শিক্ষা মানুষের আচরনের কাঙ্খিত পরিবর্তন ঘটায়। কাঙ্খিত পরিবর্তন হলে তার মধ্যে ব্যাক্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে কথার সত্যতা, উদারতা, দেশপ্রেম ন্যায় বিচার, বিনয়। যাবতীয় মানবীয় গুনাবলির পরিস্ফুরন ঘটবে তার মধ্যে।
মানুষ সাধারনত তিন ভাবে শিক্ষা গ্রহন করতে পারে। একটি হল পারিপার্শ্বিক শিক্ষা। যা অ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এ শিক্ষা ব্যাবস্থায় মানুষ তার মা-বাবা,ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশীর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহন করে।একটি বাড়ন্ত শিশু তার পারিপার্শ্বিক যে সব মানুষের সংস্পর্শে আসে তাদের চিন্তা-চেতনার একটি মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। শৈশব কাল থেকে একজন মানুষ যদি চারপাশে কতগুলো ভালো মানুষের সংস্পর্শে বড় হয় তাহলে তার মধ্যে কতগুলো ভালো গুনের সমাবেশ ঘটবে, এতে করে তার মধ্যে নৈতিক গুনের উন্মেষ ঘটবে। যে পরিবার এবং পরিবেশ থেকে সে বড় হয়ে আসে তার একটা প্রভাব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাই তার নৈতিক গুনাবলিতে মুখ্য ভুমিকা পালন করে থাকে যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পরে।
আর এক ধরনের শিক্ষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এ শিক্ষার মাধমে প্রধানত বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের সমাবেশ ঘটে। অবশ্য উন্নত নৈতিকতা সমৃদ্ধ শিক্ষকের ভালো উপদেশের মাধমে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা নৈতিকতার উন্মেষ ঘটে যা বাস্তব জীবনে তার মধ্যে কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার মাধমে মানুষ দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দেশের জন্য কিছু করার যোগ্য হয়ে উঠে। কিন্তু নীতি বর্জিত দক্ষ লোক থেকে সমাজ উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বেশি পেয়ে থাকে।
পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার মাধমে শিক্ষার্থীরা আর এক ধরনের শিক্ষা লাভ করে থাকে। এটাও এক ধরনের অ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এক্ষেত্রে লেখক তার বইটি যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন তার একটি প্রতিক্রিয়াও পাঠকের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। এটাও নৈতিক শিক্ষারই একটি প্রক্রিয়া। উন্নত নৈতিকতার আলোকে লিখা বই পড়ার মাধ্যমে পাঠকের মধ্যে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। অপর পক্ষে নীতি বর্জিত লেখকের বই পড়লে পাঠকের মধ্যে নৈতিকতার অবক্ষয় হতে পারে। তাই বই নির্বাচনও শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তাই আমরা দুটো শিক্ষার কথা বলতে পারি। একটি হলো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা আর একটি হল নৈতিক শিক্ষা। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যাতিত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিয়ে যেমন সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয় তেমনি নৈতিক শিক্ষা ব্যাতিত শুধু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে সমাজের কোন কল্যাণই সাধিত হয়না। আজকাল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ধারনা হচ্ছে দক্ষতার অভাবে অর্থাৎ দক্ষ জনশক্তির অভাবে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আমি বলব নীতি বর্জিত বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার শিক্ষিত দক্ষ জনগণই জাতিকে দ্রুত ধংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে এ ধরনের নীতি জ্ঞানহীন শিক্ষিত লোকই জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে।আর সে জন্য পত্রিকা খুললেই দেখা যায় নীতি বর্জিত অথচ দক্ষ আমলা,রাজনীতিবিদরা হাওরের বাঁধ নির্মাণের টাকা, বাজেটের বরাদ্দ,বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকার ঋণ, সাহায্য নিজেরাই লুটেপুটে খাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্তে নিয়জিত মন্ত্রীরা সরকারী আমলারা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই বিভিন্ন খাতে ভাউছার বানিয়ে সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করছে। স্বজনপ্রীতির কারনে সরকারের উচ্চপদস্থ পদে নীতি বর্জিত অদক্ষ লোক নিয়োগ পাচ্ছে, বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠান গুলিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি আর অসচ্ছতায় সয়লাব হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের সেবার নামে চলছে হয়রানি। দক্ষ ডাক্তার সময়মত হাসপাতালে যাচ্ছেন না।মুমুর্স রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত মুনাফার জন্য অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়া হচ্ছে। এতে করে রোগীর সময় শ্রম ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। দক্ষ প্রকৌশলীরা দক্ষতার সাথে ঠিকাদার নিয়োগ করছে। নিম্ন মানের রাস্তা-ব্রিজ নির্মাণ করছে।বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগ পকেটস্থ করে জাতীয় সম্পদের অপচয় করছে, মানুষের জীবন হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সময়মত অফিসে না আসার কারনে সাধারন মানুষের শ্রম সময় অর্থের অপচয় হচ্ছে। আবার সেবার বিনিময়ে অফিসের আমলারা উৎকোচ গ্রহন করছে। এসব সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী আমলারা দক্ষ কিন্তু অসৎ,নীতি জ্ঞান বিবর্জিত।আমরা এটাকে কখনো জাতীয় উন্নয়ন বলতে পারিনা। ব্যাংক,বিদ্যুৎ,বিমান,রেলওয়ে সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সরকারকে বছরে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্র গুলির দায়িত্তে নিয়জিত ব্যাক্তিদের আমরা অদক্ষ বলতে পারিনা। কারন অদক্ষ লোকের দ্বারা সরকারী অর্থ দক্ষতার সাথে আত্মসাৎ করা সম্ভব হতনা। নৈতিক শিক্ষার অভাবেই এসব দক্ষ লোক সমাজ এবং জাতির জন্য কিছু করতে পারছে না। মামলার জন্য থানায় পুলিশের সরনাপন্ন হলেই মিথ্যা দিয়ে মামলা শুরু আর অর্থের লেনদেন ছাড়া মামলা সামনে আগায় না। এতে করে সামাজিক ভাবে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অবৈধ অর্থের যোগান দেয়ার জন্য অন্য একটা অবৈধ অর্থ পাওয়ার খাত সৃষ্টি করতে হচ্ছে। ফলে অবৈধ অর্থ পাওয়া এবং দেয়ার একটা চক্র সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারন মানুষের ধারনা যেন পুলিশ মানেই হয়রানি। অথচ হওয়ার কথা ছিল পুলিশ মানে আশ্রয়স্থল। যে যুব সমাজ জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হবে সে যুব সমাজে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে।বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতির সয়লাব। ঘরে ঘরে দেশী বিদেশী চ্যানেলে বিনোদনের নামে দেখতে হচ্ছে নগ্ন অর্ধনগ্ন ছবি, হাতে হাতে মোবাইলে অনুল্লেখ যোগ্য নোংরা ছবির বিস্তার দিন হতে দিন সহজের চেয়ে সহজলভ্য হচ্ছে। এসব বেহায়াপনার ফলে যুব সমাজের চারিত্রিক অবক্ষয় প্রকট আকার ধারন করেছে। পরিণতিতে একা অথবা দলবেঁধে মাদক গ্রহন, জুয়া ছিনতাই, নারী নির্যাতন সহ যাবতীয় অশালীন কার্যকলাপে সমাজ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। যার খেসারত জাতি কে দিতে হবে। আর সামনে আরও ভয়াবহ সময় আসছে। এসব অপসংস্কৃতির যারা অনুমদন দিচ্ছে এবং যারা এসব অপসংস্কৃতির উন্নয়নে জড়িত তারাও নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ। কিন্তু তাদের এ দক্ষতা যুব সমাজকে ধংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অসৎ দক্ষ ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের জন্য খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করছে। খাদ্য দ্রব্যে পচনরোধে এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নানা ধরনের বিসাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত করছে মজুতদারী, কালোবাজারি, চাঁদাবাজি এসব কিছুই করে থাকে সমাজের নামি দামী দক্ষ নৈতিক শিক্ষাহীন লোকগুলো।
আমাদের বুঝতে হবে Education with moral quality is the backbone of nation. জাতির অগ্রগতির জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য একথা কোন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ অস্বীকার করতে পারেনা। নৈতিক শিক্ষা ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার সমন্বয়ে একটি জনগোষ্ঠী তৈরির ধারা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। পাশাপাশি সমাজকে সেই আঙ্গিকে সাজাতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ প্রাইমারী থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা অর্জিত জ্ঞান ও অনুধাবন কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারে কিনা এবং বিচার বিশ্লেষণ করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা তা মূল্যায়নের ব্যাবস্থা করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষতা মূল্যায়নের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা মূল্যায়নের ব্যাবস্থা করতে হবে। স্বজন প্রীতি ও অর্থের লেনদেন বন্ধে সরকারের শক্ত ভুমিকা থাকতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি অপরাধ মুক্ত বিশ্ব উপহার দেয়ার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতে হবে। যিনি বিশ্ব ভ্রমান্ড কে তৈরি করেছেন, পরিচালনা করছেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন মানুষ কীভাবে জীবন যাপন করলে সুন্দর এ পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সঃ)এর মাধ্যমে সে পন্থা জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর নির্ধারিত নীতি অনুসরন করে চলতে পারলেই আমরা কেবল শুখময় এক পৃথিবী আশা করতে পারি। এ পরম সত্যটি যত দ্রুত আমরা উপলব্দি করতে পারব ততই শুভ।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর রাসুল(সঃ)এর আদর্শ বাস্তবায়ন করাই নৈতিক শিক্ষা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৭ ভোর ৪:০০