
কলকাতা পর্ব
দিল্লী পর্ব
১৭ অক্টোবর ২০১১
সোমবার
কালই ফিরলাম চন্ডীগড় থেকে দিল্লী, চন্ডীগড়ে থাকা-কালীন তরুণ স্থপতিদের উৎসবের নানান ব্যস্ততায় লিখা হয়ে উঠে নি! কী, খুব রাগ হয়েছে আমার উপর? স্যরি! আচ্ছা বাবা, এই আমি কানে ধরলাম! তাতেও হলো না? ঠিক আছে, এই আমি তোমাকে 'তুমি' করে বলছি! এবার খুশী?
১৩ তারিখে কত যে কাহিনী করে আমরা চন্ডীগড় পৌঁছুলাম আর তারপর ১৪, ১৫, ১৬ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তো সেমিনার এর নানান ভেন্যুতে, আমার প্রেজেন্টেশানের জন্যে খানিক প্রস্তুতিরও দরকার ছিল গেস্ট হাউসে ফিরে রাত্তিরবেলায়, তাই লিখতে বসা হয় নি! কিন্তু এ কদিন ঘোরাঘুরির ফাঁকে যখনই একটু ফুরসত মিলেছে বা সেমিনারের লেকচার যখনই একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছিল, আমার মন কিন্তু চলে যাচ্ছিল তোমার কাছে!
চন্ডীগড় শহরটা খুব সুন্দর, ভারতের প্রথম ডিজাইন করা শহর যা তার অনন্য নগর পরিকল্পনা আর স্থাপত্যকীর্তির জন্যে দেশে-বিদেশে সমাদৃত! ১৯৪৭ সালে ভাগের সময় পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে তার রাজধানী 'লাহোর' চলে যায় পাকিস্তানে, তখন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের নতুন রাজধানীর প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত আগ্রহেই চন্ডীগড়ের ডিজাইনের জন্যে নিযুক্ত করা হয় বিশ্বখ্যাত ফ্রেঞ্চ (সুইস বংশোদ্ভুত) স্থপতি লী কর্ব্যুসিয়ারকে!অবশ্য তার পূর্বে প্রাথমিকভাবে এ শহরের মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কাজ করেন আমেরিকান স্থপতি আলবার্ট মাইয়ার এবং পল্যান্ডের মেথেও নওয়িকি!এ শহরের অনেক ভবনের ডিজাইন করেন স্থপতি কর্ব্যুসিয়ার এবং পিয়েরে জেনারে!
১৪ তারিখে সেমিনারের প্রথম দিনে আমাদেরকে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব দেয়া হয় একজন সিনিয়র স্থপতি প্রীতি ভাটিয়া-কে! মিস প্রীতি আমাদের যখন পিক করতে এলেন গেস্ট হাউসে, খুবই অবাক হয়েছিলেন! বাংলাদেশ থেকে আগত দুজন স্থপতি ডেলিগেট যারা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়ও এত ছোট দেখতে! খুব বুঝতে পারছিলাম, বিস্ময় গোপন করে উনি আমাদের সাথে অনেক প্রফেশনালি কথা বলছিলেন, আমরাও তাই যেন কিছু বুঝতেই পারি নি!
চন্ডীগড় খুব ছোট শহর, ছিমছাম; ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের খেতাবপ্রাপ্ত! আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল সুখনা লেক, ভেবো না এর মানে শুকনো লেক! ওদের ভাষায় 'সুখনা' মানে কোন কিছু চাওয়া, তোমাকে ওখানে কিছু উইশ করতে বললে কী চাইতে তুমি? সত্যি করে বলো, একদম লুকোবে না কিন্তু! আচ্ছা যাও, বলতে হবে না! লেকটা খুব সুন্দর, ওপারে পাহাড় দেখা যাচ্ছিল!ওখানে খুব কম সময় থেকে আমরা পরবর্তী গন্তব্য রক গার্ডেনের দিকে ছুটলাম! মিস প্রীতি আমাদের গাইডের কাজও করছিলেন, অল্প সময়েই আমরা বেশ মানিয়ে গেলাম; স্থপতি বলেই আমরা কী জানতে চাই উনি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিলেন!

সুখনা লেক

রক গার্ডেন ১

রক গার্ডেন ২
রক গার্ডেন খুব অনন্য এক বাগান, যার স্রষ্টা নেক চাঁদ ছিলেন একজন রোড ইন্সপেক্টর; যিনি তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাথরের টুকরো বা রক, শিল্পকারখানার অব্যবহৃত বর্জ্য সংগ্রহ করতেন! ক্রমেই তার এই সংগ্রহ এক বিশাল বাগান হয়ে যায় একটা ছোট্ট ঘরকে কেন্দ্র করে যেই ঘরে নেক চাঁদ এই কাজগুলো করতেন! ১৯৭৩ সালে ডঃ কে এস শর্মা নামের একজন এই বাগান আবিষ্কার করেন এবং ১৯৭৬ সালে এর আনুষ্ঠানিক উদবোধন হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একে এর বর্তমান অবস্থায় সংরক্ষণ করা হবে!
তারপরে আমরা যাত্রা করি চন্ডীগড়ের কর্বুসীয়ার এর ডিজাইন করা মহাকাংক্ষিত ক্যাপিটল কমপ্লেক্স দেখতে যার জন্যে আমার এত কষ্ট স্বীকার করে চন্ডীগড়ে যাওয়া! এত অল্প সময়ে অনুমতি নেওয়া সম্ভব হয় নি আর তাই আমরা পাঞ্জাব হাই কোর্ট (এটাও কর্বু বাবার ডিজাইন) এর মধ্য দিয়ে এর সামনের প্লাজায় গেলাম যেখান থেকে তিনটা ভবন (সেক্রেটারিয়েট, এসেম্বলী ভবন এবং হাইকোর্ট) একসাথে দেখা যায় আর এই সেই ল্যান্ডস্কেপ যেখানে কর্বুর ম্যুভিং হ্যান্ড দাঁড়িয়ে আছে! তোমাকে তো বলা হয় নি, এই বৃদ্ধ নাক-উঁচু লোকটাকে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ভীষণ ভালবাসি আর আদর করে কর্বু ডাকি! হুম!

এসেম্বলী ভবন

সেক্রেটারিয়েট এবং এসেম্বলী ভবন

পাঞ্জাব হাই কোর্ট (আমার বন্ধুরা সবে, যেবার আমি যেতে পারি নি)

দ্য ম্যুভিং হ্যান্ড
এরপর আমরা গেলাম এই বিশ্বখ্যাত স্থপতির ডিজাইন করা আর্ট গ্যালারী আর মিউজিয়াম দেখতে! আর্ট গ্যালারীতে তখন এই ইয়াং আর্কিটেক্টস ফেস্টিভ্যালেরই প্রদর্শনী চলছিল- চন্ডীগড়ের স্থপতিদের কাজ নিয়ে!

আর্ট গ্যালারীতে প্রদর্শনী

জাদুঘর

জাদুঘরের এক অংশের ভিতরে
বিকেল চারটেতে শুরু হবে উদবোধনী অনুষ্ঠান! তার আগেই আমাদের লাঞ্চ সারতে হবে, ক্ষিধাও লেগেছে অনেক!সকালে কী খেয়েছি জানো? আলু পারাটা আর দই!একদিন ভালো লাগে এরকম খাবার, তাই বলে প্রত্যেক সকালে!! বুঝি না পাঞ্জাবীরা এরকম হাট্টা কাট্টা হয় কীভাবে, খায় তো সব নিরামিষ! প্রথমবারের মতো আমি বুঝলাম, আমার পক্ষে নিরামিষাশী হওয়া সম্ভব না! সে যাক, যা খেলাম তার নাম রাজমা-চাউল! রাজমা জিনিসটা খেতে মজা, বীনজাতীয় একটা জিনিসের ডাল; প্রীতি ভাটিয়া বললেন, এটা নাকি ওদের স্পেশাল মেনু, আরে ভাই এরকম ডাল তো আমাদের মেনুর একটা কম্পালসারি প্রতিবেলার আইটেম, শীমের বীচির ডালের মতো; এটা আবার স্পেশাল মেনু! ফুহ! ইশশিরে ছবি তোলা হয় নি, নইলে তোমাকে দেখানো যেত!
ভারতীয় স্থপতি ইন্সটিটিউট এর চন্ডীগড়-পাঞ্জাব অংশের সভাপতি সুরিন্দর বাহগা আর যুগ্ম সম্পাদক অর্চনা চৌধুরীর সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল, আর আগের রাতে পরিচিত হয়েছিল মিঃ খুরানা-র সাথে, মোটাসোটা কিউট একটা মানুষ! আমাদের দেখে তার চোখে মুখে কী বিস্ময়, সেমিনারের একদম শেষের দিনে তা প্রকাশই করে ফেললেন! রাতে সুখনা লেকে ছিল ডিনার, ভারতে সেমিনারের না কি একটাই মজা- আনলিমিটেড লাল পানি, কুশলের চোখ-মুখ তো চক চক করতে লাগল, আর তাছাড়া আমাদের তখন পরিচয় হয়েছে আলেকজান্দ্রা নামের পোল্যান্ডের এক সুন্দরী মেয়ে আর তার সংগী দুইজনের সাথে! ওরা আমায় ব্র্যান্ডি খাওয়ার জন্যে খুব চাপাচাপি করল, কিন্তু আমার তো অরেঞ্জ জুসই ভরসা!

রবীন্দ্র থিয়েটারের রিসেপশান

উদবোধনী অনুষ্ঠান

সুখনা লেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ডিনার

আলেকজান্দ্রা, তার কলীগ এবং কুশল

পরদিন রকগার্ডেনে ঐতিহ্যবাহী পাঞ্জাবী নৃত্য-গীত

খাবার-দাবার খুবই ইয়াম্মী ছিল

পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি গেস্ট হাউস, যেখানে আমরা ছিলাম
এর পরের দুদিন তো কাটল সেমিনার এর লেকচার শুনতে শুনতেই, আর এর ফাঁকে ফাঁকে তোমার সাথে মনে মনে কথার খেলা খেলতে খেলতে!প্রতিরাতেই ভেবেছি লিখব, কিন্তু কখন যে মনে মনে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেছি!আচ্ছা, আমার চিঠিগুলোর উত্তর দিবে কবে বল তো- এ কদিনের মানে ৮ থেকে ১৯- ১,২,৩......১২ টা চিঠি! না পেলে কিন্তু আর কথা বলছি না, হুম! জানো, আমার আর কুশলের প্রেসেন্টেশানের সবাই খুব প্রশংসা করল, CEPT এর স্থাপত্য বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, বর্তমান প্রধান এবং ভবিষ্যত প্রধান- এই তিনজন নিজেরাই আমার সাথে কথা বলতে এলেন, বললেন আহমেদাবাদে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন, আমার রিসার্চের বিষয়ে কথা বলার জন্যে- তখন তুমি আমার সাথে যাবে তো? আমরা তখন খুব ঘুরব, কেমন?
চন্ডীগড়ের রাস্তার মজার ব্যাপার কী জানো তো, প্রচুর মেয়েদের দেখা যায় স্কুটি চালাচ্ছে, আন্টিরা তাদের পিচ্চিদের স্কুটির পেছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যায় আর মাঝে মাঝে আংকেলদেরও দেখা যায় স্কুটির পেছনে! জানোই তো আমার কেমন স্কুটির শখ, এবার দেশে ফিরে কিনেই ফেলব; কুশল অবশ্য বলছিল আপু, এক কাজ করেন- এখান থেকেই কিনে নিয়ে যান! হা হা, আচ্ছা, আমি যখন স্কুটি কিনব, তোমাকে স্কুটির পিছে বসিয়ে সারা ঢাকা চক্কর কাটব, আর মাঝে মাঝে টং এর দোকানে ফুচকা আর চা, ঠিক তো?
চন্ডীগড়ে শিক্ষিতের হার বেশী, পার কেপিটা ইনকামও অনেক বেশী! আর একটা ডিজাইন করা শহরে বাস করা ওই মানুষগুলোর স্থাপত্য সম্পর্কে জ্ঞান যেমন আছে, আছে স্থপতিদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও! তাছাড়া ভারতে আর্কিটেক্টস এক্ট নামে একটা আইন দিয়ে স্থপতিদের অধিকার সংরক্ষিত, আর যে স্থপতি মন্ত্রী এটাকে সম্ভব করলেন সেই পুলী মোদীকে উৎসর্গ করা হলো আমাদের পেপারগুলো নিয়ে ছাপা হওয়া বইটা! ওরাই বারবার বলছিল, বাংলাদেশে যতদিন পর্যন্ত এই আর্কিটেক্টস এক্ট না হবে, স্থপতিদের অধিকার সংরক্ষিত হবে না! স্থাপত্য যে কী তা বুঝতে আর বোঝাতেই তো আমাদের প্রফেশনাল জীবনের অনেকটা সময় চলে যায়, তাছাড়া স্থাপত্য সম্পর্কে যে লোকে কেবল ভাবে ওটা শুধু ধনীদের জন্যে আর এর মানে শুধু সুন্দর বাইরের খোলস- এই ভুল ধারণার বদলটা খুব দরকার!
ওরা চন্ডীগড় নিয়ে খুব গর্ব করে, তাই ফরিদা ম্যাডামের আইডিয়াতেই কুশল লিখেছিল আমাদের গর্ব স্বনামধন্য স্থপতি লুই আই কানের ডিজাইন করা জাতীয় সংসদ ভবন নিয়ে! নে বাবা, শুধু তোদের না আমাদের দেশেও গর্ব করার মতো আছে অনেক কিছু, ওরা সেই প্রেজেন্টেশান দেখে তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ! কিন্তু কী দুর্ভাগা জাতি আমরা বলতো, যে অনন্য কীর্তি বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে দেয় বিশ্বের কাছে এমন মাস্টার পিসের সম্মানও রাখতে জানি না; এমন কি যে স্থপতি এমন মহাকীর্তির স্রষ্টা, তার নির্ধারিত ফি ও আমরা পরিশোধ করি নি এখন পর্যন্ত! কান শেষ বয়সে অনেক আর্থিক কষ্টে ছিলেন আর আমরা সেই নেমকহারাম জাতি যে জাতি শ্রমের মূল্য দিতে জানে না! আমরা সেই কীর্তির সামনে দিয়ে মেট্রোরেল করতে চাই অথচ একই সাথে World Heritage List এ কীর্তিকে রাখতেও চাই বলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবও পাঠানোর কথা! সেই কর্তৃপক্ষ যদি জানে সংসদ ভবনের নাকের ডগা দিয়ে আমরা রেল করতে চাই, তারা এ প্রস্তাব মুহূর্তেই নাকচ করে দিবে!কিছুদিন আগে সংসদ ভবনের সামনে স্থপতি, পরিবেশবিদ আর ছাত্ররা প্রতীকী অনশন করল, এ কজনের অনশনের কিছুই বদলাবে না, সর্বস্তরের মানুষদের যোগ দিতে হবে আমাদের সাথে এ কীর্তিকে রক্ষা করার জন্যে!

সংসদ ভবন নিয়ে কুশলের উপস্থাপনা

স্থপতি-পরিবেশবাদীদের প্রতীকী অনশন

সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সাথে
ইশশশ, কতদিন তোমায় দেখি না! কতবার দেশের বাইরে এসেছি, কখনো ঘরে ফেরার এতটা তাগিদ অনুভব করি নি; ইচ্ছে করছে উড়ে চলে যাই বাবা-মায়ের কাছে, তোমার কাছে! এবার আর শান্তিনিকতনে যাচ্ছি না, তোমার সাথে আসব যখন তখন শুধু শান্তিনিকেতনেই থাকব গোটা দু-তিন দিন! আচ্ছা, তুমি এমনি করে তোমার শত মন খারাপের পরেও আমার পাশে থাকবে তো সব সময়? কখনো ভুল বুঝে আমায় কাঁদাবে না তো? আমার হাসি-মুখ দেখতে এমনি করে ছুটে আসবে তো সব সময়? এই ছন্নছাড়া, উরাধুরা আমাকে ঠিক যেমনটি আছে তেমনটিকেই, একটুও বদলাতে না দিয়ে ভালবাসবে তো সারাজীবন? জন ডেনভারের এই গানটা তোমায় দিলাম! এই গানটা তোমার মতো করে আমার জন্যে গাইবে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত?
[ এই সিরিজের প্রত্যেকটা লেখাই আমি আমার খুব কাছের কোন না কোন বন্ধুকে উৎসর্গ করেছি! আমি সাধারণত অতীতে ফিরে যেতে চাই না, এই লেখাটা উৎসর্গ করলাম আমার খুব খু-উ-ব প্রিয় এক বন্ধুকে, যার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমি মিস করি, নতুন করে ফিরে পেতে চাই!]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:১৪