গত দুই বছর যাবত আমার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নানাহ কারনে ওমরাহ পালনে যেতে পারছিলামনা। এছাড়া করোনার কারনেও ওমরাহ্ বন্ধ ছিল। বর্তমানে যারা টিকা নিয়েছে তারা Etmarna app থেকে পূর্ব অনুমতি নিয়ে মক্কায় যেতে পারছেন। আর বিনানুমতিতে গেলে দশহাজার রিয়াল জরিমানা গুনতে হবে।
আমাদের এলাকা থেকে পবিত্র মক্কার দুরত্ব প্রায় চৌদ্দশো কিমি। প্লেনে গেলে জেদ্দা নেমে টেক্সি বা বাসে মক্কা পৌছতে সময় নেবে ৩/৪ ঘণ্টা, আর বাসে প্রায় ১৫/১৬ ঘণ্টা। এখানে ওমরাহ্ সার্ভিসগুলি অত্যান্ত কম মুল্যে মার্সিডিস বাস যোগে সার্ভিস দিয়ে থাকে।আমি একটি ওমরাহ্ সার্ভিসেরই সাহায্য নিলাম। তারাই আমার এপ্স খুলে বুকিং দিল।
এপ্সে আমার ওমরাহ্র সময় নির্ধারিত করলো সকাল ৯-০০টা থেকে দুপুর ১২-০০ টা এবং একইদিনে পরবর্তি চার ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবো।
আল্লাহ্র রহমতে গড় পড়তায় দুই/তিন বছর অন্তর মক্কায় যাই। কিন্তু এমন সিডিউল করে আর কখনো যাইনি। করোনা পুর্ব এবং পরবর্তী ওমরাতে অনেক কিছুই পরিবর্তন এসেছে।পাঠকরের জ্ঞাতার্থে আজ সেটাই বলবো।
বুধবার বিকেলে যথারীতি গিয়ে দেখি আমাদের জন্য মার্সিডিস বাস দাড়িয়ে আছে, করোনার কারনে দুটোসিটে একজন বসে যাওয়ার ব্যবস্থা। গাড়ী ছুটে চললো মক্কার উদ্দ্যেশে। রাস্তায় নামাজের জন্য ২/৩ বার পেট্রোল পাম্পে দাঁড়ায়,এবারো থামলো। তবে এবার দেখলাম মসজিদ-টয়লেট অন্যান্যবারের চেয়ে বেশী পরিচ্ছন্ন, খাবার হোটেলও নিয়মতান্ত্রিক।
সাড়ারাত চলার পর ভোরে আমরা মিকাত তাইফে পৌছলাম। সেখানে আর আগের মতো জমজমাট মার্কেট নেই ৮/১০টা দোকানে ওমরাহ্র জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকেই ইহরাম বাধে নিলাম।
ইহরাম হল হজ্জ বা উমরার জন্য নির্ধারিত একটি ব্যবস্থা। মক্কার চতুর্দিক থেকে আগত হজ্জ্ব ও ওমরাহ্ পালনকারীদের জন্য মিকাত নামক নির্ধারিত আটটি স্থান(একটি প্লেনে) অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাধতে হয়। আমরা মিকাত তাইফে এসে করোনার কারনে সারি সারি গোসলখানার একটি খোলা একটি বন্ধ দেখতে পেলাম। হাজ্জ্বির সংখ্যা কম তাই আমাদের তেমন সময় লাগেনি। গোছল সেরে দুই রাকাত নামাজের সহিত ওমরার নিয়ত করে ফেললাম।
এরপর ৯৪কিমিঃ দূর মক্কার উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিলাম, মুখে আল্লাহহুম্মা লাব্বাইকা ওমরাতান তালবিয়াটি বলিতে হয়।অর্থ হচ্ছে,হে আল্লাহ! আমি ওমরার জন্য আপনার দরবারে হাজির হয়েছি।
বাস আমাদেরকে কাবা শরিফের নিকট গাজ্জ্বা এলাকায় নামিয়ে চলে গেল। এখানেই সেই জ্বিনের মসজিদ। করোনার কারনে এলাকাটা একদম ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছে।প্রায় সব হোটেলই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।থাকার জন্য মাত্র তিনটি হোটেল খোলা আছে।একটা হোটেলে লাগেজ রেখে ওমরাহ্র জন্য যাবো কিন্তু খাবারের রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। হোটেলের কর্মচারি আমাদের বললো তাদের নিকট গরুর মাংস আর রুটি আছে তবে নিজেদের রান্না করা। খিদের জন্য তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
সকাল ৯টার মধ্যেই আমরা কাবা শরীফের নিকট চলে এলাম। দুই দফায় লাইন ধরে মোবাইল এপ্স চালু করে নিরাপত্তাকর্মীদের গ্রিন পারমিট দেখাতে হলো।
১৫/১৬ বারের ওমরাহর অভিজ্ঞতায় এতো অল্প হাজ্জ্বিকে তাওয়াফ করতে দেখিনি, যা এবার নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। আমাদের গ্রুপ ৩ ঘন্টা সময়ে শেষ করার পর ২য় গ্রুপ তারা ভেতরে ঢুকতে দেবে এভাবে ৩য়, ৪র্থ। যাইহোক ধাক্কাধাক্কি ছাড়াই নিয়ন্ত্রিত দুরত্বে থেকে তাওয়াফ শুরু করলাম। হাজরে আসওয়াদের ধারে কাউকেই যেতে দেয়া হচ্ছেনা,তাওয়াফ শেষ করার পর মাকামে ইব্রাহিম বরাবর নামাজ পড়তেও দেয়া হচ্ছেনা, অনেকে নামাজ শুরু করলেও ভেঙে দিচ্ছে,তবে ছবি তুলতে দেয়া হচ্ছে। অনেকে ছবি তোলার সময় মুখের মাস্ক খুলে ছবি তুলতে গিয়ে ১০০০রিয়াল করে জরিমানাও গুনেছে।
আমরা ভেতরে চলে এসে পবিত্র কাবাকে সামনে রেখে নামাজ আদায় করলাম।
একসময় কাবা থেকে ২০/২৫ মিটার দূরে জমজমের কুপ খোলা ছিল।সেখান থেকে সরাসরি পানি পান করতাম,পরবর্তিতে কুপের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং চলার পথে ঠান্ডা জমজমের পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু এবার করোনার কারনে সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এবার জমজমের পানি নিয়ে মানুষ ও রোবট হাজ্জ্বিদের নিকটে এসে বিতরণ করছে। কিন্তু একটি বোতলে পানি ভর্তি করতে চাইলে তারা দিচ্ছেনা।
যাইহোক জমজমের পানি পেটভরে খেয়ে আমরা সাফা মারওয়াতে সাঈ করতে যাই। সেখানে এখন একটিমাত্র ফ্লোরে সাঈ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে,তবুও ভিড় নেই। সাঈ শেষে আবারো কিছুক্ষণ নামাজ ও দোয়া দরূদ পড়তে পড়তেই যোহরের আযান শোনা গেল।
আমাদের ওমরাহ্ এভাবেই শেষ করলাম। আরেকটা কথা আগে যতোবার খুশী তওয়াফ করার সুযোগ ছিল, এবার কাবা এলাকায় ২য় বার যাওয়ার কোন রাস্তা বা সুযোগ পেলামনা। ইচ্ছে ছিল যোহরের নামাজের পর আরেকবার তাওয়াফ করবো, ইউটার্ন করার রাস্তাই খুঁজে পেলামনা।
পাদটিকা, যা অনেকেই জানেন আবার নাও জানতে পারেন।
তাওয়াফ শব্দের অর্থ হলো প্রদক্ষিণ করা বা চক্কর দেয়া। বাইতুল্লাহ শরীফের চর্তুদিকে তাওয়াফ করা হলো হজ এবং ওমরার জন্য ফরজ রুকন যা পালন করতে হয়।
হজ্জ ও উমরার সময় মুসলিমরা কাবার চারপাশে ঘড়ির কাটার বিপরীতদিকে সাতবার প্রদক্ষিন করে যা তাওয়াফ নামে পরিচিত। তাওয়াফ শুরুর পূর্বে হজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া নিয়ম। তবে ভিড়ের কারণে এর কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর হলো প্রাচীন পাথর যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার উঁচুতে অবস্থিত।এই পাথর আদম ও হাওয়ার সময় বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসে পড়ে, সেই সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে।
মাকামে ইব্রাহিম হচ্ছে একটি পাথর যেখানে হযরত ইব্রাহিম (আ) দাঁড়িয়ে কাবা শরিফ নির্মাণ করেছিলেন। এটি কাবা শরিফের পাশে একটি ক্রিস্টালের বাক্সে রাখা আছে। পাথরটিতে হযরত ইব্রাহিম (আ) এর পদচিহ্ন এখনো রয়েছে যাহা চার হাজারেরও বেশি সময় ধরে অপরিবর্তিত এবং কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত অপরিবর্তিতই থাকবে, ছুবাহানাআল্লাহ।
জমজম কুপ ও সাফা মারওয়া সাঈঃ জমজম কুয়া মক্কায় মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত।এটি কাবা থেকে ২০ মি পূর্বে অবস্থিত। নবী ইবরাহিম (আ) এর স্ত্রী হাজেরা (আ) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) কে আল্লাহর আদেশে মক্কার মরুভূমিতে রেখে আসেন। তার রেখে যাওয়া খাদ্য পানীয় শেষ হয়ে গেলে হাজেরা (আ) পানির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার ছোটাছুটি করেছিলেন। এসময় জিবরাঈল (আ) এর পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বেরিয়ে আসে। ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে হাজেরা (আ) পাথর দিয়ে পানির ধারা আবদ্ধ করলে তা কুপের রূপ নেয়। এসময় হাজেরা (আ) উদগত পানির ধারাকে জমজম (বাংলায় থামো) বলায় এর নাম জমজম হয়েছে।
( চলবে )