বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি স্বাধীনতা ঘোষণা ও স্বাধীনতা অর্জন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ শে মার্চের গণহত্যা, ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যা, ও ১৬ ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনীর আত্নসর্মপনের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ছাড়া আর কিছু খুজে পাওয়া যায় না। মধ্যবর্তী ৯ মাসে দেশের কোন সেক্টরে কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ চলল? পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কি-মোমেন্ট গুলো কি? পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে কোন সেক্টরে কেমন যুদ্ধ হয়েছে? ঐ যুদ্ধের পরিকল্পনা কে করেছিল? পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে কে নেতৃত্ব দিয়েছিল? ফলাফল কি হয়েছিল? কত গুলো শহীদের বিনিময়ে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ১০০ বছর পূর্ণ হবে ২০১৮ সালের ১১ ই নভেম্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ ছিলও গালিপোলির যুদ্ধ BATTLE OF GALLIPOLI । গালিপোলি যুদ্ধক্ষেত্র তুরস্কের এজিয়ান সগর ও মারমারা সাগরকে সংযোগকারী পানি পথের উপকূলবর্তী একটা স্থান। ব্ল্যাক-সি বা কালো-সাগর এর এক দিকে ছিলও রাশিয়া অন্য পাশে তুরস্ক। মারমারা সাগর দিয়ে কালো সাগরে প্রবেশ করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ছিলও জার্মানি-হাঙ্গেরিয়া-জাপান এর পক্ষে। পক্ষান্তরে রাশিয়া ছিলও মিত্র বাহিনীর (ব্রিটেন-আমেরিকা) পক্ষে। তুরস্ক অক্ষ বাহিনীর পক্ষে রাশিয়ার ককেশীয় অঞ্চলের দখল নেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করলে রাশিয়ার ডিউক নিকোলাস মিত্র বাহিনীর সাহায্য চায় ঐ অঞ্চল রক্ষার জন্য। ফলে উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী গালিপোলির পানিপথের দখল নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে যাতে করে ব্রিটিশ ফোর্স মারমারা সাগর হয়ে কালো সাগরে পৌঁছে রাশিয়ান বাহিনীকে সাহায্য করতে পারে। এই স্থানটির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলও তার বুঝা যায় এই স্থানের দখল নেওয়ার জন্য দুই পক্ষের প্রাণপণ চেষ্টা দেখে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। প্রতিপক্ষ আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতা-তুর্কের নেতৃত্বে অটোম্যান সেনাবাহিনী।
গালিপোলির যুদ্ধে প্রায় ৫ লাখ সৈনিক প্রাণ হারান। ১১ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অটোমান বাহিনী প্রায় দুই লক্ষ ৫০ হাজার প্রাণের বিনিময়ে এই স্থানের দখল ধরে রাখে; পক্ষান্তরে ব্রিটিশ বাহিনী প্রায় দুই লক্ষ ৫০ হাজার প্রাণের বিনিময়ে গালিপোলির যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ঐ স্থান ত্যাগ করেন। বিশ্বের আর কোন স্থানে এত অল্প জায়গায় এত গুলো শহীদের কবর নাই যা আছে গাপোলিতে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের গালিপোলিতে উপস্থিত হয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সরকার প্রধানরা ঐ যুদ্ধে নিহত শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৭ বছর পরেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐ রকম কোন ইতিহাস জানি না। আমাদের দেশের ভাড়াটে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হলও কুমিরের শিয়ালের বাচ্চা দেখানোর মতো ঘুরে-ফিরে ঐ ২৫ শে মার্চের গণহত্যা, ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যা, ও ১৬ ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনীর আত্নসর্মপনের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি।
আমাদের ভাড়াটে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের গবেষণা ও লেখায় ২৭ শে মার্চ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নাই; কোন বেদনা দায়ক ঘটনা নাই। কেউ-কেউ তো আবার দাবি করে মুক্তিযুদ্ধ নাকি হয়েছিল মাত্র ১৩ দিন: ৩রা ডিসেম্বরের যেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেন সেই দিন থেকে যুদ্ধ শুরু আর ১৬ ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনীর আত্নসর্মপনের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ। ঐ সকল ভাড়াটে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের দাবি মানিয়া নিলে বলিতে হয় যে ২৭ শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে ডাংগুলি ও হা-ডু-ডু খেলে বেড়িয়েছে; কোন যুদ্ধ করে নাই; কোন যুদ্ধ হয় নাই; কোন শহীদ হয় নাই।
ছবি: মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানি এর সাথে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে কমান্ডারা
তুরস্কের গ্যালিপলির যুদ্ধ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের একটা ডিফাইনিং মোমেন্ট; যেমন ডিফাইনিং মোমেন্ট জার্মানদের শীতকালে রাশিয়া আক্রমণ করে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পার্ল হার্বার আক্রমণ একটা ডিফাইনিং মোমেন্ট। গত ফেব্রুয়ারী মাসে একটা আর্টিকেল (Operation Gunnerside: The Norwegian attack on heavy water that deprived the Nazis of the atomic bomb) পড়ে যানতে পারলাম যে জার্মানরা নরওয়ে এর একটা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে একটা রাসায়নিক কারখানায় পারমানবিক বোমা তৈরির অন্যতম উপাদান ভারি পানি তৈরি করতো। সেই কারখানায় মিত্রবাহিনীর একটা কমান্ড অপারেশনে ভারি পানি উৎপাদন ১ মাস পিছিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে জার্মানরা সেই কারখানা চালু করে ভারি পানি উৎপাদন করে। ঐ ১ টা মাস ছিলও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডিফাইনিং মোমেন্ট। কারণ জার্মানির বৈজ্ঞানিকদের এক মাস পূর্বে আমেরিকার বৈজ্ঞানিকরা পারমানবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায় ও এর পরে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বেসামরিক মানুষের উপর পারমানবিক বোমা ফলে। যে ঘটনার পরে জাপান আত্নসমর্পন করার জন্য রাজি হয়ে যায়। যদি আমেরিকার পূর্বে জার্মানির বৈজ্ঞানিকরা পারমানবিক বোমা বানাতে সক্ষম হতো (আমেরিকার পরীক্ষামূকল পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের মাত্র ৪৩ দিন পরে জার্মান বৈজ্ঞানিকরা সফল হয়) তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হলেও হতে পারত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন ফ্রন্টে কোন-কোন যুদ্ধ গুলোকে আমরা ডিফাইনিং মোমেন্ট হিসাবে গণ্য করবো? পোষ্টে মূল বক্তব্য এটাই।
শুনেছি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং এর সময় যুদ্ধের স্ট্রাটেজি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা সদস্যদের ট্রেনিং এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস কতটুকু আলোচনা করা হয় তা জানার আগ্রহ আছে। যদি কেউ শেয়ার করেন আমার সাথে তবে কৃতজ্ঞ থাকবো।
ছবি কৃতজ্ঞতা: পোষ্টে সংযুক্ট ছবিগুলো গুগল মামার সৌজন্যে প্রাপ্ত। কেউ সু-নির্দিষ্ট সুত্র জানালে পোষ্ট যোগ করে দিবো।
তথ্য সুত্র:
১) Inside the Daring Mission That Thwarted a Nazi Atomic Bomb
২) Operation Gunnerside: The Norwegian attack on heavy water that deprived the Nazis of the atomic bomb
৩) BATTLE OF GALLIPOLI
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:১৩