“একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না” কথাটির তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু অবগত। একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হল নাগরিকদের যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করা কিন্তু আমরা তা কতটুকু পালন করতে পেরেছি। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয় না, সাথে তার পরিবারকে ঠেলে দেয় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। একজন বাবা মা হারায় তাদের সন্তানকে, যে কিনা ছিল তাদের একমাত্র ভরসা, স্ত্রী হারায় তার স্বামীকে, ছেলে মেয়েরা হারায় তাদের বাবাকে, কেন এই শোক নিয়ে একটি পরিবার সমাজে টিকে থাকবে? আমাদের দায়িত্ববোধের কি এতই অভাব যে আমরা এই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিহত করতে পারব না এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারব না।
আমরা সড়ক দুর্ঘটনার কারনে হারিয়েছি মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মতো শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, তাঁদের এই অসময়ে বিদায় পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সবাই স্বেচ্ছার হয়ে উঠেছিল এই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কিন্তু তার কোন আশানুরূপ ফল আমরা পাইনি। জীবনের তাগিদে যে মানুষটি বাসা থেকে বের হয় কাজের সন্ধানে, সে কি আবার ফিরবে তার বাসায় এটাই এখন চিন্তার বিষয়। কিছু বেপরোয়া গাড়ি চালকের জন্য আজ আমাদের জীবন হুমকির সম্মুখীন। সমাজের উচুস্তরের লোকদের মৃত্যু নিয়ে আমরা অনেক শোক প্রকাশ করি কিন্তু প্রতিদিন যে কত লোক এই সড়ক দুর্ঘটনার করাল গ্রাসে মৃত্যুবরণ করছে তাঁদের জন্য কি আমরা এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করি। পত্র পত্রিকায় দুর্ঘটনার কত ফিচার দেয়া হয় যেখানে অনেকের নাম ও পরিচয় অজানা থেকে যায় তাছাড়া তাঁদের পরিবার চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে থাকে এই ভেবে যে তাঁদের প্রিয়জন একদিন ফিরে আসবে। আমার প্রশ্ন হল, তাদের ভাগ্যে কি অস্বাভাবিক মৃত্যুই লেখা ছিল? যা লিখে দিয়েছে আমাদের সমাজের কিছু নরপশু তাছাড়া এই অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিরোধে আমাদের কি কিছুই করনীয় নেই।
অশিক্ষা, অজ্ঞতা, আমাদের সমাজের চিরচেনা একটি বিষয়, নিম্নশ্রেণীর মানুষের মধ্যে এর প্রভাব বেশী লক্ষণীয়। একজন চালক সহজেই একটি যানবাহন চালাতে পারে তাই বলে কি তার শিক্ষার প্রয়োজন নেই, তাছাড়া যানবাহন চালানোর নূন্যতম যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা নিয়ে প্রতিটি চালকই উদাসীন। রাস্তায় বিভিন্ন দিক নির্দেশক চিহ্ন সে কিভাবে বুঝবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া, শুধু তাই নয় কথায় আছে “ Right Person for the Right Place” এক্ষেত্রে একজন চালকের সহকারী কিভাবে যানবাহন চালাতে পারে যা আমাদের দেশে একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। কথায় আছে “অপরাধ যে করে, আর অপরাধ যে সহে দুজনই সমান অপরাধী” আমাদের দেশের কিছু হৃদয়বান মন্ত্রি সেইসব নরপশুদের প্রতি সমর্থন করছেন যারা হত্যাকারী, যাদের অদক্ষতার কারনেই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের বক্তব্য এতই শ্রুতিমধুর যে শুনে আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। উনাদের মধ্যে একজনের বক্তব্য এরূপ ছিল যে, “গরু, ছাগল, মানুষ চিনলেই একজন চালককে লাইসেন্স দিয়ে দেয়া উচিত” কিভাবে এতো উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এধরনের মন্তব্য করতে পারেন, আমি তাদের যোগ্যতা নিয়ে সত্যিই সন্ধিহান, আবার তারাই আমাদের দেশ পরিচালনা করেন। দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ দেয়া হয় কিন্তু দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার জন্য এর সিংহভাগই জনগনের কল্যাণে ব্যয় হয় না, কিছু দিন আগেও রাস্তাঘাটের খারাপ অবস্থার কারনে যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম অবনতি হয়েছিল এবং অনেক জায়গায় দুর্ঘটনার জন্য রাস্তার এই বেহাল দশা দায়ী ছিল কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও একজন মন্ত্রিকে বলতে শুনেছি “দেশের রাস্তাঘাটতো অনেক ভালই আছে পত্রপত্রিকার খবর সব ভুয়া” একজন পাগল যদি এই কথা বলত তাহলে তা মানা যেত, কিন্তু একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রি যদি এই কথা বলে তা হলে তাকে পাগলের সমতুল্য করার মধ্যে আমি কোন ভুল খুঁজে পাই না। যাই হোক অনেক বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়ে অবশেষে উনি পদত্যাগ করেছেন কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। এইসব লোকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারানোর যে কি বেদনা তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া আর কেউ বোঝে না। তাছাড়া যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই সব নরপশুদের আপনারা সমর্থন করছেন, এতে করে আপনারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন শুধু তাই না সমগ্র জাতির নিকট আপনারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
বর্তমানে “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, তারানা হালিম সহ আরও অনেকে, তাঁদের একটাই দাবি সড়ক পথের নিরাপত্তা কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে আন্দোলন বেগবান করতে সরকারের কোন হস্তক্ষেপ নেই। এটাতো কোন রাজনৈতিক ইস্যু না, জাতীয় স্বার্থে কি কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা যায় না। “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন তাহলে এই অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সড়কে নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, জনগণকে এই নিরাপত্তার গুরুত্ব অবহিত করতে হবে যাতে তাঁদের সামান্য ভুলের কারনে জীবন প্রদীপটা নিভে না যায়। আর যানবাহন চালকদের সচেতনতার পাশাপাশি উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করতে হবে তাছাড়া দ্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার পূর্বে তার দক্ষতা যাচাই করতে হবে। চালকদের দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি, প্রতিটি জীবনের মূল্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে তাছাড়া রাস্তায় গাড়ী চালানোর অযাচিত প্রতিযোগিতা পরিহার করতে হবে, ওভারটেকিং করার প্রবনতা হ্রাস করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সড়ক দুর্ঘটনার সর্বচ্চো শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এটি কার্যকর করতে হবে এবং কোন অপরাধী যেন অপরাধ করেও পার না পায় সে ব্যাপারে প্রশাসনকে সজাগ ভুমিকা পালন করতে হবে তাহলে এই অস্বাভাবিক মৃত্যু অনেকাংশেই হ্রাস পাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, একটি মানুষ অনেক আশা নিয়ে বাঁচতে চায়, সেই আশার মধ্যে অনেকের জীবনের আশা, আকাঙ্খা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত। তাই এই আশার অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন না হয় সেই কামনাই করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:৩৫