somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃসঙ্গতা অথবা পূর্ণতার গল্প

১২ ই জুন, ২০১২ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি আর অমি যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের চলার পথ এখন থেকে আলাদা হয়ে যাবে, সেদিন ঠিক করলাম খুব শীঘ্রি একটা সারাদিন এক সাথে কাটিয়ে আমরা যে যার পথে হেঁটে যাবো! একদিন সারাদিন একসাথে কাটানোর স্বপ্ন বা ইচ্ছে আমাদের অনে-ক দিনের, এরকম আরো অনেক ছোট ছোট ইচ্ছে আমি বা অমি নানা সময় পরস্পরের কাছে প্রকাশ করেছি, কেন যেন তা কখনো বাস্তবে রূপ পায় নি! সারাদিন অফিস শেষে বা সপ্তাহান্তে অমি-র ক্লান্তি বা আমার আলসেমি অথবা অন্য কোন কারণ সকাল থেকে রাত একসাথে ঘোরার, পরস্পরের সাথে থেকে বোর হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা-কে আর সফল হতে দেয় নি!

এক বৃহস্পতিবার সকালে চাংখারপুলে সকালের নাশতা সেরে গুলিস্তানে আমরা বাসে চড়ে বসলাম- উদ্দেশ্যহীন; ইচ্ছে যেতে যেতে যেখানটায় অনেক সবুজ চোখে আরাম দেবে নেমে পড়ব দুজন, এরকমই ছিল যখন আমরা অনেক অনে-ক দিন এ নিয়ে কতো-ই না গল্প করেছি! বাস থেকে নেমে পায়ে চলা পথ ধরে হেঁটে চলেছি, কথা নেই কারো মুখে! আসলে আমাদের কারো কিছু আর বলার নেইও, সব কিছু বলা-শোনা-মান-অভিমান-জবাবদিহিতা সব কিছুর অবসান হয়েছে! আসলে সিদ্ধান্তটা আমাদের দুজনের কথাটা ভুল, ওটা আমার একা-র, অমি কিছুতেই এই আলাদা হওয়াটা চায় নি তবে আমি চলে যেতে চাইলে আমাকে ফেরানোর উপায়ও তার ছিল না!

পথের ধূলো উড়িয়ে যখন নাম না জানা গ্রামটার মাঝ দিয়ে হাঁটছিলাম, হঠাৎই ঝড় উঠল- কালবোশেখী! দৌড়ে আশ্রয় নিতে হলো কাছাকাছি এক বাড়ীর দাওয়ায়, আমি ইতস্তত করছিলাম- অমিই জোর করল; ও কখনো কোন ব্যাপারে জোর করে না!এ গ্রামের ঘরগুলোর চমৎকার নকশা, বৈঠকখানা বা বাইরের ঘরের বারান্দাটা রাস্তামুখী- পথিক চাইলেই একটু জিরিয়ে নিতে পারে! প্রচ্চন্ড জোরে দমকা হাওয়া বইছিল আর সাথে বাজ পড়ার শব্দ, আমি একদমই ভীতুটাইপের মেয়ে না; এনজয় করার চেষ্টা করছিলাম- মনের তুফানের সাথে একাত্ম হয়ে প্রকৃতির উন্মত্ততা! হঠাৎই দেখি ঘরের ভিতর থেকে দুটো মোড়া বের করে দিল একজোড়া চুড়ি পরা হাত…মুখ তুলে চাইলাম, ঘোমটার আড়ালের মুখটা দরজার আড়ালে চলে গেল!

ইচ্ছে করছে সুহাস’কে একটা টেক্সট পাঠাই, বোশেখী ঝড়ের কথা থাকবে আর বৃষ্টিতে ভেজার আকুতি! মোবাইলটা বের করে ফের বন্ধ করে রেখে দিলাম- নাহ, আজকের দিনটা শুধু অমি-র আমি ভাবলাম! অমি আর আমার একসাথে পড়াশোনা, ঠিক কখন যে অন্য পাঁচটা বন্ধুর মাঝে ও আমার ব্যাপারে অনেক যত্নশীল হয়ে উঠল টের পাই নি! যেদিন সে বলল, আমাদের বন্ধুত্বকে সে বাঁধতে চায় সারাজীবনের জন্যে, ভিন্ন নামে পরিচয় দিতে চায় সবার কাছে আমাদের সম্পর্ককে- আমি ঠিক এরকম কিছুর জন্যে প্রস্তুত না থাকলেও আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো না! মনের কোণে ওকে ভিন্ন আসনে বসাতে আমার খুব বেশী ভাবতে হয় নি- কেয়ারিং, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, প্রমিজিং স্টুডেন্ট আর সর্বোপরি আমরা এতোদিন থেকে বন্ধু, ওর থেকে বেশী হয় তো কেউ চেনে না আমায়, আমাকে বোঝে কী না সে প্রশ্ন অবশ্য আসে নি মনে!

ভাবনা-র সুতো ছিঁড়ে গেল হঠাৎ করেই আর্তচিতকারে, খুব সম্ভবত ভিতরবাড়ীর কোন ঘরের চালে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়েছে! ঝড়ে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে দাওয়াখানায় আরো দুজন! চোখ পড়ল বৃষ্টিতে আধভেজা এক বার্ধক্য ছুঁই ছুঁই ভদ্রমহিলা আর কাক-ভেজা তার তিন নাতি-নাতনীর দিকে! বিড়বিড় করে যাচ্ছেন তিনি ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যোয়ালিমিন’- খুব সম্ভবত বিপদ উত্তোরণের দোয়া, তার স্বর ক্রমেই জোড়ালো হচ্ছে- দোয়ার সাথে তার ছেলেদের নিরাপত্তা চাইছেন আল্লাহর কাছে! গ্রামে জন্ম হলেও দীর্ঘদিনের নগর-বাস আমাকে শহুরে করে তুলেছে, বৃষ্টি আমার কাছে বিলাসিতা আর ঝড়ের পাগলামী এখন মায়াময় রোমান্টিসিজাম! যার বাড়ীর দাওয়ায় আশ্রয় নিলাম তার উচ্চস্বরে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া-ভিক্ষায় বলা যায় কিঞ্চিত বিরক্ত আমি! অটোরিকশাচালক ছোট ছেলের সহীসালামতে ঘরে ফেরা নিয়ে উদবিগ্ন মা- মনে প্রশ্ন জাগল, চুড়িপরা হাতের অধিকারিণীর স্বামী কি সে-ই! অমি-কে দেখলাম, আনমনে মোবাইল টিপছে- খুব সম্ভবত কারো সাথে এস এম এস খেলা চলছে, আমার চোখে চোখ পড়তেই একটা ম্লান হাসি দিল!

সুহাসের সাথে পরিচয় একটা ফটোগ্রাফী এক্সিবিশানে, সেবার আমার তোলা একটা ছবি দ্বিতীয় পুরস্কার পায়! অমি-র ছবিতে তেমন আগ্রহ বা অনাগ্রহ কিছু-ই নেই, আমাদের সম্পর্কটার প্রতি সে অনেক যত্নশীল আর তাই হয় তো আমার কথাতেই আগ্রহ ছাড়া-ই এসেছিল! সুহাসকে দেখছিলাম- নির্নিমেষ তাকিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার জেতা সেই ছবিটার দিকে, একটা মেয়ে দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে- ছবিটা উপর থেকে নেয়া, মেয়েটার মুখ আর ছড়ানো দুহাত দেখা যাচ্ছে শুধু! ছবির বিষয়বস্তুটা খুব আটপৌরে কিন্তু উপর থেকে নেয়ার কারণে ওই এংগেলটা ছবিটাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে! আমি পাশে দাঁড়াতেই বলল- মেয়েটার বৃষ্টিতে আনন্দ-অবগাহনের মাঝে কোথায় যেন বিষাদের সুর বাজছে, যে তুলেছে কেন যেন মনে হচ্ছে তার মনেও অহর্নিশ বিষণ্নতা বাঁশী বাজায়, নইলে তা এই ছবিতে ফুটে ওঠার কথা না! আমি খুব আশ্চর্য হলাম তার কথা শুনে, বুকের ভেতরে কোথাও ছাই-চাপা কোন না-পাওয়া অনুভূতির দেয়ালে যেন জোরে সোরে একটা ধাক্কা লাগল! তারপর ছবির চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচয় পর্ব- কার্ড বিনিময়, বিনিময় বললে ভুল হবে আমার কার্ড চাইলে দিয়েই সেই প্রথম দেখার সমাপ্তি! সেই দিনের কথা ভুলেই গেছিলাম, সেই অনুভূতিকে ঢেকে রাখা দেয়ালটাকে আরো মজবুত করে গড়ে তুললাম!

ঝড়ের প্রকোপ আরো বাড়ল, আর সেই সাথে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে পুত্রের নিরাপত্তাকামী এক মায়ের আকুল আহাজারি! দরোজার দিকে চোখ পড়তেই ঘোমটার আড়ালের মুখটা দেখতে পেলাম, বছর আঠার বয়েস হবে- চোখে মুখে এখনো শিশুর সারল্য, তার স্মিত হাসিমুখের চকিত চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আরেক জোড়া চোখ আবিষ্কার করলাম, দাওয়ার দাঁড়িয়ে- হাসিমুখ এক যুবক! যার স্বামী ঝড়ে বিপদগ্রস্থ, শ্বাশুড়ী প্রার্থনারত অন্য অর্থে বিলাপরত তার অমন হাসিমুখ আর চোরা দৃষ্টি আমাকে কেমন দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে! পরমুহূর্তে মনকে ঝাড়ি দিই আমি- আমার মনে পাপ, তাই অমন ভাবছি! হয় তো তার পরিচিত- স্কুলের বড় ভাই ছিল কিংবা গ্রাম সম্পর্কে দেবর অথবা হয় তো তার স্বামীকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই, মায়েরা তো সব সময় একটু বেশী-ই চিন্তা করে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে!

মাসখানেক পর অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা টেক্সট- আমি সুহাস, চিনতে পারছেন? তারপর থেকে মাঝে মাঝে হাই-হ্যালো, কেমন আছেন-ভাল আছি! ক্ষুদে বার্তা ব্যাপারটাতে আমি ঠিক সচ্ছন্দ না, যতটুকু উত্তর না দিলে অভদ্রতা হয় সেইটুকু পর্যন্ত আমার সীমারেখা! কিন্তু একদিনের টেক্সট আমাকে অবাক করল- কাল আপনাকে একটা খুব সুন্দর জিনিস দেখাব যদি আপত্তি না থাকে তো! কী অমন জিনিস আমাকে দেখাতে আগ্রহী তিনি তা ভেবে আশ্চর্য হলাম, কিন্তু যাব না যাব না ভেবেও বিকেলে নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলাম ঠিক সময়ে, মাওয়া-গামী বাসে কেন চড়ে বসলাম আমরা জানি না! ধলেশ্বরীর ব্রীজের গোড়ায় আমাকে নামার জন্যে ইশারা করল সুহাস! নদীর ঠান্ডা বাতাসে আমার মেজাজ এখন ফুরফুরে, স্বল্প-পরিচিত কারো সাথে এক কথায় এত দূরে চলে আসার জন্যে কিঞ্চিত অস্বস্তি টা কেটে গেছে! এমনিতেই আমার এসব ব্যাপারে কোন প্রেজুডিস নেই, অমি’কে আমার সব কথাই অকপটে বলি, ওই তো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!হেঁটে হেঁটে ব্রীজের মাঝে আসতেই সুহাস বলল- চলেন আমরা ব্রীজের রেলিং এ উঠে বসি- পারবেন তো? প্রচ্চন্ড ধাক্কা খেলাম আমি, অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সুহাসের দিকে! ব্রীজের রেলিং এ বসে আমি থর থর করে কাঁপছিলাম, আমার বুকের ভেতরে তখন কালবোশেখীর ঝড় বইছে! কোন কথা না বলে আমরা চুপচাপ বসেছিলাম পাশাপাশি! অনেকটা সময় পরে মুখ খুলল সুহাস- এটা আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা, মন খারাপ হলেই আমি এখানে চলে আসি! আমার খুব ইচ্ছে ছিল- একদিন কাউকে নিয়ে আসব এখানে! আপনার সাথে কথা বলে কেন যেন আপনার সাথে এই সুন্দর জায়গার অপার্থিব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখার আনন্দটা ভাগ করতে ইচ্ছে হলো। আমি কিছু-ই বলি নি, সূর্যাস্তের পর ফিরে আসলাম, বাসার কাছাকাছি এসে অস্ফুটে তাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিলাম একদম সোজা নিজের হলুদ দেয়ালের রুমে!

দমকা হাওয়ার জোর কমেছে খানিক, এখন শুধু-ই বৃষ্টি অঝোরে ঝরছে। ভদ্রমহিলার দুশ্চিন্তাও বোধ হয় কমেছে- তাকে কোথাও দেখছি না দাওয়ায়। ঘরের পাশেই একটা জাম গাছ খেয়াল করি নি এতক্ষণ, তার ডাল-পালাগুলো সেই ঘরের উপর ছড়ানো। ঝড়ের তান্ডবে কিছু ডাল ভেঙ্গে পড়ে আছে রাস্তায়। বৈঠকখানার পাশেই একটা নতুন ঘর তোলা হচ্ছে- হয় তো ছোট ছেলের বিয়েটা কিছুদিন আগেই করিয়েছে- নতুন ঘরটা তাদের জন্যেই। ঘরের ভিটে ভেঙ্গে পড়েছে, সিমেন্টের তৈরী পাল্লাগুলো একদিকে হেলে গিয়ে চালটা ভেঙ্গে পড়ি পড়ি করছে। খুব দ্রুত হিসেব কষে বলল অমি- হাজার পঞ্চাশেক টাকা গচ্চা গেল গেরস্থের! কিন্তু তা নিয়ে কারো চিন্তা আছে মনে হলো না! দাদী মানে ওই ভদ্রমহিলাকে দেখলাম তিন নাতি নাতনীকে নিয়ে রাস্তায়, ঝুম বৃষ্টিতে জাম কুড়োচ্ছে। পাশের বাড়ী থেকেও কয়েকজন নেমে এল রাস্তায় হাড়ি-বাসনসহ, আম-জাম পড়ে আছে অনেক! অমি-র দিকে তাকালাম, আমার ক্যামেরার ব্যাগটা ওর কাঁধে ছিল, এগিয়ে দিল আমায়- তোমার ফটোগ্রাফীর খুব সুন্দর এলিমেন্ট। আমার তোলা ছবি নিয়ে কখনো তেমন কিছু বলে না ও, একটু অবাকই হলাম- তখন আসলে আমি ছবি তোলার কথা ভাবছিলাম না ঠিক, মনের ভেতরের কালবোশেখী খানিক থেমে গিয়ে বর্ষণ তখন আমার চোখে!

সেদিন রাতে আমি খুব কেঁদেছিলাম- অনেক দিন থেকে দেখা একটা স্বপ্ন এমন অদ্ভুতভাবে বাস্তবতা পেল সেই খুশীতে না কি সেই বাস্তবতায় অমি না হয়ে সুহাস ছিল সেই কষ্টে! প্রায় প্রতি রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখি- শহর থেকে দূরে একটা ব্রীজে এমন করে পা ঝুলিয়ে বসে আছি দুজন, দ্বিতীয়জনের মুখটা আমি কখনো দেখি নি; অমি’কে বলতাম প্রায়ই শহর থেকে দূরে কোন নদীতীরে যাওয়ার কথা, কেন যেন হয়ে উঠল না! আর যে আমাকে চেনে না, আমার স্বপ্নের কথা জানে না তার কাছে এমন করে আমার স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে আমি কখনো ভাবি নি! সেরাতে বহুদিনে কল্পনার সেই জোছনা রাত আবার স্বপ্নে এল আমার, সাগর-বেলায় বসে আছি দুজন- খুব কাছাকাছি!যে মুখটা কখনো দেখি নি, মুখ ফেরাতেই দেখলাম তা সুহাসের, ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার! আমার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল! অমি-কে রাতে ফোন করা হয় না আমার কখনো, গভীর রাতে ওকে ফোন করে আমি খুব কাঁদলাম, খু-উ-ব! ঘুম ভেঙ্গে অবাক হয়ে অমি বারবার জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে, শুধু অস্ফুটে একটা কথা-ই বলছিলাম- কেন তুমি নও? কেন তুমি নিয়ে গেলে না আমায় কখনো? আর কিছু বলতে পারি নি!

ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে! তাসলিমা আর মুসলিমা, ভদ্রমহিলার দুই নাতনী জাম ভর্তি প্লেট নিয়ে টানাটানি আর খুনসুটি করছে! তাসলিমাকে দেখে ছেলেবেলা মনে পড়ছিল আমার- ঝাকড়া কোকড়া চুল ভিজে চপচপে, মুখে কি অনাবিল হাসি সে তুলনায় ছোট মুসলিমা যেন বেশ ভারিক্কী! বেশ কটা ছবি তুললাম ওদের, এত ছোটাছুটি করছিল দুজন, শাটার স্পীড কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না! আমার কাজ-কর্মের ব্যাপারে অমি-র কোন আগ্রহ দেখি নি কখনো, এক সময় নিজ থেকেই ওকে সব গল্প করতাম, একটা পিঁপড়ের ছবি তুললেও জোর করে দেখাতে চাইতাম- ‘ভাল হয়েছে’ ছাড়া আর কোন মন্তব্য পাই নি, খুব ভালো বা কম ভালো বা পচা কিছু-ই না, তাই অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি জোর করে আমার তোলা ছবি দেখানো! আজ ও নিজ থেকেই ক্যামেরা-র ডিসপ্লেতে চোখ রেখে বলছে- তাসলিমাকে দেখে মনে হচ্ছে ছোটবেলায় তুমি অমনি ছিলে! ছবিগুলো দেখছি ক্যামেরার স্ক্রীনে, হঠাৎই ওদের উল্লাস-ধ্বনি শুনতে পেলাম- ঝির ঝির বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ওদের ছোট কাকা আসছে, দুজন কাকা-র দুহাত ধরে ঝুলে পড়েছে! চট করে আমার চোখ চলে গেল দরজার কাছে- সেই তরুণী বধূ-র চোখে আনন্দাশ্রু, এই এখান থেকেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!

খুব ধীরে ধীরে সুহাসের কাছে আমার স্বপ্ন আর না-বলা চাওয়াগুলো পূর্ণতা পাওয়া শুরু করল! আমি ধরেই নিয়েছিলাম, মানুষের জীবন এমনি- স্বপ্নগুলো কখনো সত্যি না হওয়ার আর অনেক অনেক অপ্রাপ্তির! সুহাস যদি আমাকে বা আমার কাজকে জানার আগ্রহ না দেখাত, ধরে নিতাম অমি-ই ঠিক, ওর কাছে আমাদের সম্পর্কটা অনেক দামী, আমাদের ভবিষ্যতটা আঁকাতে ও বেশী সচেষ্ট- বর্তমানের আমি’টা কেন যেন থেকেও নেই- আমি মেনে নিয়েছিলাম! অথচ ওর অফিস, ওর কাজ, ওর ভালো লাগা, ওর সুন্দরী কলীগ সব ব্যাপারেই আমার যেমন আগ্রহ তেমনটা সুহাসের আমার প্রতি। আমি মানুষটা এমনই আর অমিও হয় তো অন্যরকম মানুষ- আমি তো এমনটা মেনেই নিয়েছিলাম, প্রত্যাশা করি নি তো কিছু! সুহাস না এলে হয় তো জানা হতো না কখনো, ওসব ছোট ছোট চাওয়া পূরণ হতে পারে, ওগুলো নিয়ে কেউ ভাবে! আমার অবচেতন মনে ওই চাওয়াগুলো কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল, একটুখানি আলো দেখতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল! আমি প্রচন্ড কষ্ট পেতে থাকলাম! ছি! কেন আমি সবকিছুতে সুহাস আর অমি-কে তুলনা করছি! অমি আমার কোন ছবি দেখে বলে না- "ছি ছি! এটা কী তুলেছ তুমি! একদম ভালো হয় নি!" কিন্তু ও আমাকে আরো বেশী কিছু দেয়- ফিল্টার কিনে নিয়ে এল একদিন, আকাশের নীল রঙ যে আসে না আমার ছবি’তে! কিন্তু আমি যে ফিল্টার চাই নি- ওই মুহূর্তটা চেয়েছিলাম,অথচ যদি বলত- কী পচা আমার ছবি, আকাশের নীল রঙ নেই- তাহলেই বেশী খুশী হতাম! আমি যে খুব করে চেয়েছিলাম- ওই ছবিটা তোলার পরমুহুর্তের আনন্দটা ভাগ করতে ওর সাথে! অমি-র উপর খুব অভিমান হতো আমার, ইচ্ছে হতো ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি, ওকে আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিই, ইচ্ছে হতো জিজ্ঞেস করি- আমার ছোট ছোট চাওয়াগুলোকে কেন অমন করে পায়ে ঠেললে তুমি! কেন আমার স্বপ্নে তুমি এলে না! কেন না!

দরজা পেরিয়ে চুড়ি পরা হাতজোড়া বেরিয়ে এল আবার, তাতে একটা প্লেটে সদ্য কুড়ানো জামের ভর্তা! আমার চাইতেও বেশী অবাক অমি- গ্রামের এই আতিথয়তার সাথে পরিচয় নেই ওর! মনে আছে, একবার থার্ড ইয়ারে এক কোর্সের সার্ভেয়িং এর জন্যে গুলশানের এক এপার্টমেন্ট থেকে আমাদের প্রায় গলা-ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল, দেশের খ্যাতনামা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পরিচয় পত্র বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো অনুমতিপত্র সেই অপমান থেকে বাঁচাতে পারে নি! আর এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা পথিকদের ঝড় থেকে শুধু আশ্রয়ই মেলে নি শুধু, আন্তরিক আতিথয়তা পাচ্ছি সবাই! সেই দাদী আবার আমাকে বললেন- আপনাদের একটা ব্যাগে করে দিয়ে দিই জাম? তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা ছিল না, এই আন্তরিকতার কাছে পোষাকী ধন্যবাদ যে ভীষণ মেকি!

একদিন সুহাস আমায় বলল, আপনার তোলা ছবিগুলোতে দুটো জিনিস বেশ লক্ষণীয়- ১। সরলতা আর ২। বিষণ্নতা! আপনি খুব একা একজন মানুষ, আপনার কী দরকার জানেন?- ভালোবাসা, বানের জলের মতো ভালোবাসা! আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, নাহ! আমি কখনো-ই একা নই, আমাকে সবাই ভালোবাসে! সুহাস বলল, আরে বোকা! আমি তো ভিন্ন রকম ভালোবাসার কথা বলেছি! আমি খুব জোর দিয়ে বললাম- আমার অমি আছে, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু! নিজের কথাটা কি আমার নিজের কাছেই ফাঁকা শোনাল!! অমি-র ভালোবাসার প্রকাশটা তীব্র নয়, কিন্তু ভালবাসাটা তো সত্য! কিন্তু…কিন্তু……আমি কি ভালোবেসেছি কখনো অমি-কে? নিজেকে খুব ঘেন্না হলো আমার! কেন যেন মনে হলো আমি অমি-কে প্রতারণা করছি, প্রতারণা করে আসছি অনেক দিন থেকে… আমি সুহাস-কেও প্রতারণা করছি! আমি কি নিজেকেই প্রতারণা করছি না?

আমরা আবার পথে নামলাম, ঝড়ের তান্ডব খুব স্পষ্ট চারপাশে! কারো চাল উড়ে গেছে, ডাল ভেঙ্গে পড়েছে! একটু দূরে দেখি এক বিশাল জাম গাছ পড়ে রাস্তা আটকে ফেলেছে, একটা আস্ত ঘর ভেঙ্গে পড়ে আছে তার নীচে! আমি বলে উঠলাম- খুব বাঁচা বেঁচে গেছি আমরা, যে দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিলাম ওই ঘরের উপরেই তো ছিল সেই জামগাছটা! অমি বলল- ‘বোধ হয় সেই ভদ্রমহিলার অমন দোয়া-দরুদের জন্যেই আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন, যতক্ষণ ঝড় বইছে ততক্ষণ তো উনি বিরাম দেন নি!’ সে সময় আমি খানিক বিরক্ত হয়েছিলাম বলে খুব গ্লানি হলো আমার!

আমাদের কাছাকাছি থাকার সময়টা কেমন যেন ক্লেদাক্ত হয়ে উঠছিল! সময় হয়ে গিয়েছিল দুটি পথ চিরদিনের জন্যে আলাদা হয়ে যাওয়ার!












***

আঃ এতক্ষণ কোথায় ছিলে? (গাল ফুলিয়ে)

সুঃ বারান্দায় ছিলাম!

আঃ হু, তা তো থাকবেই, আমি কে! আমি তো কেউ না! (অনেক অভিমানী হয়ে উঠছি আমি প্রতিদিন)

সুঃ (একগাল হেসে) বা রে, ডাক্তার-নার্স আর অমি ছিল যে তোমার পাশে! তুমিই না বললে ওদের সামনে যেন না আসি আমি কখনো!

আঃ হু! বলেছিই তো! ওরা যে তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়! তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো কখনো?

সুঃ নাহ! কখখনো যাবো না আমি তোমায় ছেড়ে!

আঃ আচ্ছা, কেন যাবে না শুনি! হু হু? (দুষ্ট হাসি হেসে, চোখ নাচিয়ে)

সুঃ হা হা হা! ইউ লিটিল ডেভিল! প্রতিদিন শোনা চাই, না?

আঃ হু হু! (আদুরে বেড়ালের মতো সুহাসের বুকে মুখ গুঁজে) বলো-ই না কেন!

সুঃ তোমাকে যে ভালবাসি!

ভালবাসি!

ভালবাসি! (বুকের কাছে জোরে আকঁড়ে ধরে, যেন কেউ আমাদের আলাদা না করতে পারে)

আঃ আচ্ছা, আজ কি শোনাবে বলো…

সুঃ রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ… (কেবিনের বারান্দা থেকে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে…)


“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!......”






***

চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরে পাহাড়ের কোলে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দোতলায় আমার কেবিনের বারান্দা থেকে কর্ণফূলী দেখা যায়! প্রতিদিন নিয়ম করে দেখা করতে আসে অমি! ডাক্তার আর নার্সের সাথে জোট বেঁধেছে ও, ওরা যে পাগলের মতো কী কী সব বলে- সুহাস বলে না কি আসলে কেউ নেই, সবই আমার কল্পনা, অমি-র কাছে আমার না-পাওয়া গুলো নিয়ে আমি না কি আরেকটা স্বত্ত্বা তৈরী করেছি নিজেই! আমি না কি কল্পনা আর বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলছি! তাই আজকাল আমি আর কাউকে সুহাসের কথা বলি না, ওকে আমি আমার মনের এক্কেবারে গহীনের ঘরটাতে লুকিয়ে রাখি! আর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, পাহাড়ের মাথায় চাঁদ ওঠে আর জোছনায় ভরে যায় চরাচর... আমি সুহাসের বুকে শুয়ে কবিতা শুনি- ওর লেখা কবিতা, আমার জন্যে, শুধু আমার জন্যে!





...
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:১২
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:২৪



চাইলে জিয়াউর রহমান ঢাকায় ঝাঁ চকচকে দালান কোঠা রাস্তা বানিয়ে সবার চোখ ধাঁধিয়ে উন্নয়ন করার বাহাদুরি করতে পারতেন। সেটা না করে তিনি ঘুরতে লাগলেন সারা দেশে, গ্রামে গঞ্জে গিয়ে খাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জবাবদিহিতার অনন্য দৃষ্টান্ত

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৫

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয় সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে। সেসব পোস্টে তার বিরুদ্ধে বিপুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি যাত্রা করবেন নাকি রাজনীতি করবেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:১১


ইদানীং দেশে রাজনৈতিক দল গজানোর হার দেখলে মনে হয়, দেশের মাটিতে এখন ধান নয়, গজায় দল। ভোট এলেই বুঝি এই দলগুলো দুলে ওঠে, আর না এলেই পড়ে থাকে ফাইলের পাতায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের নেতারা যদি সত্যিই নির্দোষ হতেন, তাহলে তারা পালিয়ে গেলেন কেন?

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:০৯

আওয়ামী লীগের নেতারা যদি সত্যিই নির্দোষ হতেন, তাহলে তারা পালিয়ে গেলেন কেন?

পলায়নপর ছবি কৃতিত্ব এআই

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দেশ ছেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সুরের জাদু: গিটার বাজালে কি ঘটবে?

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৪১



গাজীপুরের পুবাইলের পুরনো গির্জাটি রাতের আঁধারে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই গির্জার নির্মাণকালে কিছু না জানা কুসংস্কারের অনুসরণ করা হয়েছিল। গাজীপুরের লোককথায় বলা হয়, এই গির্জার নিচে আটটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×