ইসলামিক স্টেট (আইএস) বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যায় লিপ্ত এই সন্ত্রাসী এবং উগ্রবাদী সংগঠনটি সবার কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে উন্নত দেশগুলোতে আইএসের নগ্ন হামলায় প্রাণ হারিয়েছে নিরীহ মানুষ। এর ফলে উন্নত দেশগুলো আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্লগার, বিদেশি, লেখক, প্রকাশক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হত্যার মতো অনেক মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর পরই কোনো না কোনো ধর্মীয় লেবাস পরিধানকারী জঙ্গি সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। এমনকি আইএসও’র দায় স্বীকার করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে আইএস সক্রিয়। কিন্তু আমাদের দেশে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। সংশয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আসলে কি বাংলাদেশে আইএস আছে নাকি নেই? একই সঙ্গে ভাবনার বিষয়, দেশ যখন সব দিক দিয়ে অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির পথে, ঠিক তখনই আইএস বিতর্ক ছড়ানো হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক কিছু মহল জোর করেই বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়। তবে কি আইএসের দোহাই দিয়ে এদেশেও মধ্যপ্রাচ্যের মতো নগ্ন হামলা চালাতে সচেষ্ট উন্নত দেশগুলো? আমরা বিশ্বাস করি, এই দেশ কেবলই উন্নয়নের দেশ, আইএসের দেশ নয়।
সম্প্রতি আইএসের মুখপাত্র অনলাইন সাময়িকী দাবিক-এর ১৪তম সংস্করণে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সংগঠনটির কথিত বাংলাদেশ প্রধান শেখ আবু-ইব্রাহিম আল-হানিফ বলেছেন, কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি গড়তে চায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এরপর তারা ভারত ও মিয়ানমারে হামলা করতে চায়। জামায়াতে ইসলামীর মাঠ পর্যায়ের কিছু অনুসারী এরই মধ্যে আইএসে যোগ দিয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এই সংস্করণটি অনলাইনে প্রকাশিত হয়। দাবিকে সাক্ষাৎকার প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই প্রথম আইএস কথিত ‘বাংলায় খিলাফতের যোদ্ধা’ দলের আমিরের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করল। এর আগে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত ছয় মাসে ১৫টি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এর মধ্যে দুই বিদেশি নাগরিক, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পুলিশ হত্যা, আহমদিয়া মসজিদ ও শিয়া মসজিদে হামলাসহ শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর একাধিক হামলা হয়। আইএসের কথিত এই নেতা এ দেশে বিভিন্ন ‘ধর্মদ্রোহী’ গোষ্ঠী ও ‘মুরতাদ’ দল তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রথমত, কিছুসংখ্যক রাফিদা (শিয়া) রয়েছে যাদের মদত ও অর্থ দিচ্ছে ইরান সরকার। এরপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘কাদিয়ানি’ (আহমদিয়া) রয়েছে। তৃতীয়ত, বহুসংখ্যক ‘ধর্মত্যাগী’ রয়েছে, যারা বিভিন্ন ‘দেশি-বিদেশি মিশনারি ও এনজিওগুলোর’ ধোঁকাবাজি প্রচারণার ফলে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ‘কবর-উপাসক সুফি’ ও ‘ভণ্ড সাধুরা’, যারা লোকজনকে ‘শিরক’ করতে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আবু-ইব্রাহিম বলেন, সম্প্রতি সরকার দলটির অনেক নেতাকে কারাবন্দি করেছে ও আদালতের রায় অনুযায়ী ফাঁসি দিয়েছে। আবু-ইব্রাহিম দাবি করেন, জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের কিছু অনুসারী ও সমর্থক এরই মধ্যে আইএসে যোগ দিয়েছে। তবে দলটির নেতারা এখনো তাদের আগের সেই ‘ধ্বংসের পথ’-এ অবিচল রয়েছে। এদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের মতো জঙ্গি সংগঠন পদ্মাপাড়ে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের স্বঘোষিত শাখা হিসেবে কাজ করছে বলে আশঙ্কা ভারতীয় গোয়েন্দাদের একাংশের। বাংলাদেশে পর পর মুক্তমনা চিন্তাবিদদের কয়েকজন নিহত হয়েছেন। ভারতীয় গোয়েন্দারা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে জেনেছেন, ওইসব আসলে আনসারুল্লাহ আর জেএমবিরই কাজ। ভারতীয় গোয়েন্দাদের বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যের মানুষের একটা বড় অংশের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষা অনেকটাই এক। কাজেই আইএস বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও সহজেই পারবে। এ ছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস (ইসলামিক স্টেট) আছে এবং তারাই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান হত্যার তদন্ত বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন বার্নিকাট। জুলহাস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করতে আগ্রহী বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, যে ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে তা পুলিশ বা সরকারের একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়, কারো পক্ষেই একা তা সম্ভব নয়। জয়েন্টলি কাজ করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চাচ্ছে। অবশ্য এ সময় তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বৈঠকে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসাই করেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই আইএসের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের কথিত প্রধানের সাক্ষাৎকারকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তেমন কোনো সংগঠন বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে ঘাঁটি বানিয়ে প্রতিবেশী কোনো দেশে আক্রমণের সুযোগও কাউকে দেয়া হবে না বলে প্রত্যয় জানিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটি একটি ষড়যন্ত্র, দেশী এবং আন্তর্জাতিক সেই ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ। গত দেড় বছরে বাংলাদেশে ব্লগার ও বিদেশি হত্যা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিভিন্ন ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে খবর এলেও সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বরাবরই এ দেশে ওই সংগঠনের তৎপরতার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। রাজধানীর কলাবাগানে দুর্বৃত্তদের হামলায় জোড়া খুনের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে।’ হত্যার জন্য বিএনপি-জামায়াত চক্রকে অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, ‘দেশ যখন সব দিক থেকে সামনে এগোচ্ছে, তখন তারা বেছে বেছে গুপ্ত ও জঘন্য হত্যা সংঘটিত করছে। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড সাধারণ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় নয়। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিত গুপ্ত হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা রয়েছে তা সবাই জানেন।’ আমাদের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা হলো, আইএসের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ আমরা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি। তাদের বর্বর হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। শিশুরাও তাদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। একের পর এক হামলায় ভেঙে পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। গৃহহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। কেবল আরব দেশে নয় আইএসের আক্রমণের শিকার হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোও। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রায় একই সময়ে কয়েকটি স্থানে বোমা হামলা ও বন্দুকধারীদের গুলিতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার না করলেও মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ২২ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের ইয়াবেনতেম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয়ের নিকটবর্তী মালবিক মেট্রো স্টেশনে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩১ জন নিহত এবং ২৭০ জন আহত হন। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ওই হামলাগুলোর দায় স্বীকার করেছে। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিচ্ছিন্ন যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে তা কেবলই সাময়িক উত্তেজনা মাত্র। আইএস হামলার সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ডের বড় কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এর আগেও আমরা দেখেছি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একটি রাজনৈতিক দল একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে টানা অবরোধ ঘোষণা করেছিল। অবরোধ চলাকালে দেশের নিরীহ সাধারণ মানুষকে পেট্রলবোমায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় শত শত যানবাহন এবং সম্পদ। নির্বাচন ঠেকানোর নামে দেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দুর্বৃত্তদের টাকা দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয় বরং এ সবই ছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কাজেই এখন যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হচ্ছে তাতে কোনো বিশেষ মহলের যে মদত নেই তা বলা যাবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে হয়তো আইএস নেই। কিন্তু তাদের বংশধররা রয়েছে সক্রিয়। ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ প্রদানকারী সংগঠনেরও সম্পর্ক রয়েছে। দেশীয় এসব জঙ্গি সংগঠনের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তার নানা সমীকরণও নজরে আসে। এ ছাড়াও বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ধর্মকে পুঁজি করে একটি মহল সর্বদা নিজেদের ফায়দা লোটার চেষ্টায় নিয়োজিত। আমরা দেখেছি দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছিল তখন অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল।
আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বলে এদেশ কখনো আইএস বা জঙ্গিবাদীদের দেশ হতে পারে না। এ দেশ আশাবাদের দেশ। নতুন স্বপ্নপ বোনার দেশ, এগিয়ে চলার দেশ, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়ার দেশ। আমরা উন্নয়নে বিশ্বাসী। বাঙালি জানে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। বাংলাদেশে আইএস আছে এমন কথা বলে বাঙালির উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতাকে কেউ রুখতে পারবে না। উন্নয়নের মহাসড়কে থেকে দেশকে আর কেউ পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবেই। তরুণরাই এদেশে সম্ভাবনা। তারা দেশ বিনির্মাণে অবদান রাখছে। কিন্তু তার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা যথাযথভাবে বজায় রাখা এবং মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন চ্যালেঞ্জের বিষয়। এক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো দমনে যথেষ্ট সক্ষমতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
কোনো চক্রান্ত যেন আমাদের অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করতে না পারে সে বিষষে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। তবে এটাই সত্য যে, এ উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দমন করা কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের আপামর জনসাধারণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামাজিক প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
মিঠুন মিয়া লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়