‘হে লিটারারি ফেস্টিভাল’ নাম পরিবর্তন করে এ বছর ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ নামে উদ্যাপিত হয়ে গেল। বরাবরের মত এবারও উৎসব প্রাঙ্গণ হিসাবে বাংলা একাডেমিকে বেছে নেয়া হয়। শুরু থেকেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে লেখক মহলে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ বছর বিরুদ্ধবাদিদের প্রতিবাদের তোড় কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। যে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল সকরারি শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে নামতে পারে না, সে দেশে নিম্নবর্গীয় লেখককুল কিভাবে উচ্চবর্গীয় স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ দীর্ঘদিন জারি রাখে। এর আগে অনেক সিনিয়র লেখকদের সঙ্গে ‘হে’ উৎসবের প্রতিবাদে আমিও রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম; প্রতিবাদি সিনিয়র লেখকদের অনেকইে ইতোমধ্যেই উৎসব কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন; আবার তাদের অনেকেই বলছেন, এই নাম পরিবর্তনের মধ্যে তাদের একটি বিজয়ও হয়েছে; তাদের আন্দোলনের ফলে উৎসব কমিটি নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে; এবার ঢাকাকে যুক্ত করার ফলে কিছুটা জাতীয়তাবাদি চরিত্র ধারণ করেছে। অবশ্য প্রতিবাদের দুটি ফল হাতেনাতে পাওয়া গেছে, একটি নামের মাধ্যমে কামকে আড়াল করা; অন্যটি প্রতিক্রিয়াশীল মতটিও ক্রিয়াশীল মতের সঙ্গে আত্মীকৃত হওয়া। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমাকে আমন্ত্রণ জানালে কিংবা কোনো পেপারর্স উপস্থাপন করতে বললে, আমি কি তা প্রত্যাখ্যান করতাম? অবশ্যই না; কিন্তু আমার কিংবা অন্য কোনো মহারথী লেখকের অবস্থান পরিবর্তনের মানে এই নয় যে, এই উৎসবের বিরোধিতার আর কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা নিজের অবস্থান থেকে একটি উচ্চতর অবস্থানে নিজেকে উন্নীত করা; এ ক্ষেত্রে ইংরেজির মত একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে পরিচিত হওয়ার ধারণা তাকে বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষাম-ল থেকে মুক্তি দিচ্ছে বলে মানসিক পরিতৃপ্তি লাভ করা; কিন্তু এই বোধের অংশভাগীরা একটি উচ্চতর সংখ্যালঘু শ্রেণী হলেও প্রভাবশালী ও আধিপত্যবাদি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, এই অংশটি দ্বারা সর্বদা সংখ্যাগুরু ভাষাভাষীর দুর্বল লেখককুল পর্যুদস্ত হয়ে থাকেন।
প্রথম থেকে যে সব কারণে এই উৎসবের বিরোধিতা করা হয়েছিল, তার একটি, আয়োজকরা বাঙালির আবেগ ও মননের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিকে তাদের সহযোগী হিসাবে পেয়েছিল; যার ফলে একটি আন্তর্জাতিক বই ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সঙ্গে কেবল বাংলাভাষীর আত্মত্যাগের ওপর গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির সম্পৃক্ততা একটি প্রশ্ন হিসাবে দেখা দেয়; এটি বাংলা একাডেমির কাজ নয় বলেও অনেকে মনে করেন। বাংলা একাডেমি অবশ্য বলতে চেষ্টা করেছে, তারা এই উৎসবের আয়োজক নন, আয়োজনকারীরা শুধু তাদের ভ্যেনু ব্যবহার করছে। অবশ্য আয়োজনের চরিত্র দেখে মোটেও তা মনে হয় না। একুশে বইমেলার পাশাপাশি বিগত পাঁচ বছর যাবৎ এটি একটি স্বাতন্ত্র্য রূপ নিয়ে বেড়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত এই উৎসবের আয়োজকরা মোটেও বাংলাভাষী লেখক নন; জন্মসূত্রে তারা বাঙালি হলেও তাদের ভাষা শিক্ষা শ্রেণী ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা; তারা হয়তো লেখক হিসাবে গুণি ও মহান, তাদের রচিত সাহিত্যের মূল্য হয়তো আন্তর্জাতিক মানের; কিন্তু আমার ভাষার দুর্বলতার কারণে এখনো তাদের কোনো রচনা আমার পক্ষে পাঠ করা সম্ভব হয়নি। লেখক হিসাবে ইংরেজি ভাষা কিংবা অন্যভাষার সাহিত্য জানার আকাক্সক্ষা থেকেই যায়, সে ক্ষেত্রে দুর্বল ইংরেজির ওপর ভর করে কিংবা অনুবাদের মাধ্যমে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোই রীতি। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বাঘা বাঘা রাইটারদের অল্প-বিস্তর জানতেই আমাদের কর্ম কাবার হয়ে যায়; বাঙালি জাতির ইংরেজি লেখকদের পড়ে ওঠা সহজ হয় না; অবশ্য এ প্রার্থনা থেকেই যায়, তারা যেন তাদের রপ্ত ভাষা ও প্রতিভায় ভর করে এমন সাহিত্য গড়ে তোলেন, বিশ্বসাহিত্য যার মূল্য বুঝবে।
আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, ২০১১ সালে আমার ইংল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, সেখান থেকে ম্যাঞ্চেস্টার বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, স্থানীয় সিটি হলে সাতদিনের একটি লিটারারি ফেস্টিভাল এবং সেই ফেস্টিভালে আমাদের মেয়ে তাহমিমা আনাম একটি সেমিনারে গেস্ট স্পিকার; এটি জেনে আমার ভালো লাগলো, পরিতৃপ্ত হলাম- ভাবলাম, ভাঙালি অতীশ পৌঁছালো কেমনে তুষার গিরিপথ। কিন্তু যখনই তাহমিমা আনামের কোনো রচনা পড়ার প্রশ্ন আসে, তখন আমি কোনোভাবেই তাকে বাঙালি লেখক হিসাবে মানতে পারি না। যদিও তারা একটি প্রচার প্রপাগা-া ও শ্রেণীগত সুবিধার কারণে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে বাঙালি অরিজিন হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছেন; তবু প্রকৃত বাঙালির লড়াইটি ভিন্ন। বাঙালি মুসলমানের শ্রেণী বিবেচনায় তাহমিমা আনামের অবস্থান অনেকটা রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য হলেও রবীন্দ্রনাথ আজীবন বাংলা ভাষা ও বাঙালির সুখদুঃখের ফেরিওয়ালা হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন; ফলে তার সকল শক্তি বাঙালিত্ব বিকাশে কাজে লেগেছিল; এবং সর্বদা তার প্রার্থনা ছিল, কবে আমাদের দেশে সেই মাটির কাছাকাছি যারা বাস করেন, তাদের কবির জন্ম হবে। অনেকেই বলেন, তাঁর প্রার্থিত কবির প্রকাশ ঘটেছিল কাজী নজরুল ইসলামের মধ্য দিয়ে।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আরো একজন কবির কথা বলা যায়, তার নাম কায়সার হক; যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক; শুনেছি ইতোমধ্যেই তার অনেকগুলো মৌলিক ও অনুবাদ বই বিদেশী নামী প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে; এমনকি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কবিতা পাঠ্যÑ এটি প্রকৃত অর্থেই আমাদের কাছে শ্লাঘা হওয়ার মতো খবর; কিন্তু যখনই বাঙালি লেখক প্রশ্নটি আসে তখন নিঃসন্দেহে তার অবস্থান ও আন্দোলনটি আর আমাদের কাছে ক্রিয়াশীল থাকে না; তখন বড়জোর শামসুর রাহমান বা জসীমউদ্দীনের কবিতার ট্র্যান্সলেটর হিসাবে দেখার মাধ্যমে তার মূল্য তৈরি হয়। এ কথা আমাদের না মেনে উপায় থাকে না, যার ভাষা বাংলা নয়, তিনি বাঙালি অরিজিন হলেও নিজে বাঙালি নন; কারণ বাঙালি ভাষাভিত্তিক জাতি।
তবে যে কোনো আয়োজনের নানা ইতিবাচক দিকও থাকে; এ আয়োজনেও তা থাকতে পারে; বিশেষ করে বাইরে থেকে যে সব লেখক আসেন তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়, তাদের প্রণোদিত হওয়ার ক্ষমতা হয়তো কোনো কোনো লেখককে হয়তো উৎসাহিত করে থাকতে পারে। কিন্তু এই আয়োজন তো সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষী লেখক; কিংবা ইংরেজিভাষী যে নতুন প্রজন্মের পাঠক তৈরি হচ্ছে তাদের কথা বিবেচনায় রেখে করা হচ্ছে; এবং সাহিত্যের একটি ডিগ্লোসিয়া তৈরি করা হচ্ছে; যারা একই দেশে বসবাস করেও কেবল ইংরেজি জানার ফলে বাংলাভাষী লেখক-পাঠকের ওপরে নিজেদের স্থান তুলে ধরতে সক্ষম হবে; যারা ইংরেজিতে বই পড়তে, লিখতে কিংবা অনুবাদ করতে অক্ষম হবে তাদের এই আয়োজনে নিমন্ত্রণ নেই।
এটি সত্য, সকল দেশে সকল কালে একটি সংখ্যালঘু উচ্চবিত্ত শ্রেণী নি¤œবর্গীয় সংখ্যাগুরুদের শাসন করে থাকেন; যদি বাঙলা ভাষার কথাও ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষাটি ভালো করে শেখাও সহজ নয়; অধিকাংশ মানুষ যেখানে সাক্ষরতার বাইরে, সেখানে বাংলা শিখে যে শ্রেণী সাহিত্য রচনা করেন, তারাও হয়তো মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে শ্রেণীটি মূলত বাংলাভাষী নি¤œবর্গদের সংযুক্ত করলেও শ্রেণী উত্তরণের আকাক্সক্ষা থেকে তাদের সাহিত্য ইংরেজি কিংবা বিদেশ গমনের স্বপ্ন দেখে। আমরা যদি একটি অসম প্রতি তুলনা দিই তাহলে মোটেও বেঠিক হবে না; বাঙালি যে ভাষাগত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ ধরে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তার মূলে ছিল উর্দু নামক একটি ভাষার কুলীনত্ব দাবি। তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে মাত্র ছয়ভাগ মানুষ এই ভাষায় কথা বলতেন; কিন্তু এই ভাষাভাষীরা ছিলেন উচ্চবিত্ত সেনাশ্রেণী; সাহিত্য ও ইসলাম ধর্মীয় ব্যাখ্যার বইপুস্তক রচনার মাধ্যমে অনেক উঁচুতে আসন নিয়েছিল; কিন্তু বাঙালি জাতি তাদের সে দাবিকে মেনে না নিয়ে নিজেদের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে রক্ষক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল। কারণ ওই ছয় ভাগ মানুষই ছিলেন, আমাদের দ-মু-ের অধিকর্তা; কারণ ভাষা ব্যবহারকারীর ক্ষমতাই মূলত শাসনের ক্ষমতা। যদিও আমার কথাটি শুনতে একটু বেখাপ্পা মনে হচ্ছে, তবু এটা মনে রাখতে হবে, এই ইংরেজি জানা শ্রেণীটি, যাদের সংখ্যা হয়তো এখনো ছয় ভাগ অর্জিত হয়নি, তারাই বাংলা একাডেমির মতো একটি অর্জনে ভাগ বসাতে যাচ্ছেন। আমি একটি সরল প্রশ্ন করতে পারি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা হিসাবে ইংরেজি ও উর্দু বিভাগের পার্থক্য কোথায়; দুটিই তো আমাদের পর ভাষা; দুটিতেই শিক্ষা গ্রহণ করা হয়; একটির বেশিরভাগটাই ধর্মীয় ও সাহিত্যের বিষয়াদি; অন্যটি সাহিত্য ও প্রায়োগিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে; যেহেতু চাকুরি-বাকুরি ব্যাবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা বেশি, তাই তার আধিপত্যর বেশি; কিন্তু এই ভাষার ব্যবহারকারীদের কর্তৃত্বশীলতা মেনে নিলে তা যে উর্দুর মতো গরীব সংখ্যাগুরুদের হটিয়ে দেবে না, তা কিন্তু বলা যায় না। যদিও এখনো এটি বিবেচনা করা হচ্ছে যে, এটি কেবলই বড়লোকের সন্তানদের একটি সাহিত্যিক ভেঞ্চার, তবু আমার কেন যেন মনে হয় এটি একটি বাণিজ্যিক ও আধিপত্যবাদি চেতনার প্রথম ধাপ; বাইবেল ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে যে অগ্রবতী সোলজার হিসাবে কাজ করে। অতীতে আমাদের মহান লেখকদের সাহিত্যকর্ম ইংরেজিতে হওয়া না হওয়ার ওপর তার লেখক জীবন নির্ভর করে নাই; বড়জোর ইংরেজি ভাষার প্রকাশকগণ হয়তো বাণিজ্যে কিছু কড়ি কম গুণতে পারে। এ মেলা সফলতার সঙ্গে ইংরেজি পত্রিকার পাঠক, বিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি শেখার প্রকল্পও শক্তিশালী হতে পারে।
ধরুন, যারা পাকিস্তান আমলে এ দেশের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাদের সন্তানেরা কিংবা নাতিপুতিরা আজ আর বাংলাভাষায় কথা বলেন না; এ ধরনের অনেক পরিবারকে আমি চিনি যাদের নাতিপুতিরা বাংলা বলতে পড়তে ও বুঝতে পারে না; এমনকি অনেকই দেশেও থাকে না; সুতরাং এ কথা তো ঠিক, তাদের জন্য বাংলাভাষার প্রয়োজনীয়তা আজ ফুরিয়ে গেছে; অবশ্য এটি কোনো দোষের নয়; কিন্তু বাংলা ভাষা ইতিহাসের কালে থেকে বিকশিত ও ছড়িয়ে পড়েছিল তার অন্তরালে ছিল তার মসনদের বাইরে নিজেকে সংগঠিত করার ক্ষমতা; তাই সংস্কৃতি ও উর্দু বলয় তাকে চূড়ান্তভাবে পদাবনত করতে পারেনি। কিন্তু দিন বদল হয়েছে, শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার ও অবজারভেটরি পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ও নির্মম হয়েছে। বিশ্বায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে সকল দেশজ মূল্যবোধের মূলে লেগেছে টান। ভার্চুয়াল দুনিয়ার কাছে বাস্তব জগত উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে; সকল যোগাযোগের সকল মাধ্যম নিজ ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি দখল করে নিচ্ছে। তখন তর্কের খাতিরে অস্বীকার করার উপায় থাকে না যে, বাঙালি কি সত্যিই তার নিজ দেশে পরভাষার কাছে পরাভূত হতে চলেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৩