স্বপ্নরা দৌড় দেয় কানামাছি খেলে
স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন নিয়ে সকলের যায় চলে
স্বপ্নরা যদি মুখ দেখে কোন আয়নায়
বিভৎস মুখোশের মানুষ কি চেনা যায়...!
অথচ ঘটল কিনা তাই! যা কথা ছিল তা ঘটল না। সে এখন তার মতোই। যদিও প্রস্থে কিছুটা বেড়েছে। সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে তো শরীর অন্য কিছ বলবে না। তো যা বলা; যা ঘটার ছিল তা ঘটলো না। সে তো উবু হয়ে চলে; বসে চলে, গড়িয়ে চলে শুয়ে চলে, হেঁটে চলে, দৌড়ে-ঘুমিয়ে... সে কিনা তার চলা। সারাদিন শোয়া বসা তবুও কোনো বিরাম নেই। পূর্ণিমার চাঁদ জলে আছড়ে পড়ে, ঝলসে যায় চোখ ঠিক তেমনি। সারারাত বাঁশ ঝাড়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ টুকরো টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ে। ডুবে যায় জলে। নদীর জলে, বিলের জল, পুকুরের জলে। জলে আর পানিতে। ভাসান পানিতে। এই ভাসান পানিতে তো চাঁদ ডুববেই। যে পানিতে মাছ ডোবে, মানুষ ডোবে, স্বপ্ন ডোবে, সংসার ডোবে, ডোবে জীবন সেখানে পূণ্যিমার চাঁন কোন ছাড়। শুধু দেখে সে-সব খবর; ঘটনা। আর ভাবে; উত্তেজনায় শিহরণে উঁচু পাহাড় হয়ে যায় ভাবতে ভাবতে; যদিও এক সময় আবার নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। যে পানিতে স্বপ্ন ডোবে-জীবন ডোবে, যে পানিতে প্রশমিত হয় জেলেদের রক্ত ঘাম আর মৃত শরীর সে পানিতে পূণ্যিমার চাঁন ভাসে কেমনে...
স্বপ্নের কানাগলি খুঁজে ফিরে এইমন
ঘুরে ফিরে প্রতিবার স্বপ্নই আজীবন...
কোটি টাকা দাম পানির, পানির নিচের চকচক রূপালী মাছের। সরকারের পানি। ইজারাদারের পানি। পানিরে কি বাইন্ধ্যা রাখন যায়। পানি তো তার কবুল করা বউ না; খালি বাইন তালাকের ডরে কথা হুনবো। পানি গইলের গরুও না যে ডিগরা দিয়া থুইব। পানিতো চলে তার মতো - নিজ গতিতে বৈশাখের দাওয়ার পরই শুরু হয় পানির চলাচল। মাঝে-মধ্যে দাওয়া পুরা শেষ হয় না - বাইস্যা শুরু হয়ে যায়। ভাসাইয়া নেয়-ডুবাইয়া দেয় পূণ্যিমার চাঁদের মতো চকচকা রঙের পাকা সোনালী স্বপ্ন-সারা বছরের আশা। শুরু হয় পানির চলাচল। সাগরের লাহান ঢেউ ভাঙে শনির হাওর। বুক পানি-গলাপানি ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল বন হয় সাপ বকেদের আশ্রয়। ক্ষেতের ধান যদিও তুলতে দেয়নি পানি তো কি হয়েছে? ক্ষেতের উপর যে পানি তাতে তো মাছ রয়েছে। কত রকম মাছ। ছোট ছোট মলা-চাপিলা থেকে রউ-কাতল-চিতল সব। এগুলি ধরেই না হয় জুটবে খোরাক। মাছ ধরা ছাড়া কিছু করারও তো নেই। মাঝ ধরে যা হবে তাতেই চলে যাবে সংসার-এই বর্ষা। আসছে শীতে আবার ভাসবে জমি, তখন আবার চাষ। জৈষ্ঠ্য হতেই বাড়ে পানি হু হু। গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যায় সবদিকে। গ্রামগুলিকে পেঁচিয়ে ফেলে অজগরের মতো। গ্রামগুলো হয়ে যায় দ্বীপ। শনির হাওড়ের বুকে ভেসে থাকে ঢেউয়ের সাথে লড়ে লড়ে। পাশের নদীটিও নিজেকে সঁপে দেয় হাওড়ের কাছে। বিলীন হয় নদীর অস্তিত্ব। যদিও নদীর পানি মেশে না হাওড়ের পানির সাথে। দেখলেই বোঝা যায় এই পানি নদীর- হাওড়ের বিশালতার কাছে সমর্পিত আজ কিন্তু শীতে আসছে ভেসে উঠবে তার পাড়...
স্বপ্নের কানাগলি খুঁজে ফিরে এইমন
ঘুরে ফিরে প্রতিবার স্বপ্নই জ্বালাতন
বাড়িতেই বসেই বড়শি দিয়ে ধরা যায় পুঁটি, টেংরা। ঠেলা জাল দিয়ে নামলে ইচা। সে অনেক মাছ। এইভাবে চললে তো বাইস্যায় না খেয়ে থাকতে হবে না। চলে যাবে বেশ ভালো। কিন্তু এইভাবে কি চলে! না চলতে দেয়? একদিন না একদিন তো বাধা আসবেই। আসেও। যদিও তা নতুন নয়। প্রতিবছরই এই ফরমান জারি হয়। মাছ ধরা যাবে না। নিজের জমিতে না বাড়ির পাশেও না। বিল-হাওড়-পানি এখন ইজারাদারের। সরকারের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনেছে। ইজারা নিয়েছে। তাই মাছও তার যা ধরা যাবে না। শুধু পানিই কেনেনি ইজারাদার-তার দেখভালের জন্য মানুষও রেখেছে। পানির পাহারাদার-বিলের পইরল। পইরলের সাথে বড় ট্রলার। বন্দুকও আছে। ইজারাদার কত ভালোবাসে এই পানি। শুধু পানিই কিনেইনি-দেখভালের জন্য মানুষও রেখেছে। দিন-রাত তারা ট্রলার নিয়ে ছুটে চলে হাওড়ের মধ্য থেকে প্রান্ত পর্যন্ত। যেখানে পানির ছোঁয়া সে পর্যন্ত। যেখাবে বিলীন হয় চোখের সীমানা তারও পর...
স্বপ্নের চোখ বাঁধা; কানামাছি ভোঁ ভোঁ
বেনোজলে ভেসে যাওয়া পারিস তো
আমায় ছুঁ-
কিন্তু জমির মাছ ধরায় বাধা দেবার ইজারাদার কে? সরকার ইজারা দিয়েছে যে জায়গা তারও সীমানা আছে। সে তো হাওড়ের বুক। তাতে তো শীত-বাইস্স্যা নাই সবসময় অতল পানি; আর আছে মাছ। পানির আসল বসতি-পানির প্রাণ। বোঝে যায় এই কথা। বুঝে জমি তার- এই জমির মাছও তার। বোঝে আমার জমির ফসলের মতো মাছও আমার। বারমাস। তখনি চারিদিক থেকে কিছু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কণ্ঠস্বর
কিছু ঢেউ-শনির হাওড়ের মতো-
`জাল যার জলা তার
কৃষকের জমির মাছ
কৃষক ধরবে বা-র-মা-স'
স্বপ্নের চোখ বাঁধা; কানামাছি ভোঁ ভোঁ
বেনোজলে ভেসে যাওয়া পারিস তো আমায় ছুঁ
ছুঁতে যদি ভরকাস- সানগ্লাস চোখে চাস্
চোখ বুঁজে চিরকাল কানামাছি খেলে যাস্-
কিছু বিপত্তিকর কাজ:
১. মানুষ যখন জেনে যায় তার অস্তিত্ব
২. বুঝে নিতে চায় অধিকার
৩. লড়ে বাঁচার জন্য।
পরিণতি : কিছু খেলা
যার ফলাফল আগে থেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্ধারিত যার বিচারক ভাগ ভাগ টাকা। কোটি টাকা।
রাত্তিরে ঝড় আসে ঘর ভাসে আমাদের
রাত্তিরে ঘর ভাসে ঝড় আসে আমাদের
কোটি টাকার মাছ। ভাগ ভাগ টাকা। ইজারাদার। থানা। পুলিশ। ম্যাজিস্ট্রেট। এম.পি। মন্ত্রী।
জেলে কৃষকের ছোট ছোট জাল। উঠেও ছোট ছোট মাছ। হাওড়ের বড় মাছ সে তো এই জালে উঠে না। কিন্তু ইজারাদারের বড় মায়া এই মাছে প্রতি। হউক না তার সীমানার বাইরে বা জেলেদের বাড়ির পাশে। তবুও পানির সাথে তো পানির ছোঁয়া আছে। তাই টাকায় রাখা `পইরল' যেন কোনো হারামজাদা এই পানির গায়ে হাত দিতে না পারে।
কিন্তু অধিকার-ভাসান পানি। আর চকচকা পানিতে পরে অধিকারের জাল। শুরু হয় খেলা। পইরলের ট্রলার। গুলি। গুটিকয় লাশ। কৃষকের। জেলেদের। আবারো শনির হাওড়। সাগরের লাহান ঢেউ। ভাসান পানি। চকচকা। রূপালি পানি। প্রশমিত আরও কিছু রক্ত-ঘাম।
শনি ভাবে...
ঝড়েদের ঘর বুঝি ভাসে আলো-বন্যায়
আমাদের ঘর ভাসে না জানা অন্যায়...
অস্থির সময়। বদলায়। যেমন বদলায় শনি। বাইসস্যা আর শীত। ভাসান পানিই তো শিখিয়েছে ঢেউ ভাঙতে। আছড়ে পড়তে। কিছু ঢেউ-কিছু প্রতিরোধ আছড়ে পড়ে। ছোট ছোট ভাবে আছড়ে পড়তে শেখে। একটু একটু করে ভাঙতে ভাঙতে ঢেউগুলো একসাথে বড় বড় হয়ে সাগরের মতো ভাঙ্গে। হাজার হাজার গ্রামবাসী। বিক্ষুব্ধ চারদিক। সারি সারি ঢেউ। অগুনতি। শনির- মানুষের। অতঃপর ছিঁড়ে যায় মাননীয় সাংসদের ধবধবে পাঞ্জাবী। ঢেউয়ের কিছু আঁচ লাগে তাঁর একমুখ সুন্নতে; যা ছেঁড়া পাঞ্জাবিটির মতোই ধবধবে। ঢেউয়ের ভেতর থেকে মাননীয় সাংসদ বেড়িয়ে আসেন কেননা ততক্ষণে পুলিশও পৌঁছে যায় ঢেউয়ের মাঝখানে।
ঘেরাও হয় থানা। ইজারাদার থানায়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। পরদিন তিনি জামিনে মুক্ত। অতঃপর আবার আক্রমণ। আবার বিক্ষোভ-প্রতিরোধ। আর নির্ধারণ হয় বিলের সীমানা। হয়েছে তো কি? পেরোতে তো বাধা নেই। ভাষণে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এবার বিচারকরাও সাথে ইজারাদার-পইরল একা নয়। ধারাবাহিক-ম্যাজিস্ট্রেট- এস.পি-প্লাটুন প্লাটুন পুলিশ আর-আর পইরল। আবার গুলি; নৌকা ছিনতাই; গ্রামলুট। আরও কিছু রক্ত-ঘাম-লাশ আবার প্রশমিত শনির বুকে।
এইভাবে ভেসে যাওয়া ঝড় রোদ সন্ধ্যা
বুকটানে ফিরিনা- আমরা কি বন্ধ্যা?
গুলি রক্ত লাশ। এতে কি আর ঢেউ সামলানো যায়। শনির ঢেউ যাদের হারাতে পারেনি- যারা জয় করেছে শনিকে সেই ঢেউ যদি আছেড়ে পড়ে... তখনই ঘটে ঘটনা। যা ঘটার ছিল তা ঘটে না। জনগণ-জনতা-জনগণ অবরুদ্ধ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট-ইজারাদার।
ঘটনা সামলনো দরকার। বিচারকদের বড়দের আসা শুরু-এডিসি; মন্ত্রী। জনগণকে বোঝান-আলোচনা করেন `পুলিশের এই অভিযান বেআইনি' ঘোষণা দেয়া হয়। আর দেয়া হয় প্রতিশ্রুতি।
কানামাছি স্বপ্ন-স্বপ্ন কানামাছি
বাঁধা ছাদা তবুও ভাবি
এখনোতো বেঁচে আছি
আবার আসে শীত। প্রতিশ্রুতি তেমনি আছে-আছে ইজারাদার। শীতের পর বাইস্যা। আবারও শনি ইজারা যায়। আবার ঢেউ ভাঙ্গেঁ আস্তে আস্তে। এবারও নাই কোনো সীমানা। শনি ঢেউ ভাঙ্গে। ভাসান পানি চকচক করে। ঢেউগুলি- কণ্ঠগুলি হাতে হাত রাখে। জাল আর নৌকায় দেয় গাব-শান দেয় কিছু; কিছু একটা। এবারও ভাসান পানিতে-শনিতে প্রশমিত হবে কিছু রক্ত-কিছু লাশ। এবারও শনি গিলবে আরও কিছু মানুষ। তাবে তা জেলে কৃষকের নয়; হয়তো অন্য কারো। অনেক দিনে শনি বোধ হয় তার স্বাদের বদল চাইছে...
তবুও তো আমাদের ফসলে বুকভরা
রামধনু সিঁড়ি বেয়ে স্বপ্ন বেচে যারা
বেচে বেচে স্বপ্ন বেঁচে আছে পৃথিবী!
রামধনু ক্যানভাসে আমরাতো ছবি
ছবিটাই স্বপ্ন- ছবিটাই ঝড় রোদ
ভেসে যাওয়া ঘর তবুও
ছবিটাই প্রতিরোধ...
শনি চকচক করছে- ফুঁসে উঠছে- বদলে যাওয়া সময়েও...
(ভাসান পানি আন্দোলনে সকল শহীদের উৎসর্গীকৃত)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১৫