এসো, মজার একটা খেলা খেলি!
চোখ বন্ধ করে ভাবো তো- আমি মরে গেছি! খাটিয়া-তে শুয়ে, সাদা চাদরে আমার শরীর ঢাকা - কেবল মুখটা এখনো নিরাবরণ! শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে তুমি হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলে, একটু-র জন্যে শেষ দেখা দেখতে পেলে আমায়!
আচ্ছা, মৃত মুখের কী কোন অভিব্যক্তি থাকে? হয় তো মৃত্যুর ঠিক আগে আমি সুন্দর কিছু ভাবছিলাম বা দেখছিলাম, তাই ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসির আভাস, গালের টোলটাও বোঝা যাচ্ছে বেশ! চোখ নীমিলিত, নাকে আর কানে নিশ্চয়ই তুলো গোঁজা আছে! কিন্তু আমি তোমায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তোমার ভেতরের ভাবনাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি!
আহ, যদি সত্যিই এমন হতো!...
দুদিন থেকে আমার কোন খোঁজ না পেয়ে একটু কি টেনশানে ছিলে তুমি? বাড়ীর কুকুরটার প্রতিও মানুষের মায়া জন্মে, আর আমি তো রক্ত-মাংসের মানুষ, সে দুর্জনে যতো-ই রোবট বলুক না কেন! ইয়াহু-তে নেই, টেক্সট করে হয় তো রিপ্লাই পাচ্ছিলে না; ভাবছিলে - পাগলীটার আবার নতুন পাগলামী শুরু হলো! তুমি জানতেই পারতে না আমার মৃত্যুর খবর, ছাত্রাবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরদিন পত্রিকা-র পাতায় ছোট্ট
শিরোনামে মেধাবী হতে পারতাম! তবে আজকাল তো ব্লগ আছে, সত্য-মিথ্যা-বানোয়াট যে কোন সংবাদ-ই সেখানে বাতাসের আগে ছড়ায়! হুট করে তোমার প্রথম পাতায় চোখ গেল, শিরোনাম দেখে চমকে উঠলে,অভিমানী ব্লগার আহাদিল অভিমান করে শুধু ব্লগ নয়, দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন!
সেই মুহূর্তে তোমার ঠিক কী অনুভূতি হয়েছিল, আমি দেখতে পাই নি; কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তোমাকে স্পষ্ট পড়তে পারছি, একদম স্পষ্ট!
খাটিয়ার সামনে মাথা নীচু করে বসে থাকা তোমাকে দেখে অনেকে-ই নানান কথা ভাবছে, তোমার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান হয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেছে, অপেক্ষা করছে ঠিক সময়ের জন্যে! কেউ কেউ ভাবছে, বেচারা অনেক কষ্ট পাচ্ছে! অথচ আমি যা শুনতে পাচ্ছি, তা কি ঠিক ! বার দুয়েক কান ঝেড়ে নিলাম! এবার আমার সত্যি সত্যি হাসি পাচ্ছে- তুমি ভাবছ, বাঁচলাম! বেঁচে থেকে যা জ্বালানোটা-ই না জ্বালাল, এবারে নাকে তেল দিয়ে নতুন করে ভাবা যাবে! এই কথা শুনে আমি কি ঘাবড়ে গেলাম! নাহ, আমি দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে আর কিছুটা সময় পার হওয়ার অপেক্ষা শুরু করলাম!
তুমি এখন একদম শব্দশূন্য, ব্ল্যাঙ্ক…কিছুক্ষণ পরেই শব্দরা ছুটোছুটি করে আসতে শুরু করবে তোমার কাছে, সেই সাথে শুরু হবে তীব্র দহন! বিশ্বাস করো, এই আমি লিখে দিচ্ছি, জীবদ্দশায় তোমাকে যতটা যন্ত্রণা দিয়েছি, তার থেকে অনেক, অ-নে-ক গুণ বেশী যন্ত্রণা দেবে আমার এই মৃত হাসি মুখ!
সে যে কী আগুন, দেখা যাবে না, শুধু পোড়া গন্ধটা টের পাওয়া যাবে!
বুকের ভেতর বাঁধভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে তুমি এই নাগরিক জীবনে হাসিমুখে চলার চেষ্টা করবে! বিশ্বাস করো আর না-ই করো, বেঁচে থেকেও কতজনের কাছে নিজেকে মৃত বানিয়ে ফেলেছি তাদেরকে নতুন জীবন দানের জন্যে, নতুন করে ভাবতে শেখানোর জন্যে! হয়ত তাদেরকে ভালবাসি নি, কিন্তু শুভকামনা ছিল সবসময়! অথচ এই তোমার কাছে কি না মৃত্যুর পরেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি, এই যে তোমার যন্ত্রণা হচ্ছে; আমার বুকে সুখের মতোন ব্যথা হচ্ছে আর এই আমি কি না মানুষের অল্প কষ্টেই কাতর হয়েছি এত দিন। মৃত্যু... মৃত্যু আমাকে এ কী নিষ্ঠুরতা শেখাল! এই যে এখন আমার মাথায় তোমাকে নতুন নতুন যন্ত্রণা দেয়ার দুষ্ট বুদ্ধি চাপছে।
কী আশ্চর্য! পরকালেও মানুষ এরকম করে ভাবে!
ভাবছিলাম কী জানো, ম্যুভিতে দেখায় না অনেক সময়, নায়ক বেঁচে আছে, নায়িকা মরে গেছে, তবুও প্রায়ই নায়িকা সাদা পোষাক পরে নায়কের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে; তীব্র যন্ত্রণায় তুমি যখন তলিয়ে যেতে থাকবে, আমিও ওরকম সাদা পোষাকে তোমার পাশে এসে দাঁড়াব। হাত বাড়িয়ে তোমাকে টেনে তুলব না, আরো বেশী কষ্টে ডুবে যেতে দেব! কিন্তু আমার প্ল্যানটা কার্যকর করা যাচ্ছে না, জানো না তো, স্বর্গেও রেসিজাম আছে! দেখ কান্ড, আমি ভেবে নিলাম- মৃত্যুর পর আমি স্বর্গেই এসেছি, নরকেও তো ঠাঁই হতে পারত আমার! সে যাক, ভেবে যখন ফেলেছি! যা বলছিলাম- এখানে সবার পোষাক সাদা নয়, শুধু যারা পৃথিবীর সমস্ত পিছুটানের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে- তাদের জন্যে সাদা রঙ! যখন বেঁচে ছিলাম, বন্ধন এড়ানোর কী সুতীব্র প্রচেষ্টা ছিল আমার অথচ এখন মৃত্যুর পরও পিছুটান ছাড়ছে না- স্বর্গের আরাম আয়েশের দিকে আমার খেয়াল-ইনেই, তোমাকে নিত্য নতুন কষ্ট দেয়ার ফন্দী আঁটছি!
আমার মতো যাদের মন পড়ে আছে দুনিয়া-তে, তাদের পোষাকের রঙ সবুজ, টিয়ে পাখীর গায়ের রং এর মতো মিষ্টি একটা সবুজ! সাদা পোষাকের ওদের গা থেকে দ্যুতি বের হয়, চোখ ঝলসে যাওয়া আলো; আমাদের এমন দ্যুতি নয়, কিন্তু আমাদের গা থেকে একটা অদ্ভুত মেটে গন্ধ বেরোয়- ঠিক বৃষ্টির পর পর গেঁয়ো পথ থেকে মাটির যে সোঁদা গন্ধটা বের হয়, অনেকটা ওরকম! আমি এখানে একদম একঘরে হয়ে আছি, মেটে গন্ধটা টের পেলেই শুভ্র পরীরা দূরে চলে যায়! আমার অবশ্য তাতে কিছু-ই আসে যায় না, আমি তো আছি তোমাকে নিয়ে! জানো তো, স্বর্গেও শাস্তি আছে, যারা সবুজ তাদেরকে পিছুটান মুক্ত করে ‘নির্বাণ’ মানে সাদা’তে উত্তরণের জন্যে অনেক রকম যোগ-সাধনা! আমার একদম ইচ্ছে নেই! এই যে, সারাক্ষণ তোমাকে দেখছি, পড়ছি, ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যেতে দিচ্ছি- এতেই আমার বিষাদময় আনন্দ!
কোন রকম যোগ সাধনা ছাড়াও আরো একভাবে নাকি নির্বাণ লাভ করা যায়! যদি কোন এক বৃষ্টিধোঁয়া বিষণ্ণ সকালে তুমি আমায় একদম ভুলে গিয়ে খুব ভালোবেসে আর কারো হাত ধরে হাঁটো, ঠিক তখন শঙ্খ বেজে উঠবে স্বর্গে আর আমি সবুজ পালক ঝরিয়ে সাদা পায়রা হয়ে যাবো!
আচ্ছা, হাঁটতে হাঁটতে পথ ভুলে যদি তোমরা কোন গভীর সবুজ বনে ঢুকে পড়ো, মাটির সোঁদা গন্ধ কি তোমায় কিছু-ই বলবে না? আর সবুজ রঙ এর টিয়ে পাখীটা?
তাকে দেখলে কি দূর থেকে কারো ম্লান হয়ে যাওয়া হাসি-মুখ মনে পড়বে না তোমার!...
শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ রানা ভাই
'সবুজ জোছনা' শব্দটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:২৭