংক্রান্ত ঝামেলা হওয়ায় পাকা দালান করতে পারছিলাম না আমরা। তাই টিনশেড বাড়ি করে সেখানে রুম ভাড়া দিয়ে রাখতাম। আমাদের জমি যে এলাকায় ছিলো তা শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা। গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক সহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো আমাদের এলাকা। আমাদের জায়গা থেকে কিছুটা দূরে এক আবাসিক এলাকায় আমরা নিজেরা ভাড়া থাকতাম। সবসময় আমাদের যাওয়া-আসা ছিলো নিজেদের বাড়িতে। আমাদের ভাড়া রুমের সবচাইতে বেশি চাহিদা ছিলো কারণ আমরা এক রুমে ছোট ফ্যামিলি ছাড়া কাউকে ভাড়া দিতাম না। যাদের পরিবার বড়ো তাদেরকে একের অধিক রুমে ভাড়া নিতে হতো বাসা খালি থাকা সাপেক্ষে। যে সব শ্রমিক নেশা-পানি করতো, মদ-জুয়ায় আসক্ত ছিলো তাদের রুম ভাড়া দিতাম না। নিজেদের সোর্স কাজে লাগিয়ে খোজ নিতাম তাদের ব্যাপারে। ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরম এর যথাযথ ব্যবহার করতাম আমরা। এত কেয়ারফুল থাকার পরও আমাদের এমন সব ভাড়াটিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে যা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
একবার আমাদের বাসায় রুম ভাড়া নিতে আসে এক পঞ্চাশোর্ধ নারী। রুম ভাড়ার টু-লেটে আমার নাম্বার দেয়া ছিলো। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়া সে নারীকে আমার নাম্বারে ফোন দিতে বলে। ফোনে আমি রুম ভাড়া নিয়ে কে কে থাকবে তা জানতে চেয়েছিলাম। ফোনের অপর পাশ থেকে উত্তর আসে নাতি এবং নানী থাকবে বাসায়। নানী হোটেলে রান্নার কাজ করে এবং নাতি সেলুনের দোকানে কাজ করে। আমার সাদা মনে যেহেতু কাদা নেই তাই ভিন্ন কিছু না ভেবেই তাদের বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হয়েছিলাম। সময় করে আমাদের বাড়িতে গিয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করেছি নানীর সাথে। নাতিকে দেখতে চাইলে নানী বলে, রাতে দেখা করে কিছু টাকা এডভান্স করে যাবে। পরবর্তীতে নাতির সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। তাদের কাছে রুমভাড়া দিয়ে দিলাম।
নাতি বয়সে খুবই তরুণ মিড টোয়েন্টিজ হতে পারে। দেখতে খুবই সুন্দর মাশাল্লাহ ! নানী-নাতি কে ভাড়া দেয়ার পর অন্যান্য ভাড়াটিয়ার বউ ও মেয়েরা শুধু ছেলেটার সাথে কথা বলতে চাইতো। কিন্তু নানী সেটা ভালো চোখে দেখতেন না। মেয়েরা কটাক্ষ করে বলতো বুড়ি তুই তোর নাতির কাছে বিয়ে বস! আমাদের তো তোর নাতিরে দিবি না। নানী খুবই রেগে যেত। বাসার ভিতরে মালিকপক্ষের(আমরা) খোচর ছিলো। বাসায় কি হয় না হয় তার আপডেট খবর আমরা পেয়ে যেতাম। বিনিময়ে খোচর মিয়া থেকে কিছু টাকা কম নিতাম মুল ভাড়া থেকে।
সবকিছু মোটামুটি ভালোই চলছিলো। কোনো এক শুক্রবারে সকালে আমাদের বাড়িতে গেলাম ভাড়াটিয়াদের হালচাল দেখতে। অনেকের বন্ধের দিন হওয়ায় সকালে সবাই রান্নাঘরে এবং কেউ কেউ বাথরুমে গোসল নিচ্ছিলো। আমাদের খোচর মিয়ার বাসায় বসে কার কি অভিযোগ, কে নিয়ম ভাঙলো, কারা ঝগড়া করেছে চুলা নিয়ে, বাথরুম নিয়ে সেসব খবর শুনতাম। কারো মধ্যে ঝামেলা হলে সমাধানের চেষ্টা করতাম। হটাৎ কানের মধ্যে ভেসে আসে একজন ভাড়াটিয়া(নারী) বলছে, "কিগো নানী ! প্রতিদিন সকালে তোমার এত বিয়াইত্তা বেডিগো লাহান গোসল করা লাগে কেন ? তুমি হোটেলে কাম শেষ কইরা আইসা আবারও গোসল করো "। আমি তেমন পাত্তা দেই নাই এসব প্রাপ্তবয়স্ক কথাবার্তায়। ভাড়াটিয়াদের নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা হচ্ছে আমার সেখানে কি বলার থাকতে পারে ? যেহেতু আমাদের পানির মিটারে বিল বেশি আসতো সেজন্য ভাড়াটিয়াদের পানি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে বলা হতো। পানি তোলা হতো মটর দিয়ে তাই বিদ্যুৎ বিল বেশি আসতো বেশি মটর চালালে। এভাবে ছয়মাস কেটে গেল।
নানীর নাতির প্রতি ছিলো বেসম্ভব টান। নাতি কার সাথে কথা বললো, কোথায় গেলে সব খোজ খবর রাখতো বুড়ি। সেলুনের পাশেই হোটেল ছিলো। হোটেলে ভালো মন্দ খাবার যেটুকু নানীর ভাগে পড়তো তা নিজে না খেয়ে নাতির জন্য আনতো। বুড়ি হোটেল থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করে বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ার কাছে কমে বিক্রি করতো। বাড়িভাড়া একেবারে ঠিকঠাক সময়ে দিতো নানী। নাতির টাকা দেয়ার কোনো চাপ ছিলো না। স্বভাবতই সবাই নানীকে ধরতো তার নাতির সাথে তাদের পরিবারের মেয়ের সম্পর্ক করাতে। কিন্তু বুড়ি সবসময় তা এড়িয়ে যেত।
কোনো এক বিকেলে আমাদের খোচর সাহেব ফোনে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলে। আমি বাড়ি গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড ! কয়েকটা ছেলে এসেছে নাতির খোজ করতে। আমি তাদের কাছে বিস্তারিত ঘটনা শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। নাতি অনেক আগেই বিয়ে করেছে। কিন্তু সে বউয়ের কাছে থাকে না। কথিত নানীর সাথে থাকে। নাতির স্ত্রী অন্য এলাকায় থাকতো দেখে কিছুই জানতো না। কিন্তু সে এলাকার একজন আমাদের এলাকায় একদিন নাতিকে দেখতে পায়। সে আরো জানতে পারে নাতি আমাদের বাসায় এক বুড়িকে নিয়ে থাকে। অথচ তার জলজ্যান্ত তরুণী স্ত্রী আছে। ছেলেগুলোর সাথে আমার কথোপকথনের সময় নাতির বউ আমাদের বাসায় আসে। এবার তার মুখে আরো বিস্তারিত জানতে পারলাম নাতি-নানীর ব্যাপারে। নাতি যখন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকতো তখনও নানী তাদের সাথে থাকতো। বিভিন্ন অজুহাতে বুড়ি নাতি এবং তার স্ত্রীকে একসাথে থাকতে দিতো না। নাতির বউ তার বাপের বাড়ি গিয়েছিল একবার। সকালের দিকে গ্রাম থেকে নিজের বাড়িতে এসে সে খুব অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে। বুড়ি সকালে গোসল করছে। নাতিও সকালে গোসল সারছে। তাদের যে পেশা সকালে গোসল করে তেমন ফায়দা নেই। বুড়ি নাতির প্রতি অত্যধিক স্নেহ যেন নাতি ও নাত বঊয়ের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাতবউ তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলে । এর কিছুদিন পর বুড়ি তাদের বাসা থেকে চলে যায়।
আমাদের বাড়ির ভিতর ভাড়াটিয়াদের মধ্যে চলছে তখন নানা কানাঘুষা ! অনেকেই নানী-নাতির সম্পর্ক নিয়ে তাদের সন্দেহ যে সঠিক তা নিয়ে কথা বলছে। বুড়ির বাসায় তালা মারা ! আমরা তালা ভেঙে তাদের বাসায় ঢুকি। আমি খুবই ভয়ে ভয়ে ছিলাম আমার বাসায় জানাজানি হলে কি পচা কথা না জানি শুনতে হয়। নাত বউ এবং তার এলাকার পোলাপান চলে যায়। আমি কিছুটা আশস্ত ছিলাম কারণ বড়ো কিছু ঘটার আগেই কথিত নানী-নাতি নিজেরাই আত্নগোপনে চলে গেছে। হয়তো কোথাও আবার তারা আসল পরিচয় গোপন করে নানী-নাতির সংসার পাতবে !