একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তৈরি আলবদর বাহিনীর সুপ্রিমো, বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যার কমান্ডার এবং হালের জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে ১০ মে দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে। একাত্তরে কৃত অপরাধের জন্য তাকে এই শাস্তি প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে আরেকটি মাইল স্টোন স্থাপিত হলো। তাই সঙ্গত কারণেই কাজটির সুসম্পন্নের খবরের আশায় ১০ মে সন্ধ্যার পর থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দার ওপর। শহরের মানুষ যার যার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখেছে। তাতে কার কি প্রতিক্রিয়া সেটি তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাটের মোড়ে মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড, পান-বিড়ি, চা এবং মুদির দোকানের টেলিভিশনকে ঘিরে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখে বৃহত্তর জনগণের মনের খবর বোঝা যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অনেক টেলিফোন পেয়েছি। সকলের প্রশ্ন ছিল কখন ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে, এত দেরি হচ্ছে কেন ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার দু’একটি শঙ্কার কথাও বলেছেন। সকলকে বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আপনারা টেলিভিশনে যা দেখছেন, জানছেন, আমিও ততটুকুই জানছি। এর বেশি কিছু আমারও জানার সুযোগ নেই। তবে সবাইকে বলেছি এ পর্যন্ত শঙ্কার কোন কারণ দেখছি না। এই কথাগুলো উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, প্রবল উত্তেজনা আর গভীর আগ্রহসহকারে গ্রামের মানুষ রাত জেগে বসে থাকছে কখন নিজামীর ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয় সেই খবরটি শোনার জন্য। এটাই বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষের ইচ্ছা ও মতের বহির্প্রকাশ। সামান্য কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্মান্ধ পাকিস্তানীপ্রেমিক ব্যতিরেকে বাংলাদেশের মানুষ রাজাকার, জামায়াত, জঙ্গী, হেফাজত, তালেবান ও সাতচল্লিশের চেতনামুক্ত বাংলাদেশ চায়, যে লক্ষ্য অর্জনের পথে গত ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী প্রবল বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই নিজামীর ফাঁসির মাধ্যমে তাদের একটি বড় উইকেটের পতন হলো। প্রমাণ হয়েছে সত্যের জয় চিরদিন হয়।
ন্যায়ের পক্ষে, মানবতার পক্ষে মানুষ থাকে, প্রকৃতি এবং সর্বশক্তিমানও থাকে। সভ্যতার ইতিহাসও সেই কথা বলে। শেষ বিচারে ভিলেনেরা পরাজিত হয় এবং নায়কেরাই জয়ী হয়। বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে ইনশাল্লাহ। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এটাই হলো আমাদের সকল শঙ্কা জয় করার মহৌষধ, আত্মবিশ্বাসের মূল জায়গা। এত বড় শক্তি পাকিস্তানীপ্রেমীদের কাছে নেই। এজন্য আমরা ৩০ লাখ শহীদকে সেল্যুট করি এবং তাদের চরণে মাথা নোয়াই, কদমবুছি করি। অন্যদিকে পাকিস্তানীপ্রেমীরা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কারণ, বাঙালীর সমস্ত শক্তির জায়গা, আত্মবিশ্বাসের জায়গা সম্পর্কে বিতর্ক তুলে, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এর মৌলিক শক্তিকে তারা অবদমিত করতে চায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ, কথাবার্তার দিকে তাকালে এর কারণও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। এ সত্য বারবার প্রমাণ হয়েছে, এ পৃথিবী মানুষের তরে, দানবের নয়। কিন্তু কথা অন্য জায়গায়। নিজামীর রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, নিজামীকে এদেশের মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লাখ নারীর গালে চড় মারা হয়েছে। এটা জাতির জন্য চরম লজ্জা ও অবমাননা। অভাবনীয় বিজয় অর্জনকারী জাতিকে যারা এত বড় চপেটাঘাত করলেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কি কোন পরিবর্তন হয়েছে, নাকি এর চেয়ে আরও বড় চপেটাঘাত করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন? বাঙালিত্ব ও পূর্ণ অসাম্প্রদায়িকত্বে বিশ্বাসী মানুষ, বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অনুরোধ করছি তারা যেন আমার উপরোক্ত প্রশ্নটির গভীরে প্রবেশ করেন, বাংলা মাকে রক্তক্ষরণ থেকে রক্ষার জন্য ভূমিকা রাখেন। একাত্তরে তাদের মতো বয়সে আমরা সেই ভূমিকা নিয়েছিলাম। কিন্তু এই আলবদর, জামায়াত, রাজাকার, মুসলিম লীগারদের বেঈমানীর কারণে আমাদের সকল চেষ্টা সত্ত্বেও ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে। তখন বিজয়ের পর ভেবেছিলাম আর বোধ হয় রক্ত দিতে হবে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে কি ঘটল, তারপর কি ঘটেছে এবং এখন কি ঘটছে তা আমরা দেখেছি এবং দেখছি। একটু চোখ মেলে দেখুন, জামায়াতের সব নেতাকর্মী মিলে বাংলাদেশের যত ক্ষতি করেছে, মুক্তিযুদ্ধকে যত হেয় ও অপমান, অবমাননা করেছে তার থেকে শতগুণ সেসব কাজ করেছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ অকাট্যভাবে প্রমাণ হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সাকার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন এবং ২১ নবেম্বর ফাঁসির দ- কার্যকর হয়। এই সাকা চৌধুরীর পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কি ধরনের ঔদ্ধত্য আচরণ করেছে তা আমরা দেখেছি। আমরাও উপযুক্ত জবাব দিয়েছি এবং আগামীতেও দেয়া হবে। দেশ হিসেবে সেই সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। পাকিস্তানকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। তাই পাকিস্তানের কথা বাদ দিয়ে ফিরে আসি বাংলাদেশের কথায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে শুরু করে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সাকা চৌধুরী যত অবমাননাকর বক্তব্য ও বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করেছে তা একটা স্বাধীন দেশে ভাবা যায় না। এটাকে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায়। কিন্তু শেষ বিচারে প্রমাণ হয়েছে পাপ বাপেরেও ছাড়ে না। এহেন সাকা চৌধুরীর জন্য পাকিস্তানের মাতমের কারণ থাকতে পারে। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন দেখা গেল এতকিছুর পরেও সদ্য সমাপ্ত জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি সাকা চৌধুরীর জন্য আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব গ্রহণ করল, তখন মুক্তিযুদ্ধের ওপর আগামীতে আবার চপেটাঘাতের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিজামী গংয়ের বিচার ও ফাঁসির দ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের হয়ত শেষ হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর থেকে গত ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের যে ক্ষতি তারা করেছে এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতির অঙ্গনে যে বিভ্রান্তি, হট্টগোল, বহুবিধ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে তা থেকে আমরা কিভাবে ও কবে বের হতে পারব? এটাই হবে আগামী দিনের জন্য মুখ্য প্রশ্ন। এই যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সমানে সমান মোকাবেলা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক শ্রেণীর ভেতরেও পদস্খলন ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ বলতে কিছু নেই। তাই রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘকে মানুষের ওপর আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখা কঠিন, বাইরে যত খাবারের ব্যবস্থাই থাকুক না কেন। এখানেও একমাত্র ভরসা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। তিনিই কেবল সব পক্ষকে প্রতিহত করার সক্ষমতা রাখেন।
গত বছর ২১ নবেম্বর সাকা, মুজাহিদের ফাঁসির রাতে এবং ১০ মে নিজামীর ফাঁসির রাতে গ্রাম-গঞ্জ থেকে সেই বার্তাই পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষ দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের সমর্থনে গ্লাবস হাতে আবার মঞ্চে ওঠার জন্য লম্ফঝম্প করছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য তো নে-ই, আদর্শের পদস্খলনের খবর দেখি পত্রিকায় প্রতিনিয়ত। পত্রিকায় ছবিসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয় এই মর্মে যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজাকারের ছেলেও নৌকা প্রতীক পেয়েছে। আদর্শের প্রশ্নে যারা অনড়-আপোসহীন, তাদের জন্য এসব খবর শঙ্কার সৃষ্টি করে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য এখনও আওয়ামী লীগই একমাত্র ভরসার জায়গা। আওয়ামী লীগের ১৯৭৪ সালে সূর্যসেন হলের সেভেন মার্ডারের কথা মনে রাখা প্রয়োজন। রাজাকার গমির উদ্দিন প্রধানের ছেলে শফিউল আলম প্রধান কিভাবে সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়ে এখনও কি করছে। আমরা এখন সামান্য পাবলিক, কিছুই করার সুযোগ নেই। পত্রিকার সম্পাদকদের আগ্রহে দু’য়েক কথা লিখি এই যা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব লেখা পড়েন কিনা জানি না। কিন্তু সাধারণ পাবলিকের পড়ার ফিডব্যাক আসে বলেই আবার লেখার অনুপ্রেরণা পাই, মনে আগ্রহ জাগে। নিজামী গংয়ের দ্বারা বাংলাদেশের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু পিছিয়ে পড়েছে তার কিছুটা পূরণ করা যাবে যদি ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াতের পাঁচশতের অধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই এ দাবি প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়েছে। তাই জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী রাজনৈতিক সংগঠনের বিচারে যে আইন হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পদ বাজেয়াফত করার বিষয়টি যেন সেখানে সংযোজন করা হয়। আর রাজনৈতিক সঙ্কট ও উগ্রবাদী জঙ্গীদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তরুণ প্রজন্মকে জেগে উঠতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্প্রদায়িক সাতচল্লিশের চেতনার রাজনীতিকে না বলতে হবে। শহরের অলিতে-গলিতে, গ্রাম-গঞ্জে তরুণরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে, নিজেদের সুবিধামতো কৌশল বের করে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালে উগ্র জঙ্গীরা পালাতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ অবশ্যই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিজামী গংয়ের ফাঁসির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ওপর চপেটাঘাতের একটা সমুচিত জবাব দিতে সক্ষম হয়েছে। শুক্রবার সকালে লেখাটি যখন শেষ করেছি তখন খবরে দেখলাম নিজামীর ফাঁসির প্রতিবাদে তুরস্ক তাদের ঢাকার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পথে তুরস্কের এমন আগ্রাসী ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই নিন্দনীয়। আমাদের পুরনো কথার যথার্থতা আবার প্রমাণ হলো। জামায়াতসহ সব ধরনের জঙ্গীদের গোড়া হলো ওয়াহাবীতন্ত্র ও মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড, যারা এখন তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:৪৬