জামে মসজিদের মূল দরজা
১০ অক্টোবর ২০১১
সোমবার
আমি ইদানীং স্বপ্ন দেখি, সাদা-কালো নয়- লাল-নীল-সবুজ স্বপ্ন! সারাদিন ঘোরাঘুরি আর কুশলের সাথে গল্প করার ফাঁকে টুপ করে ডুব দিই স্বপ্নরাজ্যে! কানে হেডফোন লাগিয়ে স্বপ্নের গান শুনি আর আপনার সাথে মান-অভিমানের খেলা খেলি! কুশল মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়- কী কানে সারাক্ষণ হেডফোন লাগিয়ে রাখেন! আমি রহস্যময় হাসি দিই; স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে ফিরে সুন্দর সময় কেটে যায়, নইলে এত সিস্টেম লস সহ্য করে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লী পৌঁছানো খুব কষ্টকর হয়ে যেত! সারাটা দিনই যে আজ বয়ে গেলো বিমানে করে দিল্লী আসতে গিয়ে, অথচ আমাদের চোখে-মুখে বিরক্তি নেই! কুশলও নিশ্চয়ই কাউকে ভাবে, কাউকে নিয়ে খেলে স্বপ্ন ভাঙ্গা-গড়ার খেলা নইলে আজ সকালে দুদ্দাড় করে দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে যখন শুনলাম বারোটের স্পাইসজেট যাবে আড়াইটেতে তখন তো দুজনেরই অক্ষম রাগে ফেটে পড়ার কথা!
সে যাক, লাগেজ দিয়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে আমরা টুক করে বেরিয়ে পড়লাম আবারো- কলকাতার জীবনের আস্বাদ গ্রহণের জন্যে, এয়ারপোর্টের পার্শ্ববর্তী এলাকায় হাঁটাহাঁটি করলাম! দাদাবাবুদের নিয়ে কুশলের অবজার্ভেশনে হাসতে হাসতে দম ফাটার উপক্রম হলো আমার! আমরা যখন আসব- অবশ্যই পূজোর ছুটি বাদ দিয়ে, অনেক আগে থেকেই রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট কেটে রাখব! দেরী হওয়ার ভয় নেই, টাইমমতো চলে, আবার টাইমলি খাওয়াটা যা দেয়- অমৃত; সবচেয়ে ভালো লাগে ঘুম ভাংলেই বেড টী!
দিল্লীর মেট্রো সার্ভিসটা অ-সাম, আমাদের দেশে যে কবে মেট্রো চালু হবে লাখো মানুষের দৈনন্দিন ভোগান্তি দূর করতে! এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে করেই এলাম নিউ দিল্লীতে, পাহাড়গঞ্জে এখানকার সস্তা হোটেলগুলো, আরো আছে কড়লবাগে! আমাদের হোটেল পাহাড়গঞ্জে- কলকাতার চেয়ে সস্তায় সেখানকার চেয়ে ভালো হোটেল! চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে দেখি সাড়ে আটটা- ইচ্ছে, রাতের খাবারটা খেয়েই পাশের শিলা থিয়েটারে ম্যুভি দেখা! জানেন, কী ম্যুভি দেখলাম? আপনি বিশ্বাস করবেন না শুনলে- রাস্ক্যাল; জীবনে আমি এসব হিন্দী ম্যুভি দেখি না কিন্তু এখন কী আর করা- হলে যা চলে তা-ই তো দেখতে হবে!
হোটেলে ফিরেই আমরা বসলাম- এয়ারপোর্টে বিনামূল্যে পাওয়া দিল্লীর ম্যাপটা নিয়ে; কালকের ট্যুরপ্ল্যান ঠিক ঠাক করলাম! রুট ঠিক করতে করতে একটা বেজে গেলো, আর আমি আপনাকে লিখতে বসলাম! জানেন, দিল্লীর রিকশাগুলো খুব মজার, হুড ফিক্সড বডি-র সাথে- হা হা, রোমান্টিকও বটে; আর আমি কী না সেই রিকশায় চড়ছি কুশলের সাথে! ধুর! তবে হ্যাঁ, ঢাকার রাস্তায় রিকশার হুড ফেলে ঘোরার যে মজা সে আর কোথাও নেই! খুব মিস করছি সেই সময়গুলো! দিল্লী স্টেশন থেকে রিকশায় হোটেলে যাওয়ার সময় ভূমি-র গানটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ-
আমার রাস্তা ভালো লাগে সাদা-কালো-রঙ্গিন
দুস্তর-ধূসর-সীমাহীন
আরো ভালো লাগে সেই রাস্তায়
তোমার সাথে সারাদিন…
কেমন গেল আজ সারাদিন?
সারাদিন অফিস শেষে খুব ক্লান্ত?
ঘুম পাচ্ছে নিশ্চয়ই খুব?
ঘুম পাড়ানীর মাসী-পিসী উড়ে এসে বসুক আপনার চোখে!
শুভ রাত!
১২ অক্টোবর
বুধবার, সকাল ৮টা
কাল রাতে এত্ত টায়ার্ড ছিলাম, রুমে ঢুকেই ঘুম; তাই সকাল হতে না হতেই লিখতে বসেছি আপনাকে! কাল সকাল সকালই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল! এখানকার জনপ্রিয় পর্যটনের জায়গাগুলোতে এত্ত ভীড়, আর এত পরিমাণে দালাল! দিল্লী জামে মসজিদ ছিল আমাদের প্রথম গন্তব্য, তার ঠিক উলটো দিকেই রেড ফোর্ট! জামে মসজিদে কুশল ঢুকে গেল, আর আমাকে দিল আটকে গেটে ক্যামেরার জন্যে! অনেক কষ্টে ওদের চোখকে ধূলো দিয়ে আরেক গেট দিয়ে ঢুকে যেইমাত্র একটু হাঁফ নিবো, অমনি কোত্থেকে দালালটা ছুটে এসে যন্ত্রণা শুরু করে দিল- ২০০ রূপী জরিমানা! কোনমতে পালিয়ে বাঁচলাম, এসব স্পটে ভিডিও ক্যামেরা রেস্ট্রিক্টেড কিন্তু কে বোঝাবে তাদের যে আমার এই বিশাল ক্যামেরাটিতে ভিডিও করা যায় না!
দরজার বাইরে থেকে...
দিল্লী জামে মসজিদ
এবার আমরা ঠিক করেছি পপুলার ট্যুরিস্ট স্পটগুলো বাদ দিয়ে কন্টেম্পরারী আর্কিটেকচার দেখবো, জানি ওসব স্থাপত্য বিষয়ক কচকচানী শুনলে আপনি বোরড হবেন, তাও বলবো- জোর করে শোনাবো! জামে মসজিদ থেকেই আমরা গেলাম প্রগতি ময়দানের কাছে ন্যাশনাল সায়েন্স সেন্টার (মহাবিশ্ব দা’র দিল্লীর অফিস)-যার স্থপতি বালকৃষ দোশী, এর ঠিক উলটো দিকেই মুঘল স্থাপনা ওল্ড ফোর্ট বা পুরান কিল্লা! এর খুব কাছেই বিখ্যাত স্থপতি চার্লস কোরিয়া-র ডিজাইন করা ন্যাশনাল ক্রাফটস মিউজিয়াম। ওখানে মেলা চলছিল, ডিজাইনে পার্মানেন্ট গ্যালারীর-র পাশাপাশি এ ধরনের মেলা বা টেম্পোরারী ডিসপ্লে-র জন্যে প্রোভিসান ছিল! ঐতিহ্যবাহী এবং ঐশ্বর্যশালী নানান অঞ্চলের হাতের কাজ করা সুচারু জিনিসপত্রের এই মেলায় সময়টুকু বেশ ভালো কাটছিল!
ন্যাশনাল সায়েন্স সেন্টার, দিল্লী
ক্রাফটস মিউজিয়াম, দিল্লী
ক্রাফটস মেলায় প্রদর্শিত রিক্সা
রাজীভ চক, কনাট প্লেস
জীবন ভারতী, দিল্লী
ব্রিটিশ কাউন্সিল, দিল্লী
এরপর কনাট প্লেসে এসে আবারো চার্লস কোরিয়ার ডিজাইন করা জীবন ভারতী আর ব্রিটিশ কাউন্সিল! চার্লস কোরিয়ার যে বইটা সব স্থপতি বা স্থাপত্যের ছাত্রদের কাছে থাকে তার প্রচ্ছদে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা ছবি; এর ভিতরটা খুব সুন্দর- সিসিটিভি আর গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফটোসেশান চালালাম আর তারপরে এর লাইব্রেরীতে ঢুকে সেই বইটা নিয়ে বসে গবেষণা করলাম দুজনে!
কী এডভেঞ্চারটা-ই যে করলাম কাল আমি আর কুশল, ঘুরাঘুরি সব মেট্রো, বাস বা পদব্রজে! ম্যাপ দেখে ঘুরতে গিয়ে ভুল করে পরের স্টেশনে নেমে আবার হেঁটে আগের স্টেশনের কাছের কোন স্পটে যাওয়া তো হয়ে গেল সাধারণ ঘটনা! আর হাঁটতে হাঁটতে তো পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল!
সে যাক, এর পরই গেলাম লোটাস টেম্পলে- লাখে লাখে মানুষ প্রসেসান করে যাচ্ছে সেই টেম্পলে কয়েক মিনিট চুপটি করে বসে থাকার জন্যে! সন্ধ্যায় গেলাম জামিয়া ইউনিভার্সিটিতে – স্থপতি রোমি খোসলার ডিজাইন করা দুটো এওয়ার্ড উইনিং প্রজেক্ট দেখার জন্যে, ক্যাফেটেরিয়া আর আর্ট গ্যালারী! শুনলে বিশ্বাস করবেন না সন্ধ্যে সাতটায়ই বন্ধ, মেজাজটা-ই গরম হয়ে গেল! ঢাকা-র কথাই ভাবেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাফে কি এত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়! অনেক কসরত করে পূর্ণ চাঁদের আলোয় ছবি নিলাম ক্যাফে আর গ্যালারীর!
ভালো আছেন আপনি?
শুভ সকাল!
সুন্দর কাটুক সারাটা দিন!
লোটাস টেম্পল
আর্ট গ্যালারী, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
১২ অক্টোবর
বুধবার, রাত সাড়ে ১১টা
আজ আমরা গেলাম গুরগাঁও, লোকে বলে ভারতের সিঙ্গাপুর! আধুনিক অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে গুরগাঁও এ- নতুনভাবে পরিকল্পিত দিল্লীর এক্সটেনশান- মস্ত মস্ত শপিং মল হয়েছে, আছে সুন্দর করে প্রণীত নকশার আবাসন আর উঁচু ইমারত! তবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল কিংডম অফ ড্রিমজ- ন্যাশনাল জিওগ্রাফীতে বিজ্ঞাপন দেখায়, দেখেছেন? শাহরুখ খান সেটার ব্র্যান্ড এম্বাসাডর! দমদম এয়ারপোর্টে ঘুরাঘুরির সময় আমরা লিফলেট পেয়েছিলাম- বোর্ডিং পাস দেখালে প্রবেশ মূল্য মওকুফ এবং অতিরিক্ত ১০০ রূপী কেনাকাটার সুযোগ! কুশলের আগ্রহেই মূলত যাওয়া, তবে সত্যিই উপভোগ করেছি- ভারতের নানান অঞ্চলের খাবার আর ক্রাফটস নিয়ে করা সব কালচারাল গ্যালারী, আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির ধারাবাহী কিছু শোও হয়! ঘুরতে ঘুরতে চায়না টাউন লেখা দেখে ঢুকে গেলাম এক জায়গায় চায়নীজ খাবার খেতে, আর তারপরেই শকড হলাম- রবীন্দ্র সংগীত বাজছে-
ভালবাসি, ভালবাসি………।
গুণ গুণ গাইতে থাকলাম আমিও, ঢুকে পড়েছি নিজের অজান্তেই আমরা পশ্চিম বাংলায়; দুপুরের খাওয়াটা ওখানেই সারলাম!
সমস্ত বিকেলটা ছিলাম আমরা স্বপ্নের রাজ্যে- ফটোসেশান চলল অনেক; মিস করলাম আমাদের কলীগ নিম্মিকে- প্রতিটা ট্যুরে যে একনিষ্ঠভাবে মডেলের অভাব পূরণ করে আসে! ওখানে গেলে ও ছবি তুলতে তুলতে পাগল হয়ে যেত আমি নিশ্চিত! জানেন, আজ যে শাহরুখ এসেছিল ওখানে, আরেকটু হলে দেখা হয়েই যাচ্ছিল আমাদের সাথে; ভেবে নিয়েন না যে আমি শাহরুখের ফ্যান, আমি কেবল কুনাল কাপুরকেই ভালবাসি (হিংসে করেও কোন লাভ নেই!)
স্বপ্নরাজ্যের দুয়ার
স্বপ্নরাজ্যের রাজপথ
পাঞ্জাবের স্টল
ম্যুভি দেখতে চেয়েছিলাম আজ, কিন্তু সবগুলো থিয়েটারে চলছে রাস্কেল; কী রাস্কেলীয় কান্ড বলুন তো! ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কিন্তু ম্যুভি দেখা হলো না; মনটাই খারাপ হয়ে গেল! হাঁটতে হাঁটতে রাজীব চকে এসে দেখি কতগুলো ছেলে গীটার বাজিয়ে গান গাইছে- ভাল্লাগছিল খুব চাঁদ আর নিয়নের আলোয় মাখামাখি হয়ে শহরের বুকে কিছু তরুণকন্ঠে গান শুনতে! মহীনের ঘোড়াগুলির গানটা খুব প্রিয় আমার, আপনাকে দিলাম- গানটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ুন! আমিও শুয়ে পড়ব, কাল সকালেই দিল্লী ছেড়ে রওনা হবো চন্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে!
ভেবে দেখেছ কি
তারারাও কতো আলোকবর্ষ দূরে, আ-রো দূ-রে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে……
উৎসর্গঃ এই লেখাটা আমার খুব কাছের বন্ধু অনিন্দিতা-র জন্যে, যে এখন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে! ক্যাম্পাস এলাকায় কাটানো আমাদের সুন্দর শীতের সন্ধ্যাগুলোর জন্যে, এই সময়গুলো একদম মিস করবি না, একদম না! আর ভালো থাকবি, খুব ভালো থাকবি!