[এই যে দেখেছি আবছায়াটাই লাগছে ভালো
ঘরের কোণে একটি মাত্র মোমের আলো
কার তাতে কি?
আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি! - সুমন চট্টপাধ্যায়]
ছবিটা দেয়ালে আঁকা। পাখিটা খাঁচায় ঝোলানো। ছবিটা পাখির। খুব যত্ন করে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা। পাখিটা আকাশে উড়ছে। ছবিটা উড়ন্ত পাখির। খাঁচার পাখিটা উড়তে জানে না। উড়তে শেখার আগেই কোন দিন হয়তো এমনি কিংবা ঝড়ে; বাসা থেকে পড়ে গিয়ে কারো হাত ঘুরে শিকারী খাঁচায় অথবা বাসা থেকে পেড়ে এনে পাখিঅলা পাখি; পাখি; বাচ্চা পাখি বলে হাঁকতে হাঁকতে পথে আর তার থেকেই সে খাঁচায়। উড়াটা আর শেখা হয়নি। তাই দরজাটাও আর বন্ধ থাকে না খাঁচার। শুধু মাঝে মাঝে ভিতরে কিংবা বাইরে হঠাৎ যদি পড়ে যায়, ডানা ঝাপটানো ডানা ঝাপটানো। উড়া, সে হয় না।
পাখিটা কথা বলে। শেখানো কথা। পাখিটা ডাকে 'বনলতা'। শেখানো সব। আমরা যা শেখাই সবই সে বলে। পাখিটা গম্ভীর কণ্ঠে জীবনানন্দ আওড়ায় যা আমাদের শেখানো। আমরা পাখিটাকে কথা শেখাই; কবিতা শেখাই- গান শেখাই। পাখিটা শেখে। আমরা পাখিটাকে উড়া শেখাতে চাই। পারি না। কেননা আমরা উড়তে পারি না। আমরা কথা বলতে পারি; কবিতা-গান পারি; পাখিটা অবলীলায় শিখে যায়। অনেক কিছু চেষ্টা না করলেও আমাদের কাছ থেকে শুনে শুনে শিখে নেয়। কিন্তু চেষ্টা করেও তাকে উড়া শেখাতে পারি না।
দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে পাখিটার ছবি আঁকি। পাখিটাকে ছবিতে উড়াই। আর ছবিটা উড়ে উড়ে সত্যি সত্যিই পাখি হয়ে আকাশে ভাসে; গাছে বসে; ফিরে যায় আপন ভূবনে। পাখিটার ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে স্বপ্ন ভাঙ্গে। ভেতরাটা মোচড়াতে থাকে। তবুও আবার স্বপ্নটা দেখি - আমাদের পাখিটা কিংবা স্বপ্নটা পথ খুঁজে পেয়েছে। আপন ভূবনের পথ।
ঘরের তিনটা দেয়াল সম্পূর্ণ ভরে গেছে উড়ন্ত পাখির স্বপ্নে। বাকিটাও ভরে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাখিটা উড়বে; উড়তে শিখবে; অনেক অনেক উঁচুতে উঠবে। খাঁচার দুয়ার বন্ধ থাকলেও ডানা ঝাপাটিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে দরজাটা ভেঙ্গে আকাশে যাবে, যাবে আপন ভূবনে।
অবশিষ্ট দেয়ালটাও প্রায় ভরে যাচ্ছে। আমাদের পাখিটা উড়তে শিখছে না। আমরাও তাকে উড়া শেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেয়ালে দেয়ালে কাঠকয়লার পাখিগুলো; স্বপ্নগুলো উড়ছে আকাশে।
যারা আমাদের পাখিটা দেখে জিভ ঝুলিয়ে লালা ফেলেছিল অথচ আমাদের জন্য খাঁচায় ভিতরেও পাখিটার পায়ে শিকল পড়াতে পারেনি কিংবা যারা আমাদের ছিল অথচ জিভ ঝুলানোদের পাশে গিয়ে কিভাবে পাখিটাকে আকাশে উড়ানো ব্যর্থ করা যায় সে ধান্ধায় ব্যস্ত তারা সকলেই এবং আর একদল যারা 'পাখিটাকে উড়াবো কিন্তু খাঁচার ভিতরে রেখেই' এই কথা বলল তারাই আমাদের দেয়ালগুলো দেখে আমাদের দিকে ভেংচি কাটলো কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিছুটা ভয়ও পেল।
আর আমরা দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ভরে যাবার পর বুঝতে পারলাম পাখিটা কেন উড়া শেখেনি অথচ কথা-গান-কবিতা সবই শিখেছে। কেননা কথা-গান-কবিতা আমরা খুব ভালোভাবেই পারি অথচ আমরা কেউ উড়তে পারি না। আর এর ফাঁকে দেখে নিলাম ওদের ভয়মিশ্রিত ভেংচি কাটা মুখগুলো।
আমরা এখন প্রস্তুত পাখিটাকে উড়া শেখানো; পাখিটা আকাশে উড়বে। কেননা আমরা সকলে ইতিমধ্যে খুব ভালোভাবে উড়তে শিখেছি এবং এখন আমরা নিশ্চিত যে পাখিটাকে উড়তে শেখানো কোনো কঠিন কাজ নয়। পাখিটা উড়বেই...।