আমাদের গ্রামে গঞ্জে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘হাইগা পানি লয় না, মুইতা হাঁটু পানি।’ এই পোস্টটা যেহেতু অনেক ছাগু-পাগু-হাগুরাও পড়তে পারে তাই কথাটার ব্যখ্যা দিচ্ছি। এই কথার অর্থ হলো বড় কাজ করে পানি ব্যবহার করে না অথচ হিসু করে হাটু পানিতে নামে, পারলে ওজু করে। এই কথাটা মনে পড়লো দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আর তার সাথে ছবির হাঁট ভাঙার সূত্র ধরে। ব্লগে, এমনকি ফেইসবুকেও (ব্লগেই বেশি, কারণ সেখানে ছদ্মনামে যা খুশি লেখা যায়) দেখলাম অনেকেই ছবির হাঁট ভাঙায় খুব খুশি। সেটা নাকি একটা অবৈধ দখল, গাজাখোরদের আড্ডা, প্রেমিক-প্রেমিকাদের অবৈধ মিলনের জায়গা এবং সর্বোপরি হারাম ছবি আঁকার কাজ করার আখড়া। তাহলে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধন্যবাদ দেয়া যায় যদি সত্যিই তারা এইসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়। কিন্তু ওই যে আগে হাইগা পানি নেয়ার ব্যবস্থাটা করলে ভাল হয়। বুঝিয়ে বলি, মনে করুন, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর চারপাশ থেকে শুরু করে ঢাকার অন্তত ৯০ ভাগ ফুটপাত (প্রধানমন্ত্রীর অফিস বা বাসা, মিন্টু রোড, গুলশানের বিশেষ দুয়েকটি অভিজাত স্থান ছাড়া) অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। সেই সব দখলদারিরা নিয়মিত পুলিশ, লীগ ইত্যাদিকে চাঁদা দিয়ে নিশ্চিন্তে আছে, ছবির হাট সেটা ম্যানেজ বা ম্যান্টেন করেনি বলেই কি তার অবৈধতাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো। আমি তো নিজের চোখে দেখেছি চারুকলার ছেলেমেয়েরা, শিক্ষকরা এমনকি লেখক, কবি শিল্পীরা সেখানে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় নিয়মিত ছবি দেখতে যায়, যাদের সামর্থে কুলায় দুয়েকটা কেনেও। অবৈধ দখলদারিত্বের তেমন কিছু তো চোখে পড়েনি। দুপাশের দেয়ালে ছবি টানানো হয়, যেখানে ছবি টানানো না-হলে আম-জনতা স্বাধীনভাবে মুততে পারতো, ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করতে পারতো। তো সেই মুত্র বিসর্জন আর ঢিলা-কুলুখের চাহিদাতেই কি ছবির হাটের অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে হলো! গাজার কথা যদি বলি, গাজা কেন যে কোন নেশাই ক্ষতিকর, সমর্থন যোগ্য নয়। কিন্তু হাইকোর্টের মাজার থেকে শুরু করে লালনের আখড়া সবখানেই গাজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়। তো সেইগুলা আগে ভাঙলে ভালো হইতো না। প্রেমিক-প্রেমিকাদের চুম্মা-চাট্টির কথা যদি বলি, নাউজুবিল্লাহ সেইটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। নিঃসন্দেহে বিবাহ বন্ধন ছাড়া বেগানা নারী পুরুষরা সেই এলাকায় হাত ধরাধরি, ঠোঁটে ঠোঁট বিনিময় সহ নানা কিছু করে। এদের উচিত পর্দা প্রথা মেনে বদ্ধ দরজার আড়ালে যা খুশি করা, খোলা ময়দানে এইসব করলে তো অবৈধই হবে। তাছাড়া প্রেম কখনোই বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বৈধতা পেতে পারে না। অতএব সেই অবৈধ সম্পর্কের মিলন মেলাকে ভেঙে দেয়াও দরকার। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে রমনা পার্ক, জিয়া উদ্যান, বোটানিকাল গার্ডেন ইত্যাদিও কি ভাঙা দরকার না? জরিপ করলে দেখা যাবে ছবির হাঁটের চেয়ে বেশি কা-কারখানা এইসব এলাকায় বেশি হয়। আরও বেশি হয় ফকিরাপুল, আরামবাগ, মগবাজারের বিভিন্ন হোটেলে। এমনকি ঢাকার দুয়েকটা অভিজাত রেঁস্তোরাতেও যুগলদের বসার জন্য ব্যক্তিগত সুবিধা দেয়া হয়। সেইগুলা না ভাইঙা আবার ছবির হাটে আসাটা কি মুইতা হাটু পানিতে নামার মতো না? ছবি আঁকা কোন কোন মোল্লার মতে হারাম (যদিও বাংলা এবং ইংরেজি অনুবাদে পড়া কোরানে এমন কিছু পাইনি), তবু ধরে নিলাম ইজমা ও কিয়াস মতে ইহা হারাম। তাহলে খামাখা সাপের ঝুড়ি ভেঙে কি লাভ, পুরা জঙ্গলে আগুন দেয়া দরকার। শুধু ছবির হাট ভাঙলে কি আর ছবি আকা বন্ধ হবে। দেশের সবগুলা চারুকলা ইন্সটিট্যুট, আর্ট স্কুল, এমনকি বাচ্চাদের স্কুলগুলোও (যেখানে ছবি আঁকা শেখানো হয়) বন্ধ করে দেয়া উচিত, ভেঙে দেয়া উচিত।
সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয়, জীবনানন্দ দাস মরে বেঁচেছেন এবং তার সময়েই বলেছিলেন, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা। এখন তো সেই অন্ধদের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। শামসুর রাহমানও বলেছিলেন, উদ্ভূট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। শিল্প সাহিত্য বিরোধী এই রাষ্ট্রযন্ত্র কি ছবির হাঁট ভেঙে দিয়ে আজগুবি মরুদ্যানের খোঁজে বেরুতে চায়। তেতুলবাদী, সায়দাবাদী, বরবাদী এইসব কিছু চলবে, কিন্তু ছবি আঁকা, প্রেম করা, আড্ডা মারা চলবে না, চলতে দেয়া যায় না। তাতে তো মেধার চর্চা হয়। মেধাবী লোক বড়ই বিপদজনক, তারা সব সময়ই প্রশ্ন করে বসে, আপেলটা নীচে পড়লো ক্যান, উপরে গেলো না ক্যান! তাদের প্রশ্ন থেকেই ঝামেলার শুরু হয়। তারা প্রশ্ন করে, সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কী হয় বিধান! হায়, এদেরকে নির্মূল করতে হবে। সরকারী এবং বেসরকারী সকল রকম উদ্যোগে ছবির হাটকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হবে।
তবে সাধু সাবধান, ছবির হাটের মতো ইস্যু নিয়ে নানা জনের পোস্ট থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসবে কোনটা হাটু পানির ছাগল আর কোনটা হাইগা পানি না নেওয়ার পাগল। আমার শুধু মনে হয়, এ সব দেখি কানার হাট বাজার।