somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি আবুল হাসানের জন্মদিনে : মেঘের আকাশ আলোর সূর্য নিয়ে আলোচনা

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেঘের আকাশ আলোর সূর্য : অপ্রকাশিত আবুল হাসান
ষাটের দশক বাংলা কাব্যধারার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সময়। কলকাতা ও ঢাকা-বাংলা ভাষা চর্চার দুই প্রধান কেন্দ্রেই এ সময় পালাবদলের সূচনার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল সামরিক একনায়কতন্ত্র। সাহিত্যাঙ্গনে এর প্রভাব দৃশ্যমান হয় রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ পালনে স্বৈরশাসকের বাধা, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে। নানাবিধ রাজনৈতিক আন্দোলন ঘোষণা দেয় মুক্তিযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতার। অপরদিকে কলকাতার রাজনৈতিক জগতে আপাত স্থিতিশীলতা থাকলেও বৃহৎ শিল্পায়নের দিকে নজর, সমাজসেবায় ব্যয় কমানোয় উদ্ভব হয় সামাজিক বৈষম্যের। দুই বাংলার সমসাময়িক কবিদের বেশির ভাগই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময়ে ছিলেন শৈশবে কিংবা কৈশোরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ ভাগ, ছিন্নমূল শরণার্থীদের ছোটাছুটির বাস্তবতা, সুবিধাবাদী রাজনীতি এরা প্রত্যক্ষ করেছেন, জেনেছেন জীবনের নির্মমতাকে। দেশভাগের পরে কলকাতায় বাংলাদেশী হিন্দুদের অব্যাহত আগমন, খরা পরিস্থিতিতে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি মোটকথা ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি কবিতার হাংরি বা ক্ষুৎকারতা আন্দোলনের জন্ম দেয়। কবিতার ভাবনার জগতটা বাংলা কাব্যের চিরন্তন রূপ রোমান্টিকতার থেকে বেশ বড়সড় এক ধাক্কা খায়। সচরাচর কবিতায় প্রকাশিত ভাবনার সাথে রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রকাশ কবিতায় আসে আরেক মাত্রা নিয়ে।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এ সময়টিতে ঢাকাই সাহিত্য কলকাতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয়। পঞ্চাশের দশকে নতুন এক অস্তিত্ব খুঁজে নেয়া বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীতে এ সময়ে এক ঝাঁক তরুণ কবির দেখা পাই যারা উত্তরকালে নিজ বৈশিষ্ট্যে ও কাব্য ভাবনায় সমুজ্জ্বল। এই সময়ে সবার প্রথমে নিজেকে তুলে ধরেন কবি আবুল হাসান। বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, ব্যক্তিজীবনের পাওয়া না পাওয়ার গাথা রচনা এবং জগত সংসারের তুলনাহীন যন্ত্রণায় বীতশ্রদ্ধ এই কবি নীল দীর্ঘশ্বাসে দগ্ধ হয়ে বেদনার ধূসর ক্যানভাসে আঁকলেন জীবনের অঙ্গীকার বদ্ধ আশার ছবি, শান্তিকামী স্বপ্নের রূপকল্প। আবুল হাসান বাংলা সাহিত্যকে সেবা করেছেন খুব অল্প সময়।মাত্র বছর দশেকের চর্চায় তিনি উপহার দিয়েছেন তিনটি কাব্যগ্রন্থ- রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) এবং পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। এই তিনটি কাব্যগ্রন্থেই তিনি তৈরি করেছেন কবিতার নব কল্প ভুবন, কল্পনার নতুন মায়াজাল, পেয়েছেন বিরলপ্রজ পাঠকপ্রিয়তা।

১৯৭২ সালে যখন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাজা যায় রাজা আসে প্রকাশিত হয় তখনই কবি নিজস্ব ভাষায়, বৈচিত্র্যে ও চিন্তায় স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী।১৯৭৫ সালে প্রকাশিত পৃথক পালঙ্ক তাকে প্রতিষ্ঠিত করে ষাটের দশকের শক্তিশালী কবি রূপে। কবিতায় অলঙ্কার প্রয়োগের অভিনবত্ব, ভিন্ন-ধারার ভাবনার স্ফুরণ তাকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল করে। জীবনের ভীষণ আশাবাদে ঋদ্ধ কবি উচ্চারণ করেছেন-

আমি নই ক্রীতদাস, হৃদয়ের আমি তো সম্রাট, আমি
এক লক্ষ রাজহাঁস ছেড়েছি শহরে, আমি জয়ী, আমি জয়ী!
দূরযাত্রা (রাজা যায় রাজা আসে)

প্রবল আশাবাদী এই কবি জন্ম হতেই ছিলেন ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। হৃদপিণ্ডের কপাটিকার ছিদ্র তাকে নিয়ে গেছে অকালপ্রয়াণের দরজায়। চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে তাকে জার্মানি পাঠানো হয়। কিন্তু আরোগ্য লাভ সম্ভব না হওয়ায় তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং পুনরায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। যৌবনেই জরায় আক্রান্ত কবি প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়েও লিখলেন অমর কাব্য-

হে রক্ত, হে খৃষ্ট তুমি আত্মোৎসর্গী মেশিনের দোমড়ানো লোহা।
বলো তারে শান্তি শান্তি- বলো আদিভাষা বলো, 'আলো হ', 'আলো হ'
বলো তারে শান্তি শান্তি

পৃথক পালঙ্ক

মাত্র ৩৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে অনেক না পাওয়ার ভিড়ে কবির সঙ্গী হয়েছে কবিতা। আজন্ম কবিতা বিলাসী কবি পিছে ফেলে গেছেন জাগতিক সব বন্ধু, আত্মীয়ের মায়া, শুধু নিয়ে গেছেন কবিতার সৌরভ। পৃথক পালঙ্কের এপিটাফ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ
যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।

কবি আবুল হাসান বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন চিরস্থায়ী করেছেন খুব অল্প সময়। জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর উপরে আলোচনাও এ প্রবন্ধের বিষয় নয়। এ প্রবন্ধে জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতাগুলোর ভাবনা, প্রকাশভঙ্গী এবং পূর্ববর্তী কবিদের প্রভাব দেখার চেষ্টা করব।

কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ রাজা যায় রাজা আসে হলেও প্রথম পাণ্ডুলিপি নব্বইয়ের শেষের দিকে প্রকাশিত মেঘের আকাশ আলোর সূর্য। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত ছিল। এগুলো সম্পর্কে কবির ধারণা ছিল, এগুলো ছাপার উপযোগী নয়। এগুলো প্রস্তুতি পর্বের লেখা। অনেক কবি তাদের প্রস্তুতি পর্বের কবিতা পুড়িয়ে ফেলার মত বিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হন। সম্ভবত নিজের লেখায় কারো প্রভাব আছে তা পাঠক ও গবেষক সমাজে কোন ভাবে ছড়িয়ে পড়–ক এই বিষয়টি কোন কবিরই পছন্দ নয়। যাই হোক আবুল হাসান তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শেহাবউদ্দিন আহমেদকে কবিতা গুলো লেখা ডায়েরিটা দিয়ে ছাপতে বারণ করেছিলেন। সেই মোতাবেক তার মৃত্যুর আগে এটি ছাপা হয়নি।মৃত্যুর অনেক বছর পরে নব্বই দশকের শেষদিকে এটা ছাপা হয়। বইটির শিরোনাম দেয়া হয় তার একটি কবিতা 'মেঘের আকাশ আলোর সূর্য' নামানুসারে। এতগুলো বছর সযত্নে পাণ্ডুলিপিটি শেহাবউদ্দিন সংরক্ষণ করায়, আমাদের ধন্যবাদ পাবার যোগ্য এবং তার এ প্রচেষ্টা সত্যিই বন্ধুত্বের প্রতি সম্মানজ্ঞাপক।

বস্তুত এগুলো প্রকাশে আবুল হাসানের অনীহার কারণ ছিল দুটি। প্রথমত কবিতাগুচ্ছ ছাত্র বয়সের লেখা। দ্বিতীয়ত কবিতাগুলো পূর্বসরী কবিদের কবিতার একটা ছাঁচ লক্ষণীয় বলে। তা সত্ত্বেও যখন প্রকাশ হয় তখনই দেখা যায় তিনি কবি হিসেবে তখনি আলাদা একটা কণ্ঠস্বর তৈরির প্রচেষ্টায় প্রায় সফল ছিলেন। মূলত কবিতা একটা প্রবাহমান ধারা যাতে পূর্ববর্তী কবিদের প্রভাব নতুন কবির মধ্যে থাকা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কবিতা ঋদ্ধ হয় অতীতের কঙ্কালে বর্তমানের অস্থি মজ্জার সংস্থানে। ব্যাপারটি অপরাপর কবিদের মত আত্মানুসন্ধানের কবি আবুল হাসানের জন্যও সত্য। তার কাব্য প্রথমদিকে জীবনানন্দের দেখানো পথেই হাটতে শুরু করে এবং সেটা ভাবে নয় শব্দগত দিক থেকে। কিছু কিছু শব্দ চয়ন এবং শব্দের প্রকাশে তিনি জীবন বাবুকে অনুসরণ করেছেন।

তুমি তো জানো না, আর না জানিলে
ওগো এ আমার শেষ গান কি না, তুমি তো জানো
মৃত্তিকার স্নেহ নিয়ে এ পদ্ম কার দিকে চায়
ধূলির প্রান্তে শোয়া রাত্রির কামনায়
-ওগো তুমি তো জানো না!

মেঘের আকাশ আলোর সূর্য (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

কবিতাটিতে আমরা প্রকাশের যে ভাষা লক্ষ্য করি তা অনেকাংশেই মিলে যায় জীবনবাবুর ধূসর পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত নির্জন সাক্ষর কবিতার সাথে। চেতনা বা ভাবগত দিকটিতে নয়, বরং ভাষার প্রকাশ ভঙ্গিতে। নির্জন সাক্ষরের লাইন দুটো দেখি-

তুমি তো জান না কিছু না জানিলে
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে।

কবিতায় জীবনানন্দের যে লঘু সুর, শব্দের উর্বরতা, প্রকাশের অনুপম ভঙ্গিকে নিজের লেখায় অন্যমাত্রায় প্রকাশ করেছেন আবুল হাসান। তার কবিতায় সরাসরি উত্তেজনা, ক্ষোভ, দ্রোহের প্রকাশ মেলেনা কিন্তু আত্ম ক্লেদ ও গ্লানিতে স্তব্ধ এক জীবনের প্রকাশ পাই তার কবিতায়।

মানুষের ধড়গুলো ইতস্তত কথার মতন
এঁকে বেঁকে অদ্ভুত লীলায় হেথায় হেথায়
শুধু আলেয়ার মত কাজ করে।

গতির আড়াল (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

কবিতায় রাজনীতি চেতনা তার কাব্যে এসেছে কাব্যের প্রয়োজনে, ইতিহাসের প্রয়োজনে নয়। সমকালীন কবি ও বন্ধুবর নির্মলেন্দু গুন এদিক থেকে স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম। গুনবাবুর কবিতায় রাজনীতি, সমাজ এসেছে উচ্চকিত কণ্ঠে। এক্ষেত্রে তিনি শামসুর রাহমানের সার্থক উত্তরসূরি। নির্মলেন্দু গুন কবি হিসেবে খ্যাত হয়েছেন প্রধানত রাজনৈতিক কবিতা, সামরিক শাসন বিরোধী কবিতার জন্য। হুলিয়া, স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হল- এই ধারার বহু জনপ্রিয় কবিতা লিখেছেন তিনি। অপরদিকে আবুল হাসান ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়া থেকেই এসেছেন রাজনীতির বৃহৎ অঙ্গনে। দেশের তপ্ত পরিস্থিতি কিন্তু তিনি মেঘের আকাশ আলোর সূর্যের কবিতাতেই দেখিয়েছেন

এ আমার দেশ, জ্বালাময়ী সুপ্ত অগ্নিগিরি
যার বুকে শতাব্দীর খুন জমে হয়েছে শিলার এক
অতৃপ্ত বিদ্যুৎ জমা।
.......

তুলে নেই আমার উদ্ভাসে, আমার দেশের থেকে দু একটি সংগ্রাম শিলা
বহু অতীতের, বহু মানুষের রক্ত দেওয়া সুগন্ধি পাত্রের প্রথম আশ্বাস
আমার জরায়ুর রন্ধ্রে এনে দেয় জেহাদের অভিলাষ।

এ আমার দেশ (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

প্রথম পাণ্ডুলিপিতেই কবি তার স্বতন্ত্র ভাষা এবং উপমার বয়ানে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এক ভিন্নধর্মী চেতনাকে সামনে আনতে চেয়েছেন তিনি, সৃষ্টি করতে চেয়েছেন চিত্রকল্পের এক নতুন জগত তার প্রমাণ মেলে এই লাইনগুলোতে

আমারে নদীর নেশা দিয়েছিল
শাহেরা খাতুন
কামরাঙা বনের সবুজে
শ্বেত আর লাল স্রোতে
আমাকে সে দিয়েছিল প্রীতির আগুন

নদীর বুকের সব ঢেউ (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

কামরাঙা বনের সবুজে কবি খুঁজে পেয়েছেন শ্বেত আর লাল স্রোত। এই স্রোত কি ভালবাসার উষ্ণ রক্তস্রোতের ধারা নাকি জমাট বেদনার রক্ত অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে। কবির চোখে আকাশ ধরা দেয় নতুন মানে নিয়ে। তিনি উদার আকাশকে দেখতে চেয়েছেন চিলের চঞ্চুর ভেতর দিয়ে। কৌমার্যের একমুঠো স্নেহ পাবার জন্য কবি আকাশের কাছে মুষ্টিভিক্ষা করেন

তবুও চিলের চঞ্চুতে বিরাট আকাশের উদারতা
জাগে
-প্রথম কৌমার্যের একমুঠো স্নেহের মতো।

তার অন্তরঙ্গতায় (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

কবির প্রথম পাণ্ডুলিপি এবং পরবর্তীতে প্রকাশিত মেঘের আকাশ আলোর সূর্যের বেশ কয়েকটি কবিতাতেই জীবনানন্দের প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে ধরা পড়ে। কবিতায় নিজের চিত্রকল্প প্রকাশে কবি আশ্রয় নিয়েছেন জীবনানন্দের শব্দ ও ঢঙের।

হাজার বছর ধরে মাংসের পরম অণুতে
বনশালিকেরা তার ঠোট নাড়ে নিটোল বিলাসে

প্রীতির পলাশ

পঙক্তিতে চলে আসা হাজার বছর ধরে আমাদের মনে করিয়ে দেয় বনলতা সেন কবিতায় ক্লান্ত পথিকের হাজার বছরের পথভ্রমণ। বনলতা সেনের আঙ্গিক আরো প্রবলভাবে পাই যখন সময়ের ব্যাপ্তি বোঝাতে তিনি গ্রীস কিংবা পীথাগোরাসের সময়ের নয়, বাংলার পলি প্রকৃতির কাছাকাছি কেউ বলে উল্লেখ করেন। গ্রীস, পীথাগোরাস এখানে ব্যাপ্তিতে নয় বরং নৈকট্য বোঝাতে।

সুলতা গ্রীস নয়, পীথাগোরাসের নয়, বাংলার পলি
তোমাকে কখন বলো দিয়েছে কাকলি?

প্রীতির পলাশ

আবুল হাসানের কবিতায় জীবনানন্দের এই সুরের উপস্থিতি আমরা তার পরিণত বয়সের লেখনীতেও লক্ষ্য করি। কবিতার চিত্রকল্পের জায়গাটা আমাদের ভাবায়।কবিতায় বন্যার তীব্রতায় ফসলের মাঠের যে ক্ষয়চিত্র রচিত হয়েছে তাতে কোথায় যেন জীবনানন্দের ভাষারীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

এ বাংলায় বার বার হাঁসের নরোম পায়ের খঞ্জনার লোহার খরায়
বন্যার খুরের ধারে কেটে ফেলা মৃত্তিকার মলিন কাগজ
মাঝে মাঝে গলিত শুয়োর গন্ধ, ইঁদুরের বালখিল্য
ভাড়াটে উৎপাত
অসুস্থতা, অসুস্থতা আর ক্ষত সারা দেশ জুড়ে হাহাকার
ধান বুনলে ধান হয়না, জীব থেকে পুনরায় পল্লবিত হয় না পারুল
তবুও রয়েছি আজো, আমি আছি
শেষ অঙ্কে প্রবাহিত শোনো তবে আমার বিনাশ নেই।

নচিকেতা (পৃথক পালঙ্ক)

ভাষার ব্যবহারে আবুল হাসানের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আপাত কোমল কথামালা দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ভাব বিন্যাসের নতুন জগত। বাংলা কবিতায় তার পূর্বেও এই ধারার কবিতাচর্চায় এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন রবিঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ। এসেছে। তারই উত্তরসূরি হিসেবে কবি লিখে গেছেন তরল ও স্বাদুতার কবিতা, যাকে অবনীন্দ্রনাথ বর্ণিত শিল্পের চারুতার সাথে তুলনা করা যায়।

কুমারীর পায়ের পাতার মতো নরম কবিতার খাঁজে।

অগ্রন্থিত কবিতা

আবুল হাসানের কবিতায় আরেকটি বিশেষ দিক অতীত চারণা। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই পৃথিবীর ইতিহাস এবং তার অতীতের স্বর্ণালী সময়ের বয়ান এসেছে তার কবিতায়। মিশরের নীলনদ, মমিদের কথা, চীনের হোয়াংহোর কথা আমরা পাই তার কবিতায়।

যে আকাশ সবুজাভ শস্য নিয়ে ফেরে
হাতের মুঠোয় যার পরমায়ু ধান শস্যের।
তারপর ঘুমে মরা আশ্বিনের মায়ালোভী চাঁদ
নীল নদে উড়ে এসে মমীদের গায়ে
মদের লালসা হত
কাছে এনে যুবতীর দেহ!
তারপর চীনের প্রাচীর এসে
হোয়াংহোর স্মৃতি নিয়ে যেত।

মিশ্রণের সুখ (মেঘের আকাশ আলোর সূর্য)

মূলত আবুল হাসানের কবিতার উপাদান- ভিতর থেকে উঠে আসা এক আত্ম যন্ত্রণার বিরামহীন প্রকাশ। কবি তার জাগতিক সমস্ত দু:খ, ক্লেদের বিলাসের মধ্যেই খুঁজেছেন শান্তি। আজন্ম শান্তির জন্য লালায়িত অকাল প্রয়াত এই কবি, কবিতার মাঝেই খুঁজে পেয়েছিলেন অন্তিম সুখের ঠিকানা। আগামীর কাছে যদি প্রশ্ন রাখি আবুল হাসানের কবিতা বাংলা সাহিত্যে কোথায় অবস্থান করছে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, এ কবিতা হবে সেই তারার মত, যা আমাদেরকে দেবে এক ধীর স্থির এবং শীতল আলো, যা আমাদের করে তুলবে বিষাদগ্রস্ত, বহু বছর ব্যাপী।

বি দ্র : বাংলা কবিতার জগতে একটি উজ্জ্বল নাম কবি আবুল হাসান। অকাশ প্রয়াত এই কবির আজ জন্মদিন। কবির জন্মতিথিতে তাকে জানাই শ্রদ্ধা। অকাল প্রয়াত এই কবির প্রথম পাণ্ডুলিপি মেঘের আকাশ আলোর সূর্য নিয়ে একটু আলোচনা করেছিলাম। সেই আলোচনাটাই এখানে দেয়া হল।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:৪৯
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

"মিস্টার মাওলা"

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ ভোর ৫:০৯


বিটিভিতে খুব সম্ভবত আগে একটি বাংলা ছবি প্রচার করা হতো , নাম 'মিস্টার মাওলা'। নায়ক রাজ রাজ্জাক, অভিনিত ছবির সার-সংক্ষেপ কিছুটা এমন: গ্রামের বোকাসোকা, নির্বোধ ছেলে মাওলা‌। মাকে হারিয়ে শহরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখন বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ কেন উন্নত দেশ হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও (সম্ভবত) হতে পারবে না…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:২২


১. সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে গুটিকয়েক যে কয়েকটি দেশ বিশ্বে স্বাধীনতা লাভ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালে এত রক্তের বিনিময়ে যে দেশ তৈরি হয়েছিল, তার সরকারে যারা ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সুনিতা উইলিয়ামস: মহাকাশ অনুসন্ধানে অনুপ্রেরণার যাত্রা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:২৪





সুনিতা উইলিয়ামস কে? যদিও তুমি তোমার পাঠ্যপুস্তকে সুনিতা উইলিয়ামসের কথা শুনেছো, তবুও তুমি হয়তো ভাবছো যে সে কে ?

বিখ্যাত নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামসের ক্যারিয়ার ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেরা, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ইলন মাস্ক , এসময়ের নায়ক

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:১০




সুনিতা উইলিয়ামদের ফিরিয়ে আনার আসল নায়ক!

৯ মাস! হ্যাঁ, পুরো ৯ মাস ধরে মহাকাশে আটকে ছিলেন নাসার মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়াম। একটি কারিগরি ত্রুটির কারণে তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পরিপক্কতা বনাম আবেগ: হাসনাত ও সারজিস বিতর্কের বিশ্লেষণ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৪


প্রতিকী ছবি

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। এই দুই নেতার প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, তারা একই ঘটনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×