জলকথা: পর্ব এক
মৌসুমী কাদের
১ শরীরের শিরায় শিরায় ধুলিকনা মিশে আছে। কোথাও কোন শুদ্ধ রক্তপাত নেই। যদি দাহ করো, এখনই করো…ব্যাথা-বিষ নির্লুপ্ত হয়ে জন্ম হোক আরেক মানুষের…
২ মদ্যপ বীজ বুনেছিলাম উঠোনে, এখন সেখানে লাগামহীন উদ্ধত মাতাল গাছ। ধুলোভরা ঘরে কেন আর থাকবো? উঠোনে যাবো, উঠোনে যাবো…হে মাতাল গাছ, আমি তোমার চূড়ায় চড়বো, ভুলে যাবো কাল-মহাকালের ব্যাথা……
৩ ইভেরা নদীর উপর থমকে দাঁড়ালো চাঁদ । আমাজানের গায়ে রঙ নেই, ফুল নেই, বৃক্ষ নেই, কেবলি নেই নেই নেই……গুটিকতক পথভোলা সন্যাসি পাখি। তুমি বোলনা যেন ওরা দুঃক্ষবিলাসী অথবা ওদের সাহস নেই…আসলে কি চাঁদ? তোমাকে নেবার ইচ্ছেটাই ওদের নেই……
৪ সুড়ঙ্গপথের সরু বাঁকা ট্রেনলাইন আকঁড়ে ধরেছিল আজ। একেবারে শেষ বগিটার কাঁচ দরজা ঘেষে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তোমাকে। ট্রেন যত যায় ততই তোমাকে দেখি। মনে হয় একই ট্রেনে হয়ত তুমিও অপেক্ষা কোরছো। যেখানেই গন্তব্য হোকনা আমার, তুমি আছোই।
৫ কতদিন কথা হয়না। অথচ কত লক্ষ লক্ষ কথা ছিল তোমার আর আমার। কথাগুলো ফুটন্ত খই হয়ে ঠোঁটের ভেতর জড়িয়ে হাসতো, আমি তা-ই চেটেপুটে খেতাম। যেন কোন বুভুক্ষ শিশু আমি। সেই ঠোট কি তেমনি আছে? সেই খই?
৬ সুরগুলো কত সহজে পেট-বুক-গলা ভেদ করে আড়ম্বর ভাব জমিয়েছিল কন্ঠের সাথে, মোমের মতন গলে পড়েছিল গান আর গান… ঠোটের ভেতরে গান, দাঁতের ফাকে গান, গহ্বরে… আরো গহ্বরে…তালুর সংগমে গান, ঐসবই ছিল অজানা আন্দোলন…বিস্ময়!! এখন এসব একটা গোটা অভিমান, গোপন ভয়, তার ছিড়ে রক্তধারা প্রবাহিত হবার ভয়…। ভীতু আমি, বিবস্ত্রচিত্তে ভাবছি বসে তাই…
৭ আমার বাপ-দাদার ভুতের ভয় ছিল, ইদানিং আমাকেও তা ধরেছে। গিরগিটি রঙ চুলের ভুতটা আমায় সারাক্ষন পাহাড়া দিচ্ছে, যদি একটা ভুলের জন্ম দিই তাহলেই… খপ করে সে তা ধরে ফেলবে তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে তার মাথামুন্ডু খাবে……
৮ এই পৃথিবীর সব জল সে আমাকে দিয়ে ফেলেছে, প্রতিদানে তাকে দিয়েছি একটি ভেলা, ভাসুক সে, ভাসুক…দেখি তার জলের খেলা……!!
৯ এখানে শীতের মহরা শুরু হয়ে গ্যাছে। লালপাতার বিলাসী মেপল গাছগুলো ক্রমশ ঝরে যেতে শুরু করেছে। বৃক্ষের অবধারিত শামুক জীবন এখন আমাকে মেনে নিতে হবে।আমি আমার সবুজ ঘোড়াটির মায়া ত্যাগ করে প্রতিদিন হাটবো ভিক্টোরিয়া সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভাববো সাধারন মানুষের ভীড়ে একটা গোপন রহস্য আছে। কেউ কাউকে চেনেনা, প্রশ্ন করেনা, অথচ পাশাপাশি হেটে যায় কত মানুষ!!!
১০ আমাদের বাড়ীতে একটা শিউলী গাছ ছিল। শীতের ভোরে জানালা খুললেই দেখতে পেতাম অসংখ্য ফুল ছড়িয়ে আছে মাটিতে। ফুল কুড়োবার মানুষ নেই। একটি দিনের বিবর্তনের পর আমি ওদের মৃত্যু দেখতাম আর ভাবতাম আর যেন নতুন ফুল না ফোটে, আর যেন নতুন ভোর না আসে। আমি চাইনি ঐরকম কোন সকাল আবার আসুক আমার জীবনে। যেখানে স্বপ্নের ডালপালাগুলো প্রচন্ড শীতে কুকরে যেতে যেতে একসময় তার মৃত্যু ঘটবে। অথচ আমি জানালা খুলই দেখতে পাবো তুমি ওপারে দাঁড়িয়ে আছো।
১১ একটা অদ্ভুত নাগরিক প্রেম তোমার আমার, যার কোন নাম নেই। সে শুধু ঘ্রান নেবে, একটুও ছুঁবে না। হা শরীর……!!…এইযে ক্রমাগত নেমে যাওয়া, প্রস্ফুটিত হওয়া প্রগাড় স্পর্শের আড়ালে, কি নাম দেবে তার? বিস্ময় না প্রেম? না লোভ? আবিস্কারের আনন্দ মানুষকে লোভী করে বই কি, তাই সে ভুলে যায় অশরীরি আনন্দকে……
১২ কাকে বলে মুক্তি? কাকে বলে পাপ? কাকে বলে দুর্বোদ্ধ সময়? অজানা রহস্য সব, চলো ফিরে যাই পলাতক শৈশব, দোলনায় দুলি হা-দূর্লভ।চলো ঘাসফুল তোমাকে বৃক্ষ বানাই, ঠুনকো বালির ঘর ভেঙ্গে ফেলে শুয়ে পড়ি মাটির বিছানায়……
১৩ প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলছে। কখনও তুষার, কখনও মেঘ ও রোদের খেলা, কখনও বৃষ্টি। তার আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই আর। দুজনে মিলে ঢুকে গেলাম এক গভীর ও গোপন অন্দরমহলে। যেন কেউ দেখতে না পায় রহস্যময় এই খেলা। যেন কেঊ বুঝতে না পারে, আদি আনন্দের পরিভাষা। কেবল আমি এবং আমার প্রকৃতি। তুমি আমায় বুঝতে পারোনি, তাতে কি হয়েছে, দুনিয়ার আর সকল মানুষ আমায় বুঝতে পারেনি, কেনই বা তাতে দুঃখ বহন? আমি আমার সমস্ত কষ্ট ঝাপ খুলে দিয়ে দেবো তার কাছে, যদি সে তা বইতে না পারে…।।প্রগাঢ় বৃষ্টির অবিরাম ধারায় সে তা ছড়িয়ে দেবে আমাজান জঙ্গলে।
১৪ সে দরজার বাইরে অনেকক্ষন, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তার নিশ্বাস পতন, সমস্ত পৃথিবী পেছনে ফেলে নির্বাসিত দাঁড়িয়ে সে, জানালা খুলেছি, এখনও খুলিনি দরজা, ভয় হচ্ছে, যদি খুলি…সে কি ভেতরে প্রবেশ করবে?
১৫ আজ আমার কষ্টগুলো বেমালুম পাখা মেলে বাতাসে উড়ে গেছে। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছিনা, বুকের ভেতর যে সরু কষ্টের চিন চিন ব্যাথা, একফোটা নেই। এর মানে কি আমি সব ভুলে যাচ্ছি?
১৬ তার জন্য আমার সব প্রতিক্ষা শেষ, এখন আমি নির্বাক সমন্বিত অন্ধকারের হাত ধরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এবার আমার অপেক্ষার পালা শুরু। শীতটা বড্ড ভয়ংকর। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়, সুর্যের দেখা মেলেনা।
১৭ একটি গান আমায় সারারাত জাগিয়ে রাখলো, গানতো নয়, বালিকা বাতাস; ঘুরে ফিরে…হাসে হাসে…ভাসে আর ভাসে…আবার ঢু……স করে ঢুকে পড়ে মাটিতে…
১৮ কি দারুন যুদ্ধ আমার, পাহাড়ের দেয়ালটা টপকে ফেলার!! চুড়ায় দাঁড়িয়ে যদি দেখি আকাশকে ছুঁতে ছুঁতে আমি তোমার ছুঁয়ে ফেলেছি, ওমনি তুমি অভিমানী নীলমেঘ উড়ে উড়ে হারিয়ে গেলে পৃথিবীর ওপ্রান্তে, কি হবে তখন? আর কি ফিরবো আমি, সবুজমাটির দেশে?
১৯ বিছানা, হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, ল্যাপটপ, দেয়ালে বন্ধুর আঁকা নীল-সমুদ্র, অজন্তা মূর্তি, সব এক এক করে বাক্সবন্দি হচ্ছে বাড়ী বদলের হামলায়। হু হু করে ছুটছি আমি ওদের পেছন। এ বাড়ীর স্মৃতি কি কেবলি ছিল প্রতারিত স্বপ্নবুনন? বুকের ভেতর ধারন করেও তবে তাই পেছনে ফেলে চলে যাওয়া??
২০ বাড়ীটা এখন টলটলে জলে ভাসছে, পুকুরপাড়ের সেই লিচুগাছটা আর নেই, বুভুক্ষপোকাদল চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে ওর শরীর। একটা চাপকল ছিলো উঠোনে, সেও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে অনেকদিন। বুকের ভেতর হু হু বাতাস, পুর্বপুরুষের অসহায়ত্ব, বিবর্নতা, বিলীনতা ………পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের দূরত্বেও ভুলতে দেয়না একের পর এক বদলে যাওয়া অস্তিত্ব।
২১ ইচ্ছে করে…ইচ্ছে করে, পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি পথে, কোনো অদৃশ্যদানব তুলে নিক আমায়……হা……, কতটা পথ...পাড়ি দিলে পৌছে যাবো তোমাতে? কতটা পথ অগ্রসর হলে বদলে যেতে বলবেনা অশান্তশালিক, শান্তনা দিয়ে গলে পড়বেনা নরম-চড়ুই? ঘুমফুল দোলনচাঁপা…শোনাবেনা ঘুমপাড়ানিয়া গান…?কতটা পথ?... হে অভিমানি শংখলতা, এসো, আর নির্বংশ কোরনা ঘাসফুল! যদি চাও মূলশুদ্ধ তুলে নাও…জন্মাতে হবেনা আর সবুজ গাছ…!
২২ দুপুরবেলা চারদিক ভাতঘুম উৎসব, জানালার গরাদ ঝুলে তোমার চিঠির প্রতিক্ষা…চিঠিটি এলো, তুমি আর এলেনা।
২৩ কাঁচা আলোয় চন্দ্রবিন্দু…?যদিও রোদ বলে সর্বনাশ…ভেবোনা কাঁচা বলে নেই কোন বেদনার আভাস…!
২৪ সর্বনাশ হাত ধরে তার বাড়ী নিয়ে গেল… মাটির বিছানায় বিছিয়ে দিল এক চিলতে রোদ। রোদ বললো, আয়…আয়…হাত-পা ছড়িয়ে আয়…দিশেহারা মন আয়, উদ্বাস্তু শরীর হলদে রোদে গলে গলে মিশে গেল…হায় বোকা বোকা কষ্ট, তোর আর বাড়ী ফেরা হোলনা… মোহবলে আক্রান্ত মানুষ তুই আজ…
২৫ সে…তো কাঠুরিয়া…কাটে মানুষ! হ্বৎপিন্ড থেতলে দেয়! কিসের আক্রোশ তার? কিসের শোক? চলো যাই ধামরাই…পড়ে থাকা চাষের জমি হাতরাই, অপরিপক্ক বালুভূমিতে গড়াই…বন্ধুত্বে আর না যাই……না যাই…
২৬ ঘুমিয়ে গেছে শহর, সাইকেল, জানালা, মেপল গাছ। ঘুমায়নি শুধু আটকে পড়া একটি মাছি। তারস্বরে ভন ভন করছে আর পরিহাসে মরছে, কেন যে তোমায় ফিরে ফিরে পাই…আমারি ইশ্বরে, সেইটি এখন গোপন ইতিহাস…
২৭ সুর্যের মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে, গগন ফাটিয়ে সে হাসছে আর হাসছে, এদিকে উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে, ক্ষেত-খামার ফসল……এতো রোদ এত উত্তাপ, তবু সে আর্ক্টিক শীতল সরোদ……
২৮ প্ররোচিত ও মোহগ্রস্থ মানুষের স্বপ্নবৃক্ষে ফুল ফল কিছুই ফুটলোনা……তাইসে ঝড়ের মধ্যে আটকে পড়ে ঝড়ের মতন উধাও!!! দুর্ভিক্ষের কাঁদাজলে বড় হবার চেয়ে মৃত্যু অনেক কাংখিত……
২৯ প্রতারিত স্বপ্নের ঘরে একগুচ্ছ বালিকা ঘাস । কে জানতো, ঘাস-ই ছিল তার পুরন সর্বনাশ……স্বপ্নেরা বলে, চলো নদীর কাছে যাই, কে জানতো সেও বড় অশান্ত………তার চেয়ে এই ভালো বেদনা পাহাড় নিয়ে ঘুমাই……
৩০ দরজী জামা কাটতে গিয়ে কেটেছে বারান্দা। চড়ুইয়ের বাসা ভেঙ্গে ছারখার! উঠোন জুড়ে সমবেত পাখিদল। দরজীর হাত কেটে নেয়াটাকি এতই সহজ?
৩১… বুড়ো তামাটে মেপলগাছ ও তার আইরিশ বন্ধুর নিমগ্ন জ়ীবনে এখনও একটি অবসন্ন বিকেল বাকি…কালো কফির ধোঁয়া উড়তে উড়তে ভুলে যায়…সমুদ্র বরাবর কেবলি হাঁটা …সেই তুমুলস্রোতে আছড়েপড়া তোলপাড় হ্বদয়…… নির্যাতিত যৌবনের চেয়ে সমাপ্ত অবসর অনেক ভালো……
৩২ …কখনও চুল বড় কোরনা…কখনও ফুটিওনা কামনার ফুল…যৌবন যতই অথৈ জলে ভাসুক…শৈশব হোক শোকগাঁথা…
৩৩…প্রলম্বিত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সে,…বয়স্ককাল তোমাকে ভয়, যে তীব্র জ্যোতিফুল ঝুলে পড়ে হয়েছে ভুল…আর কেন যাবে সে দূর্নামে…
৩৪…জমি বা জল নয়্…বিনিময় শব্দভাজে আছে শুধু নোনাবৃষ্টি কোলাহল…… সমতল অন্ধকারে হারিয়ে গ্যাছে সব দূর্বোদ্ধ গতকাল…
৩৫ হলদেটা উড়ে এসে বললো, সকল মুগ্ধগাছ পুড়ে গেছে। রোদ হাতে দাঁড়িয়ে আছে কেবল একটি প্রজাপতি বংশধর, সে আর হলদে হতে চায়না। মুগ্ধতা মরে যাবার ভয়ে এখন শুধুই অন্ধকার সকাল………।।
৩৬ বিদূৎ তার মত করে চমকে গেল অবিরাম…আমি দেখলাম বৃষ্টির দুঃক্ষমাখা জল… বেদনার বয়স বেড়েছে, তাইসে আওয়াজ দেয়না, কেবলি ক্ষতের সোয়েটার গায়ে দিয়ে ইস্টডেল এভূ্নূতে ঘুরে বেড়ায়…
৩৭ সর্বাংগ জুড়ে লতাপাতা ফুল, অন্ধকার বলে কোরনাগো ভুল… লতায়ও থাকতে পারে সাপ, ভুল হলে যদি বলে পাপ……এই ভালো ফুলগুলো খুলে ফেলো……
৩৮।…………কি করে সাফ করবো বালিখসা দেয়ালের ঝুল? কি করে পূরণ করবো অপরিসর এই জীবন! ……জীবনের গভীরতা শুন্যতাকেই যে শুধু বাড়িয়ে তোলে……
৩৯। …… ভুলগুলো আজকাল সব শ্বেতফুল…আলো আর আঁধারের ধোঁয়াটে বাগান……এখানে এখন রুপক তালে গান বেমানান…জ্যোতি’দাকে আমি কি উপহার দেবো?? ফুল?? না গান?......
৪০। ……বেচেঁ থাকার কি কারন আছে যে বেচেঁ থাকবো? মৃত্যরই বা কি কারন আছে যে মরে যাবো?এইসব জাগতিক এবং মহাজাগতিক লীলাখেলায় কারন এবং অকারনের উদ্বিগ্নতা গ্রাস করছে সময়……সকল অস্থিরতা উপচে পড়ছে মহাপ্রলয়ে……
৪১। …চারদিকে কত অচেনা মানুষ! চিনতেই হবে এমন কোন কারন আছেকি? চলোনা, অচেনা থাকি! অচেনার কাছেই আশ্রয় মেলে বেশী…অচেনা ফুল, অচেনা পাখি, অচেনা গাছ! যে পথিক হারিয়ে যায় তাকেতো অচেনা পথেই হাটতে হয়……।।
৪২। …চোখে এখন বাইফোকাল চশমা… দূরের এবং কাছের একত্রে দেখবার সখ্যতা নেই…দূর বলে, কাছে কেউ নেই, কাছ বলে দূরে কেউ নেই……!!! এ এক অভিমানী… স্বার্থপর খেলা…
৪৩। …… প্রিয় মানুষটি হাসপাতালের বিছানায়……বাঁচা-মরার যুদ্ধ করছে……আমিও কি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছি বারবার…? সাগর-মহাসাগরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে কত অতলান্ত স্মৃতির বেদনা বহন!! কষ্টের ভাগ মনে গাঁথে বেশী, কেউ ভাবেনা……কত সুখ, কত প্রেম, কত অদল-বদল, বিনিময় ও অস্থির সময় উল্লাসে কেটেছে! জীবনের যত রক্তপাত ও নষ্টশব্দ নিপাত যাক!! চলো ফিরিয়ে আনি সুর্যপাখি, সর্ষেফুল, । চলো ঘাসের পিঠে শুয়ে শুয়ে একটি অদৃশ্য কবিতা’র ঘোরে তার সুস্থতা কামনা করি……।।
৪৪। ……প্রাপ্ত, চাঁদকে খুন করে অনুতপ্ত নয়… কারন সে ধূলিতে শুয়ে ছিল বহুদিন…কোনদিন চাঁদ বলেনি ‘বোধীবৃক্ষের তলায় যেওনা, ওখানে বিষধর সাপ আছে’!! আজ যখন সে বিষজল নির্মল-মঙ্গল সুরায় ব্যাপ্ত ও অনুরক্ত, তখন চাঁদ বলছে, ‘কতদিন চলবে, তোমার এই বেলেল্লাপনা! তুমি কি জানো, তুমি কতটা অপ্রাপ্ত?’ কে চাঁদকে বোঝাবে, প্রাপ্ত আর অপ্রাপ্তের দ্বন্দ!
৪৫…ইশ্বরের সাথে তুলনা করেছিলাম তাকে…ওমনি একঝাক তেলাপোকা খামচে ধরলো শরীর……কি দুঃস্বাহস আমার!! দুপা বা চার পা’ কোনকিছুর সংগেই ইশ্বরের তুলনা চলেনা…কি করে ভুলে গেলাম আমি!!
৪৬। ……অনুতপ্ত আমি, তোমাকে অনেক জোড়ে ডাক দিয়ে……, এতই জোড়ে ডাক দিয়েছিলাম যে কন্ঠস্বর ছিড়ে রক্তে ভেসে গেল আমার … এতটুকু সাহস নেই আর…গান গাইবার…
৪৭। …সে আমার ছায়ায় ছিল…মায়ায় ছিল, সে আমার সুর্যোদয়ে ছিল…বোধোদয়ে ছিল…… যোগ্যতায়…ছিল যৌথতায় ছিল……প্রশ্ন কোরনা……কেনসে এতকিছু ছিল অথবা এইসব ছিল ছিল ছিল, কি ছিল শুধুই প্রহসন??
৪৮। ……ঘুমঘুম কালিগঞ্জ গ্রাম……বাঁশের ভাঙ্গা সাঁকো পেরিয়ে…ধানিজমি…কাঁদামাটির এটো জল……এবার বুঝি উৎসব শুরু হোল… এবার বুঝি ফিরে এলো হারানো শৈশব…, বাবাকে দেখবো বলে ঐ পথ ডাকছে……’আয় আয়……দেখে যা তোকে ছাড়া কতটা বেঁচে আমি’……
৪৯। … যদি এক আকাশ রোদও দাও আমি আর হাসবোনা…প্রতারক সূর্যকে ভুল করে আর ভালোবাসবোনা………ফিরে এসো……ফিরে এসো, হে উদাসী অহম, যে মন ডুবে গ্যাছে গভীর জলে, তাকে আর ফেরানো যাবেনা……
৫০।……যে কপালে কখনো ঘুমফুল ফুটতোনা…সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিঃশব্দ আন্দোলনে… উজান-ভূমি পার হয়ে…ছুটে আসা মাটি…জল দূরত্বে ফেলে…...অজানা পাড়ি দিয়েছে সে, …অচেনা…ঘাসে ভিজে আছে সে শৈশব আর পূর্বপুরুষের সাথে……।।
৫১। তোমার বাড়ীর দরজার পাশে বিশাল সেই আপেলগাছ…কাঁচা পাকা আপেল থরে থরে ঝুলে আছে, মাটিতেও গড়াগড়ি খাচ্ছে অগোছালো বন্য শিশুগাছ… অথচ আমি তোমার দরজায় অচেনা দাঁড়িয়ে আছি………।
৫২। যে সুতপা অস্তিত্বহীনতা, মন্দ-বিশ্বাস আর অপূর্ণতায় ভর করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, তার সঙ্গে আমার তফাত কি? আমি কি এমন কিছু পেয়েছি যার জন্য আমার বেঁচে থাকে খুব বেশী প্রয়োজন?
৫৩। আমার কাছে চেয়েছিলে বিশ্বাস……বিনিময়ে দিয়েছ অবিশ্বাস… এখন আমি ভুলে গেছি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিনিময় সূত্র… এখন আমি ভুলে গেছি…গুপ্তধনের আনন্দ………এখন আমি কাঁদা মাটি জলে মিশে একাকার.....গায়ে গতরে চাষী.... এখন আমি সবাইকে সব কথা বলি আর হাসি…………।
৫৪। এখানে সবকিছু বদলে যাচ্ছে……গাছের পাতা, উঠোন, আকাশের সীমানা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত……মলীন বিবর্ণ প্রকৃতি, হুরমুরে বাতাস… জানান দিচ্ছে……শীত আসছে…
৫৫। একটা অদৃশ্য কাগজের ছবি……ঘুটঘুটে অন্ধকার সাবওয়ে টানেল, ডনল্যান্ড ষ্টেশন, ধোঁয়াটে কফি………হাঁটাপথ…থমকে যাচ্ছে পা……এস্কেলেটর…টেনে নিয়ে যায়……বাইরে কনকনে বাতাস…ঘনীভূত সবুজ নুয়ে পড়া গাছ, আমাদের মধ্যে কে প্রতারক তা বোধহয় আমরা নিজেরাও জানিনা………।
৫৬। যেখানে ছিলাম, বিস্তৃত যৌবন আটকে ছিল…সব ফুল ফুটে ছিল সারারাত…।কখনোই তখন মারিয়া ক্রিস্টিনা খুলতে হয়নি……মাতাল করে রেখেছিল যাদুকর ফুল আর নিঃশব্দ প্রকৃতি…………গাছেরা ডেকে বলেছিল, এখানেই আছে শেষ নিঃশ্বাসের সরল গতিপথ, আমি বুঝিনি……।কিছুই বুঝিনি……এখন আমি যৌবন হতে বিতারিত পলাতক পৌঢ়…।
৫৭।….যখন আমরা কোন কিছু বুঝতে পারিনা, তখন আমরা ভুল ব্যাখ্যা করি…..যখন আমরা না বুঝেই ভালোবাসতে চাই, তখন অনিয়ন্ত্রিত আবেগ আমাদের নষ্ট করে………সেই তুমুল বুদবুদ আবেগ … নেশায় বুদ হয়েও মস্তিস্কের কোষগুলোর আন্দোলন থামাতে পারেনা………
৫৮।…..এখানে গ্রীস্ম শেষ হয়ে আসছে। তবু সকাল রোদের কোমল উত্তাপের লোভ প্রতিদিনের নামতা কাজের ব্যঘাত ঘটায়… রোদ চশমা ফেলে রেখে সবুজ গাড়ীর গতি বাড়িয়ে দেই, মনে হয় যে ভালবাসা চলে যায়, ঘন উজ্জ্বল রশ্মির মত, হয়ত একদিন এই গতি বাহন নিয়ে ক্রমশ আমি ধাবিত হবো সেই চূর্ণ বিচুর্ণের দিকে……..
৫৯। যে ছেলেটি রক্ত নিল সে ছিল বিষন্নখোর………তার সুঁইয়ের খোঁচা সে টের পায়না………অবলিলায় রক্তপাত ঘটায়………যার শরীর সেতো টের পায়……আজকের এই রক্তপাত জমাট কোন আন্দোলনে সাড়া দেয়না……
৬০। আমাকেই আমার আগুন বইতে হবে…আমাকেই পোড়াতে হবে যত পাপ…। উচ্চপদস্থ চন্দনকাঠ বা খাঁটি ঘি নেই……।পোড়া ঘ্রান যদি না সইতে পারো তবে……লোকালয়ে ফেলে চলে যেও………
৬১। যে শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি, সেইতো জীবন। তুমি না থাকলে এই শ্বাসটুকু নিতে ভুলে যেতাম……
৬২। তুমি বলেছো, ঘুম হয়না…।ঘুমকি মরিচিকা? জলে বালুঘর? বরফ মরুভূমি? এসো, সূর্য এবং তোমাকে একসঙ্গে ঘুমপাড়াই। কারন সূর্যতাপ আজকাল আমার একদম সহ্য হয়না।
৬৩। ………তুমি বা আমি কেউ একজন প্রতারক ছিলাম… তুমি বা আমি কেউ একজন খুব বেশী মিথ্যে বলেছিলাম, নইলে সবকিছু একসাথে এতটা মিথ্যে হোল কেন…
৬৪। ……অবধারিত এই নির্বাসনে যাযাবর সূর্যের প্রখর আলো মেঘ পোড়ায়, অন্ধকারে সে ঢলে পড়ে রক্তাক্ত আকাশে……তবুও কি তুমি ঘুমফুলে জল দেবেনা??
৬৫। …দুঃখ আজ চিন্তার চেয়েও বিলম্বিত ও গভীর, সরকারী শিক্ষানীতি, ভাবো, শেখোনা কিছুই……
৬৬। …এই সেই হতাশাগ্রস্ত মানুষ…যে তার চোয়ালের দীর্ঘ বারান্দা ধরে…লুকিয়ে থাকা কবিতার লাইন…এক এক করে মুক্ত করেছে…ভয়ংকর বনরাশি…।।১১/০৭/২০০৯
৬৭। …যতক্ষন শ্বাস আছে ছুঁবার চেষ্টা……কষ্ট দেবার এবং নেবার হাডুডু খেলা …তারপরই অমিমাংসিত ও নিস্তব্ধ গল্প……আকাশে হাত বাড়িয়ে পেতে চেয়েছিলাম অথচ মাটিতেই ছিলে…হে নিষ্ঠুর শোক, পাশ ফিরে শোও, আর যেন যাযাবর ডেকোনা… । ১১/০৯/২০০৯
৬৮। …ব্যবচ্ছেদের পর মৃত্যু হলে একটি শোক বই কোরো, আগুন দিয়ে লিখে দিও…সেকেন্ড হ্যান্ড প্রেম, বন্ধুত্ব, বিজ্ঞাপন, সবকিছুর বন্ধাত্ব হোল……১১/১০/২০০৯
৬৯। …শীত সর্বস্বসন্ধ্যা আজ টরন্টো শহর…ব্যাংকক রেষ্টুরেন্টে’র বুদ্ধমূর্তি স্তব্ধ…টেবিল ভরপুর বাদাম-সালাদ, চিংড়ী-সবজি-ভাত, মুরগী-কমলা-ঝোল আর কলার পিঠায়…মানুষেরা শীতে কাটে ভাত, ঘাসপোকা কেবলি কাটে বিষন্নতা…… ১১/১১/২০০৯
৭০। …এ-দুঃখ সাময়িক…এক মিনিট, এক ঘন্টা, এক দিন, একবছর…ক্রমশ তা হারিয়ে যাবে…বহিষ্কৃত হবে একটি প্রেমকাহিনী…১১/১২/২০০৯
৭১। সম্পর্কের নিলাম দিলাম, সস্তা-দামী এখন আমার উভয় সমান…১১/১৩/২০০৯
৭২। কি ছুঁবে তুমি আমার? হাত? গাল? ঠোট? দ্যাখো ছুঁয়ে, সবকিছু ধূধূ বালি বিপন্ন চরাচর, বলিরেখায় ঘুটে মাটি মৃতপ্রায় আয়ু……..মরা মাছের উৎসব…
৭৩। আমারই শূন্যতায় অভিসার সাজাশনা… দূরেই থাক আগুন ও আগন্তক, রোদচশমা পড়ে দেখি… নইলে যে পুড়ে যাবে সব, গাছের পাতা, ছাল, কাঠকয়লা ভবিষ্যত……১১/১৩/২০০৯
৭৪। হা…জীবন! হা যৌবন! হা…লোভাতুর মকর! অমিমাংসিত বন্ধন, সূত্রভার…… কোনটি পেরোই? কোনটি পুড়াই? লোকালয়ে আজ নিষিদ্ধশ্বাস ……চলো ঘুড্ডি বানাই, সূর্যকে চাই, জঙ্গলে যাই! চলো কষ্ট-জামা উত্তুরে বাই, চিনতে পারে মিহিগনিটাই……
৭৫। ...একটা ছোট্ট বাগান ছিল, বাগানে কোন ফুল ছিলোনা অথচ ফুলগাছ লাগানো হয়েছিল অনেকদিন……একটা পুকুর ছিল, অথচ সেই পুকুরে কোন মাছ ছিলনা…পোনারা কেবলি ভেসেছে আর হেসেছে…একসময় মরেও গ্যাছে…এইরকম সুচতুর দিনবদলের পালা চলছে, অন্ধকার সংশয় গ্রাস করছে, ঠিক তখুনি কাকলির গান শোনা...ওর চোখে কি গোলপাতার ঘর ছিল? ওর নাকের ছায়ার কি অবারিত মেঘ ছিল??…মায়াময় সমান্তরাল সেই গানের দিকে তাকিয়ে দেখি, সাদা গান হলুদ হয়ে গ্যাছে……অবারিত মেঘে ছেয়ে গ্যাছে গোলপাতার ঘর…এখন আমি চাইলেই সেই ঘরে আশ্রয় নিই…মেঘ রোদ বৃষ্টি কিছুই মানিনা………
৭৬। তোমারই হাতে গভীরজলে একদিন সেই পৌরানিক নৌকা ঘুমিয়ে পড়েছিল…সেইঘুম যখনি ভাঙ্গতো, উত্তালসমুদ্র আর ঝুমবাতাস দুমড়ে মুচড়ে দিত তাকে… ঘুমহীন সেই হাত শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল আকাশ আর সমুদ্র। এখন চারদিক শুনশান, উজান-ভাটার দাদরা দোলায় মুয়ূরপংখী অপেক্ষমান………
৭৭। ……ভুলে গেছি, কাগজের লেখা, ‘কল্যানী, তুমি ভালো আছো?’ অথবা, ‘ইতি, তোমার হলুদ পাখি’; এ ক্যামন দিন বদলের পালা? হে আমার ফেসবুক এবং অসংখ্য মানুষের প্রতিক্ষা…!
৭৮। যখন তুমি চোখ বন্ধ করে ছিলে, আমি জানি… তখন তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে সুখময় দিনগুলোতে……যে পথে হেটেছিল অগ্রভাগি বিদূৎ, বানশালিক আর ফুরফুরে কৃঞ্চচূড়া…
তখন আমরা একসঙ্গে শুনতে পেয়েছিলাম, একসঙ্গে বিশ্বাস করেছিলাম…একসঙ্গে একই ফুটপাতে…শীত, গ্রীস্ম, বর্ষা...
‘
৭৯। …কেউ একাকিত্ব ভেংগে ঘটিয়েছে যুগল বিবর্তন, কারো কোমল হাত কুরুশকাটায় গেঁথেই চলছে গাঢ়লাল সোয়েটার…অথচ দ্যাখো, শীত ব্যাটা এখনো অভিমানে লুকিয়ে আছে মেপলপাতার আড়ালে, ঘুম নেই… রাতের পর রাত অনিদ্রা…সকল উৎসব তাকেও একাকিত্বের পথে ঠেলে দিচ্ছে…
৮০। বাড়ীর পর বাড়ী বদল, মানুষের পর মানুষ…!!! জল শুকালে নদী আর বন? এসব শোকের এখানেই শেষকৃত্য হোক, এখানেই পুড়ুক মন, আর বদলাতে চাইনা…তোমার এবং আমার ঘর……
৮১। পূরন কিছু ফেলে আসলে সেই শোক কাটতে সময় লাগে,……। পুরণ দেয়াল, জানালা, বিশাল আকাশ বদলে পচিশ তলা দালান, সবকিছু এত দ্রুত বদল নিতে পারছিনা… এখন আমি বন্য, নতুন কোন দিনবদলের জন্য……
৮২। অন্তঃপূরের দরজা খোলা রেখে শূন্য স্বপ্নের বাড়ী দৌড়েছিল মানুষ……ফিরে দ্যাখে সব দরজা ভাঙ্গা, হাহাকার বাতাসে ভাসছে তার ওড়না…
৮৩। …সূর্যপাখি, তুমি কই? অব্যাহত আগুনের কাছে মাটি ছুঁয়ে বলেছি, আর বিষন্ন হবোনা, আক্রোশে ভরাবোনা এই শহর…যদি তুমি ডালপালা সরিয়ে দাম্পত্য কোলাহল দূর কর………
৮৪। তাকে দেখবো বলে অনন্ত সময় ঘড়ির কাঁটা দুলিয়েছি, গ্রাম-শহর সীমান্ত পেরিয়েছি, এখন যখন সত্যিই দেখবার সময় হোল, সে নিজেই অন্য শহরে হারিয়ে গেল......
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৪