ডিসেম্বর ২০০৭ এ আমরা ১১ জন বন্ধু বেড়াতে গিয়েছিলাম ভূটানে- পাহাড়ের দেশে।ওই ট্যুরে আমার নামকরণ করা হয়- ‘আমি পাহাড়ে যাব’।আমার অপরাধ আমি অন্যদের থেকে এক ঘন্টা আগে ১৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ট্যাঙ্গো মোনাস্টেরি তে পৌছেঁ গিয়েছিলাম। কিন্তু তখনও পর্যন্ত ওদের কাছে অজ্ঞাত ছিল যে কাহিনী তা হলো, তার কয়েক মাস পূর্বে খুব সম্ভবত জুনে সিলেট এ রেলওয়ে স্টেশনে দাড়িঁয়ে একই কথা আমরা (আমি আর অনিন্দিতা) রেলের টিকেটবাবুকে বলেছিলাম- ‘সিলেটে কোথায় পাহাড়ে ঘর-বাড়ী আছে? আমরা পাহাড়ে যাব’।
আমাদের দুইজনের গ্রূপের কাজটা ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব (সিলেট, নেত্রকোনা) আর দক্ষিণ-পূর্ব (রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি)অঞ্চলের পাহাড়ী স্থাপত্য নিয়ে। একই ভৌগলিক সীমারেখায় অবস্থিত হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের এই দুই অঞ্চলের স্থাপত্যকর্মে সাদৃশ্যের পাশাপাশি দেখা যায় বৈচিত্র্য। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল- দুই অঞ্চলের স্থাপত্যের মিল-অমিল তুলে ধরা আর পাশাপাশি তার কারণ অনুসন্ধান করা। সেই মহৎ উদ্দেশ্য সামনে নিয়েই আমরা ট্রেনে চেপেছিলাম আর বরাবরের মতোই ভেবে নিয়েছিলাম সিলেটে পৌঁছেই অভিযান করে সব কিছু খুজেঁ বের করে ফেলব।
আমাদের সেই অভিযানের সময়কার কিছু ছবি নিয়েই এ লেখা (লেখা আসলে কতটুকু হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে)। খুবই সস্তার ডিজিটাল ক্যামেরাতে তোলা ছবিগুলো।
যা হোক, টি.টি. দুজন আমাদের জানালেন, জাফ্লং এর দিকে কিছু মাচাং ঘর (stilt house) ।কাকডাকা ভোরে আমাদের দিকে তাদের বিস্মিত দৃষ্টি দিয়ে শুরু হলো আর এক অভিযানের। পরিকল্পনা হলো কোন একটা হোটেলে ফ্রেশ হয়েই যাত্রা শুরু করব জাফলং এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু হোটেলে জায়গা পেতে গিয়েও ম্যানেজারের বিস্মিত দৃষ্টি আর জিজ্ঞাসা- আপনারা একা ই? (এই প্রশ্ন আমরা সব সময়ই শুনে থাকি) আর আমাদেরও অন্যবারের মতো উত্তর –‘দুজন মানুষ একা হলাম কীভাবে?’
এ গল্প লম্বা না করে মূল ঘটনায় চলে আসি- হোটেলের পাট চুকিয়ে নাস্তা সেরে যাত্রা শুরু করলাম- সিলেটের মূল শহর থেকে সরাসরি বাস যায় জাফলং এ, তবে ওই বাসগুলোকে মুড়ির টিন বলা বেশী মানানসই। সাধারণ ভ্রমণবিলাসীরা মাইক্রোবাস বা স্কুটার ভাড়া করে যান, কিন্তু আমাদের আর্থিক দুরবস্থায় মিতব্যেয়িতার প্রয়োজনে সস্তার হোটেল, সস্তার পরিবহন আর সস্তার খানা……….
জাফলং গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। অনেকটা পথ বাসে ঝুলে ঝুলে গিয়ে দেখলাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি যাকে বলা হত তা এখন শ্মশান হয়ে গেছে। পাহাড় কেটে সমতল, আর মাচাং ঘরগুলো সমভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। stone crusher এর গগনবিদারী শব্দে কানে তালা লেগে গেল। সিলেটের মাটিতে দাঁড়িয়ে দূরে ভারতের পাহাড়ে ঘর-বাড়ী দেখে নিজেদের প্রবোধ দিলাম। ঘোর বর্ষাকালে নদীতে পায়ের পাতা সমান পানি দেখে আমার চোখে নদী বইল।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানলাম কাছাকাছি শ্রীপুর বা শ্রীরামপুর নামের একটা গ্রাম আছে, যেখানে মনিপুরীদের বাস। ও মজার কথা তো বলা হয় নি, জাফলং পৌঁছে নদীর কাছে গিয়ে দেখি আমাদের বুয়েটের তিন বন্ধু- ওরা সকালে গিয়েছিল মাধবকুন্ডে, ওখানে পাহাড়ের গায়ে বসতি আছে কি না জেনে নিলাম ওদের কাছ থেকে। মনিপুরীদের গ্রামে গিয়েও আমরা একই রকমভাবে হতাশ হলাম। মনিপুরীরা খুব সম্ভবত সমতলেই থাকে, তবে ভূমিটাকে কোনভাবে ট্রিট না করে তাতে stilt house তৈরী করে বাস করে। অদ্ভুত সুন্দর সেই গ্রামে যাওয়ার রাস্তা। সারা সকালের বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়ার পর রোদ উঠল দূরের পাহাড়ে, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ চারপাশ- সারা রাতের ভ্রমণের আর সারা দিনের ধকলের ক্লান্তি ধুয়ে গেল যদিও যে কাজে এসেছি তার কিছুই তখনো হয় নি।
সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল (র) এর মাজারে গেলাম - মক্কায় যাব আর হজ্জ্ব করব না তা কীভাবে হয়! মাজারের সামনের মনিপুরী কাপড়ের দোকান থেকে কেনাকাটাও করলাম যা একেবারেই আমার স্বভাব-বিরুদ্ধ। প্ল্যান করলাম পরদিন সকালে যাব মাধবকুন্ডে- রথ দেখা আর কলা বেচা দুটো ই একসাথে করে ফেলার ইচ্ছায়।
সকালে ঘুম ভাংলে দেখি চারপাশ অন্ধকার, মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। চিন্তিত হয়ে গেলাম- আমাদের কাজ তো তাহলে কিছুই হবে না, বৃষ্টিতে ক্যামেরা বের করা তো যাবে না। যাই হোক ভাবলাম আজ reconnaissance survey করে আসি, পরে আবহাওয়ার হাবভাব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। বাসস্টপের সাথেই ছিল আমাদের হোটেল, মুড়ির টিন বাসে চড়ে, রিকশায় চেপে যখন মাধবকুন্ডের পর্যটন এলাকায় ঢুকলাম- ঝিম ঝিম করে নামল বৃষ্টি। বর্ষাতি চাপিয়ে আমরা দুজন হেটেঁ বেড়ালাম মাধবকুন্ডের পাহাড়ী রাস্তায়। পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ছোট্ট এক ঝিরি। ঝিরির অপর পাশে দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে দেশীয় উপাদানে তৈরী ঘর-বাড়ী, আর 'খাসিয়া পল্লী' লেখা একটা সাইনবোর্ড নির্দেশিত করা আছে ওই দিকে। আমরা তো খুশীতে আত্মহারা, 'অবশেষে আমি পাইলাম ইহারে'। চারপাশে তাকিয়ে দেখি- কেউ নেই, সবাই নিরাপদ আশ্রয় খুজেঁ নিয়েছে বৃষ্টিতে, আর আমরা দুই পাগল পিঠে ব্যাক প্যাক আর তার উপরে বর্ষাতি চাপিয়ে কুজোঁ বুড়ীর মতো পথ চলছি। বৃষ্টি বেড়েই চলল, হাটঁতে হাটঁতে পৌঁছে গেলাম ঝরণার পাশে। বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে ঝর্ণার অবিশ্রান্ত জলধারা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
চলবে..................................
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ২:১০