এলোমেলো নদী। পালতোলা নদী। ভৈরবী রাগে বয়ে চলা। ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল। দাঁড় টানা নাও তোমার-তেমন কই? কর্কশ চিৎকার নাওয়ের এঞ্জিনের, পালতোলা নাও, তোমার তেমন কই? মাঝি- ওহে মাঝি; নবারুণ সেই কবে, কোন দেশে কোনকালে তোমায় ছেড়েছিল- মানে সেই যে নবারুণ দাশ কবে থেকে উধাও; সেই যে- সেবার বুঝি সবার ঘরে ঘরে ফসল ধান- খুব ভাল আর উদ্দাম আনন্দ মনে... অথচ ঘরে তার যৈবতী বউ আর তিন বছরের ছেলে শিশু- নবারুণের। ঘরে বৈশাখের দাওয়ার ধান সাথে মনানন্দ। সেই বছরেই তো নবারুণ দাশ- গাতক নবারুণ; কবি নবারুণ দাশ ছেড়ে ছিল, মানে সেই যে তার হদিস মিলেনি; ও মাঝি; এ ঘটনাতো তোমার মুখে কত শুনেছি - মাঝি জলধর; এখন বুঝি তোমার মনে নেই? নবারুণের গান- যে লিখতো উইজ্জার মাছের মতো স্বপ্ন, লতা আর গান। সেই যে নবারুণ বিষ্যুদবারের হাটে চোখের জল বেচতো- হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে তোমার, জলধর মাঝি, তো শোন- সেই এক রাতে সে শুয়েছিল ঘরে; একা- বউ গিয়েছিল বাপের বাড়ি, নাইওর- সেবার ছিল তা আষাঢ় মাস। আকাশে মেঘ ছিল; মনভারী আকাশ- সেই রাতে তখন দ্বিপ্রহর হঠাৎ তার ঘুম যায় ভেঙ্গে- তখন সুনসান চারিধার, রাতটা তরল ছিল অথচ কেমন যেন জটিল- সেই সময় নবারুণের কানে এল পায়ের আওয়াজ। সে পায়ের কিগো খড়ম পায়ের আওয়াজ। সেই পায়ে ছিল ঘুঙরু বাঁধা। খট-ঝুম, খট-ঝুম, খট-ঝুম আওয়াজ হচ্ছেই- তখন নবারুণ বিছানায় শুয়ে- ঘুম ভাঙা নবারুণ দাস। বারান্দার বেঞ্চিতে বসে সেই আওয়াজ। পা দু'টো দোলাতে থাকে। ঝুমঝুম; ঝুমঝুম- আবার কিছু পরে সেই খট-ঝুম, খট-ঝুম স্পষ্ট বোঝে নবারুণ। আওয়াজটা আস্তে আস্তে সরেও যায় খেজুর গাছের দিকে, তারপর ঘাটে বাঁধা নাওয়ে। গলুই থেকে গলুইয়ে লাফাচ্ছে সেই আওয়াজ। পরে আর কিছুই শোনেনি সে ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টির ছন্দে।
ওহ্ শোন মাঝি জলধর, যদি আমার ভুল হয় তবে ধরিয়ে দিও। তোমার গল্প আজ আমি তোমার কাছেই করতে বসেছি। কি বললে; ফাঁদ পেতেছি? হয়তো তাই। তা মাঝি জলধর সেই যে নবারুণ তোমায় ছেড়েছিল- সেই কি তোমাদের শেষ দেখা? এই যে নদী যার পালতোলা মন সে কি ধরে রাখতে পারেনি নবারুণ দাশেরে। তো সেই দিন ভোরেই নবারুণ নাও নিয়ে ছুট দিল বউয়ের কাছে। বড় আদরের ছিল কিনা সে। পথে শুধু সেই বিষ্যুদবারের হাট- নাও ভিড়িয়ে হাটে আবার নবারুণ বেচে চোখের জল। সেইতো নবারুণের উধাও হওয়া তাই নাগো মাঝি জলধর?
নবারুণ দাশ কবি ছিল- বউকে পায়নি; শ্বশুর বাড়িতে শুধু ছেলেটা ছিল। তিন বছরের ছেলে- শিশু দাশ। নবারুণ দাশ- বউ তাকে ছেড়েদিয়েছে; শিশু দাশ মাকে তাকে ত্যাগ করেছে। যৈবতী মনে সে ঘর ছেড়ে ঘর বেঁধেছিল বাপের গাঁয়ের রহমত ব্যাপারির ছেলে শামছুর সাথে। আর সেই যে নাও নিয়ে নবারুণ দাশ গিয়েছিল সে নাও বাইতে থাকলো তো থাকলো- ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকাল না। তাইনাগো জলধর মাঝি? নবারুণের সেই যে উধাও হওয়া তারপর তো তাকে কেউ আর দেখেনি- সেই তো সে বছর- ধানের বছর নবারুণ তোমাকে ছেড়েছিল। সেই নবারুণ দাস, যে কিনা চোখের জল বেচে বেচে আকাশ কিনতো মুঠো ভরে আর তার সেই তিন বছরের ছেলে শিশু দাশ- সে এখন বিষ্যুদবারের হাটে তার সমস্ত বুকখোলে গেরস্থালি বেচে আর মুঠো ভরে বাপের মতো সমস্ত আকাশ জমিয়ে রাখে।
তাই নাগো মাঝি জলধর?