গুগলুর প্রথম স্কুলের দিনে
আজ আমার গুগলু সোনাটা তার বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে এ গেল।সকাল থেকে আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম।কিন্তু গুগলু যখন বাড়ী ফিরল তখন তার হাত ভরা এক গাদা বই-খাতা আর মুখ ভরা হাসি।আমার যে কি ভাল লাগছিল ! তার দাদাভাই যখন বই দেখতে চাইল তার সে কি ভাব !!! কাউকে দেখতে দিবে না সে । কিন্তু সন্ধার পর যখন অনিক তার বাংলা বই থেকে গলা ফাটিয়ে পরছিল...
“থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎ টাকে......”
তখন তার পরার ইচ্ছেটা আর সে ধরে রাখতে পারছিল না।তাই এক বার আমার ঘরে একবার তার দাদা ভাই এর ঘরে উকি ঝুকি মেরে শেষে তার দাদা ভাই অনিককে গিয়ে বলল । অনিক এর বোধয় তার গলা চর্চা রেখে গুগলু কে পরাতে ইচ্ছা করছিল না । গুগলু বেচারা তখন আর কি করে ? আমি আর বাবা তখন তা দেখে মিটি মিটি হাসছিলাম । তার দাদা ভাই বলল সব বই দেখতে দিলে তাকে পড়তে শেখাবে । গুগলুর চোখে মুখে তখন একই সাথে খুশি আবার চিন্তার আলো খেলা করতে শুরু করল । আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো দেখতে গুগলু কি করে শেষে , কিন্তু বিধাতা তা দেখতে দিল না । ঠিক সেই সময় তার বাবা এল। আর তার সে কি আনন্দ ! ওর বাবাও হাতমুখ না ধুয়েই গুগলু কে পড়াতে বসে গেল।গুগলুর মুখের অ আ ই ঈ শুনে আমার ভেতর তা কেমন যেন করছিল। খুব ভাল লাগছিল ।কিন্তু বাবার জন্য চা নিয়ে এসে দেখি বাবার প্রচন্ড মন খারাপ।হঠাৎ হঠাৎ কেপে উঠছেন,আবার হঠাৎ চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠছে।তখন তাকে দেখে খুব ভয় লাগছে।কি করব ? কি বলব ? মাথায় কিছু আসছিল না।কারনটাও বুঝতে পারছিলাম।কিন্তু সামনে যাবার সাহস হচ্ছিল না। এক দৌড়ে মামনীর ঘরে গেলাম । কিন্তু কি বলব বুঝতে পারছিলাম না । কারন এই কষ্টের পিছনের ইতিহাস আর সব বাঙালীর মত আমার ও জানা ।
মামনী জিজ্ঞাস করল, “কি হয়েছে?”
বললাম, “তোমার কিছু লাগবে?”
মামনি বলল, “না তো , কিন্তু তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
কি জানি কি হয়ে গেল আমার , মামনির কোলে মাথা রেখে অঝরে কাদতে লাগলাম।এক সময় মামনিকে বললাম।আমার মত অঝরে মামনি কাদেনি।কিন্তু তার মুখ দেখে স্পষ্ট তার ভেতরের কথা গুলো বুঝতে পারছিলাম।
রাতে যখন সবাই যখন এক সাথে খেতে বসলাম, তখনও দেখি বাবা ও মামনির মুখ শক্ত হয়ে আছে । কি করব বুঝতে পারছিলাম না । কাল ত শনিবার । অফিস খুলে যাবে।বাসায় অত সময়ও দিতে পারব না।চিন্তায় মাথা নষ্ট হবার যোগার।কি করা যায়?বাবা কে গরুর মাংস দিলাম,যদিও মনে মনে ভয় মামনি না আবার রেগে যায়।দেখলাম মামনি তাকিইয়েও দেখল না।আর বাবাও কি খাচ্ছে তার দিকে যেন কোনো খেয়াল নেই।সবাই খাচ্ছি আমরা।গুগলু টা প্রতিদিনের মত খেতে চাচ্ছিল না।গুগলুর বাবা বলল, “কোনটা খাবি খা না?এত না না করিস কেন?”
গুগলু প্রায় লাফিইয়ে উঠে বলল, “আইসক্রিম খাব”। এই ঠান্ডার মধ্যে আইসক্রিম!আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।বকা দিতে যাব,তার আগেই ওর বাবা বলে উঠল, “উমমম...... খেতে পারিস , তবে এক শর্ত আছে । যদি অ আ সবকটা বলতে পারিস”
গুগলু কে খুব চিন্তিত মনে হল।এর পর ভাব নিয়ে বলতে শুরু করল......
সব কটা শব্দ তার মধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হল।যখন শেষ হলো গোটা ঘরে পিন পতন নিরবতা।সবাই অর দিকে তাকিয়ে।বেচারা খুব ঘাবড়ে গেল।ঢোক গিলল বেশ কবার।এরপর খুব আস্তে করে বলল, “আম্মু,আইস্ক্রিম?”
সমস্ত ঘরটা যেন বাধভাঙা হাসিতে ভেঙ্গে পরলো।
গুগলুর ২৩তম জন্মদিনে
আজ ২৭শে মার্চ , ১৯৭১ । আমার ছোট্টো গুগলুর ২৩ তম জন্মদিন । আমরা এখন দিল্লিতে । গত পাচ বছর আমরা এখানে । আমরা বলতে গুগলু আর ওর বাবা । গুগলু ঢাকায় অনিকের সাথেই । ওর দাদার খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেরা নিজের দেশে বড় হবে , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে । প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে নিজেকে গড়বে। সে ইচ্ছেকে স্বার্থক করেছি আমরা যতটা পেরেছি । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতা সুলভ ভালোবাসায় নিজেদের জম্নভূমিতে থাকা সম্ভব হল না। গত পরশু ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় যা কিছু হল এরপর আমি জানিনা আমার ছেলেরা কোথায় কেমন আছে ।আমি মন থেকে হিসেব মেলাতে পারছিনা ২৪তম জন্ম তিথিতে আমার ছেলে কোথায় কেমন আছে । নিজেকে প্রচণ্ড স্বার্থপর লাগছে !! দেশ থেকে এত দূরে নিজের গা বাচিয়ে থেকে আমি শুধুই আমার ছেলেদের চিন্তা করছি যেখানে আমার দেশে আমার ভাইয়ের আমার বোনের রক্তে আজ সমগ্র দেশ রাঙ্গা। ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী গুগলুর ছোট চাচা রাজ পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বিমাতা পাকিস্তান আমাদের ভাষা কেরে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। বাবা , মামনী , আমি , গুগলুর বাবা , গুগলুর ছোট চাচা আমরা কেউ এটাকে মেনে নিতে পারিনি । আমার দেশের সব চেয়ে নিরক্ষর বৃদ্ধ লোক যার হয়ত উর্দু লিখার প্রয়োজনও পরত না , তিনিও মেনে নিতে পারেননি। ভাষা আমাদের মা । দেশ আমাদের মা । পাকিস্তান বারবার শুধুমাত্র আমাদের মায়ের উপর আক্রমন করে হয়ে উঠেছেন পরম বিমাতা। মাকে বাচানোর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । আমি জানিনা আমি আর কখনো আমার ছেলেদের দেখতে পাব কি না । কিন্তু আমার সমগ্র সত্ত্বা জানে আমার দেশের আকাশ থেকে পাকিস্তান তার কালো ছায়া সরাতে বাধ্য । আমার সোনার বাংলা ছারতে বাধ্য। কারন আমার গুগলু আমার অনিক যে সেখানে । আমার গুগলু আমার অনিকের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে আমার দেশ স্বাধীন না হয়ে পারে না । বাবা মামনী যতদিন বেচে ছিলেন গুগলুর ছোট চাচার জন্য খুব কষ্ট পেতেন । উনারা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন এ রক্ত বৃথা যেতে পারে না । আমি জানি, এ বিশ্বাস বৃথা যেতে পারে না ।আমি এখন যেনে গেছি আমার স্বাধীন দেশের স্বপ্ন আর কয়েক প্রহরের অপেক্ষা মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৪