একটার পর একটা কাঠি জ্বালাচ্ছে আর ছুঁড়ে দিচ্ছে শামসু। কিছুতেই পারছে না নদীটার জলে আগুন লাগাতে। তবুও চেষ্টার কোন কমতি রাখছে না শামসু। চারপাশ সুনসান। অবাক চেয়ে আছে চাঁদটার দিকে। আস্ত একটা পুর্ণিমার চাঁদ। কখন যে জ্যান্ত ডুবে গেছে জলতীর্থের জলে! সূর্যডুবার পর থেকেই শামসু আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আর চেয়ে আছে চাঁদটার দিকে। চাঁদটা যেন চাঁদ নয়-মনে হচ্ছে রাধা। সেই আগের মতো করেই শামসুর দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে আর চোখ ইশারায় ডাকছে রাধার দিকে চেয়ে জলে আগুন ধরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় শামসু।
জল থেকে বেশ দূরে লোকটা গলায় সরোদ ঝুলিয়ে বসে পাশে শুয়া কুকুরটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর লক্ষ্য তার শামসুর দিকে। লোকটাকে চারপাশে ঘিরে রয়েছে ৮/১০টা শেয়াল। সবাই চুপ। লোকটা। লোকটার সরাজ। কুকুর। শেয়ালেরা সব। এমনকি রাতটাও চুপ। শুধু দূরে শামসুই নড়াচড়া করছে আর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক জলতীর্থকে আগুনে পুড়বেই। কোনদিকে তার খেয়াল নেই। শুধু চাঁদটার দিকে চেয়ে। জলে ডুবা চাঁদটার দিকে আর লোকটা যাকে ঘিরে বসেছে শেয়ালের মজমা একমাত্র সেই চেয়ে রয়েছে শামসুর দিকে। শামসু এইবার একটু গভীরে নামে। রাধা তাকে ডাকছে-
আইস বন্ধু বইস কাছে/ হাত দিও না ডালুম গাছে
পাকলে ডালুম তোমায় দিব/ নইলে দিব না।
শামসুকে দেখলেই রাধা সুর ধরে গাইতো আর মুচকি হাসতো। রাধার আশায় সেও বসে থাকতো জলতীর্থের পাড়ে। এখানেই রাধা-শামসুর দেখা হতো প্রতিদিন। একজনকে আর একজন দেখতো। রাধা জলে নামতো। স্নান সেরে উঠে আসতো। ভেজা কাপড়ে রাধা- চেয়ে থাকতো শামসু। রাধাও শামসুর দিকে চেয়ে গামছা দিয়ে বুক ঢেকে লাজুক মুখে চলে যেতো। শামসু তবুও চেয়েই থাকতো। রাতের গভীরতার মতো বেড়ে পেট সমান জলে দাঁড়িয়ে সেই জলতীর্থের জলে আগুন ধরাতেই এখন ব্যস্ত সে।
শামসু মিয়া যতই ডুবা চাঁদটার দিকে এগিয়ে যায় লোকটাকে ঘিরে শেয়ালের মজমাটা ততই শামসুর কাছাকাছি আসে মজমাটা সেই আগের মতোই নিরব। শামসুর দিকে চেয়ে লোকটা কুকুরের গায়ে হাত বুলায় আর শেয়ালেরা লোকটাকে ঘিরে।
শামসুর চেষ্টা আরও বাড়তে থাকে। নদী জলে দাঁড়িয়েও ঘামছে সে। মুখের ঘাম জলতীর্থের বুকে ফুটকি তুলছে একইভাবে আর একবার ঘেমেছিল গেল দুর্গাপূজায়। সেই সুযোগ এসেছিল প্রথমবার রাধাকে কাছে পাওয়ার। খোঁজ নিয়ে সন্ধ্যার পর রাধার পিছে পিছে হাজির হয়েছিল প্রতিমামণ্ডপে। তারপর ভিড় ঠেলে ঠেলে একেবারে রাধার পাশে। রাধার হাতে তার হাত আর তারা সরে গিয়েছিল নিরব এক অন্ধকারে। তোমরাতো মুসলমান; পুজোয় এলে কেন? রাধার একথায় শামসু বলেছিল আমার দুর্গার জন্য। রাধা আর কিছু বলেনি। শামসুও না। শুধু অন্ধকারের মতো একজন আর একজনকে বুকে রেখেছিল। আর এইবার শামসু বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে।
শামসুর সাথে সাথে লোকটিও মজমা নিয়ে আর একটু সরে। এবার আর সে কুকুরটির গায়ে হাত বুলায় না। কুকুরটি উঠে দাঁড়ায় আর লোকটির চারপাশে ঘুরতে থাকে। কিন্তু শেয়ালগুলো সেই আগের মতোই চুপ।
বুক জল থেকে শামসু চাঁদটার দিকে হাত বাড়ায়। যেন ডুবে যাওয়া চাঁদটাকে সে তুলে আনতে চায়। এইভাবে একদিন সে রাধাকে তুলে আনে ঘর থেকে। তারপর বিয়ে। দু’দিন পর রাধার বাবার অভিযোগে রাধা আর শামসু ঠাঁই পায় নিরাপদ হেফাজতে। একত্রে নয়। বিচ্ছিন্ন। শুধু রাতে পাশের কামরা থেকে শামসু শুনেছিল রাধার আর্তচিৎকার আর গুঙানির শব্দ। এই রকম শব্দ শামসু এখন আবার শুনতে পাচ্ছে। আগুন জ্বালানোর চেষ্টা ছেড়ে শামসু তার চারপাশের জলে কি যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে। হাতড়ে হাতড়ে শামসু নেমে যায় গলা সমান জলে।
সেই সাথে সরোদ গলায় লোকটা জলের আরও কাছাকাছি এগিয়ে আসে। এবার শুধু কুকুরটা নয় শেয়ালগুলিও উঠে পায়চারি করতে থাকে আর লোকটার বাঁহাত আস্তে আস্তে উঠে আসে সরোদের দিকে।
বেশ কিছুদিন পর শামসু আজই ছাড়া পায় থানা থেকে। একা। এসে শুনে রাধাকে এই জলতীর্থের তীরেই দাহ করা হয়েছে। নিরাপদ হেফাজতে রাধা বেশ নিরাপদেই মারা গেছে।
শামসুর হাতড়ানি এবার বেশ আলোড়ন তুলে জলতীর্থের জলে। গলাজল ছেড়ে শামসু এবার ডুব দেয় চাঁদটার দিকে আর তখনই লোকটা উঠে দাঁড়ায়। তারপর বাঁহাতে সরোদের ঘাড় ধরে ডান হাতটা চালায় সরোদের বুকে। কেঁপে উঠে সারাটা রাত। নদীটাকে পিছনে রেখে লোকটা মজমা ছেড়ে হেঁটে চলে। শেয়ালগুলো লোকটার উল্টো দিকে। শুধু কুকুরটাই জলতীর্থের তীরে দাঁড়িয়ে জলের দিকে অবাক চেয়ে থাকে।